পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
২ আগস্ট লোকসভায়, শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান উত্তরে জানিয়েছেন : ভারতে স্কুলছুটের হার প্রাথমিকে ১.৫ শতাংশ (ছেলে ১.৭ শতাংশ আর মেয়ে ১.২ শতাংশ), উচ্চ প্রাথমিকে ২.৬ শতাংশ (ছেলে ২.২ শতাংশ ও মেয়ে ৩ শতাংশ) এবং মাধ্যমিক স্তরে ১৬.১ শতাংশ (ছেলে ১৭.০, মেয়ে ১৫.১শতাংশ)। মন্ত্রীমশাইয়ের বয়ানে, পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিকে স্কুলছুটের হার ০.৬ শতাংশ আর মাধ্যমিকে ১৩.৮ শতাংশ (ছেলে ১৪.১ শতাংশ, মেয়ে ১৩.৬ শতাংশ)। গত ৭ জানুয়ারি, কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক ৬—১৮ বছর বয়সি পড়ুয়াদের, এমনকী বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদেরও স্কুল বন্ধ থাকাকালীন অবস্থায় পড়াশোনা যাতে কোনওভাবে বিঘ্নিত না হয় সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা নাকি প্রতিটা রাজ্যকে পাঠিয়েছিল। আরেক প্রস্থ নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছিল ২০২১-র ৪ মে। গ্রাম-গঞ্জ-শহরে নোডাল গ্রুপ, হেল্প-ডেস্ক গঠন ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাসংক্রান্ত বিবিধ চাহিদাকে গুরুত্ব সহকারে সামাল দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। গাদাগুচ্ছের নির্দেশিকায় বলা অনেককিছু হলেও ছিটেফোঁটা বরাদ্দে শিক্ষাক্ষেত্রের কঙ্কালসার চেহারা ফেরানো যে অসম্ভব তা সকলেই জানেন। পরীক্ষাবিহীন মূল্যায়নে শিক্ষার কফিনে শেষ পেরেকটিও পোঁতা হয়ে গেছে। বহু নামী সংস্থা কোভিডকালে উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের বাদ রেখে পূর্ববর্তী বছরের উত্তীর্ণদের দিয়েই নিয়োগপ্রক্রিয়া সারছে। তিনটি নতুন আইনসহ আমেরিকা ‘আনফিনিশড লার্নিং’-এর রাহুগ্রাস থেকে শিক্ষাকে উদ্ধারে আপৎকালীন ভিত্তিতে ২০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। আরও ৭৫০ বিলিয়ন শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রতিবছর ব্যয়িত হবে।
সরকারি চাপানউতোরের মধ্যেই গত ৬ সেপ্টেম্বর, নিরালি বাকলা-জঁ দ্রেজ-বিপুল পাইক্রা-রীতিকা খেরা প্রণীত ‘স্কুল চিলড্রেন অনলাইন অ্যান্ড অফলাইন লার্নিং’-এর সার্ভে রিপোর্টটি সামনে এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকারি তথ্য পরিসংখ্যান যে কতটা ঝুট ‘লকড আউট ইমার্জেন্সি রিপোর্ট অন স্কুল এডুকেশন’ শিরোনামে পশ্চিমবঙ্গসহ ১৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ওপর করা সমীক্ষা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল। ‘স্কুল’ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলে ৮ শতাংশ (শহরে ২৪ শতাংশ) মাত্র পড়ুয়া অনলাইনে পড়াশোনার সুযোগ নিতে পেরেছে। টাকাপয়সা জোটাতে না পেরে ২৬ শতাংশ পড়ুয়া বেসরকারি স্কুল ছেড়ে সরকারি স্কুলের দুয়ারে হত্যে দিয়েছিল। বকেয়া ‘ফি’র অজুহাতে বেসরকারি স্কুল ‘ট্রান্সফার সার্টিফিকেট’ না দেওয়ায় সেই ২৬ শতাংশের আর সরকারি স্কুলমুখো হওয়া সম্ভব হয়নি।
গত ১৭ মাসে, ৩৭ শতাংশ গ্রামীণ পড়ুয়া পড়াশোনার সঙ্গে একেবারেই সংস্রবহীন (শহরে সেই সংখ্যা ১৯ শতাংশ)। ৪২ শতাংশ গ্রামের পড়ুয়া একটা শব্দও ঠিকঠাক পড়তে পারছে না। ৯ শতাংশ শহুরে পড়ুয়া আর ৬ শতাংশ গ্রামীণ পড়ুয়া নেটের ডেটা জোগাড়ে একটি পয়সাও জোগাড় করতে পারেনি। ১৪ শতাংশ শহুরে আর ৪৩ শতাংশ গ্রামীণ পড়ুয়ার কাছে কোনও অনলাইন স্টাডি মেটেরিয়াল পৌঁছয়নি। কানেক্টিভিটির সমস্যায় জেরবার শহরের ৫৭ শতাংশ ও গ্রামের ৬৫ শতাংশ পড়ুয়া। ৭৮ শতাংশ শহর ও ৭৯ শতাংশ গ্রামীণ অভিভাবক মনে করেন লকডাউনের গুঁতোয় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির পড়াশোনা ডকে উঠেছে। ১০-১৪ বছরে সাক্ষরতার হার শহরে ৯৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৭৪ শতাংশ, আর গ্রামে ৬৬ শতাংশ। দলিত আর আদিবাসীদের ক্ষেত্রে সেই মান নেমেছে ৬১ শতাংশে।
৫ শতাংশ শহর ও ১২ শতাংশ গ্রামীণ শিক্ষক/শিক্ষিকা বাড়িতে এসে ছাত্রটির খোঁজখবর নিয়েছেন অথবা লেখাপড়ায় সাহায্য করেছেন। বহু দায়িত্বশীল শিক্ষক নিজের মোবাইল ফোনটি ছাত্রকে পড়াশোনার কাজে ধার দিয়েছেন। অতি-দরিদ্র ছাত্রটির মোবাইল রিচার্জও করে দিয়েছেন। ছোট ছোট দলে ভাগ করে খোলা জায়গায় অথবা নিজের বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে গেছেন। অনলাইন পড়াশোনায় গ্রাম-শহরের গুটিকয় ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করতে পারলেও দূরদর্শনের লেখাপড়া সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে ১ শতাংশ গ্রামীণ পড়ুয়াও অংশ নেয়নি। স্কুল বন্ধ থাকায় গ্রাম বা শহরে শিশুশ্রম বাড়ছে, বাড়ছে বাল্যবিবাহ। অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারে ছেলেমেয়েরা হয়ে উঠছে অবাধ্য-উচ্ছৃঙ্খল-দুর্বিনীত। ৯৭ শতাংশ অভিভাবক তাই চান সত্বর স্কুল চালু হোক।
কিন্তু স্কুল চালু করব বললেই কি চুটকিতে তা সম্ভব? সবার আগে শিশু/পড়ুয়াদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা দরকার। কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা। সর্বজনগ্রাহ্য কোনও চিকিৎসার অভাবে কৌশলে কোভিডের সঙ্গে লড়াই চালানোই শ্রেয়। যে সময় কোভিড নিস্তরঙ্গ, সেই সময়ে স্কুল চালানো বাঞ্ছনীয়। কোভিডের তৃতীয় ঢেউ নিঃসন্দেহে হতে পারে ভ্যাকসিন বঞ্চিতদের অতিমারী। শিশু বা কমবয়সি পড়ুয়াদের ভ্যাকসিন বিনা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কিঞ্চিৎ বেশিই। স্কুল খোলার প্রাথমিক শর্তই তাই সমস্ত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর বাধ্যতামূলক টিকাকরণ। ২৭ আগস্ট ২০২১, সিডিসি তার ‘এমএমডব্লিউআর’ রিপোর্টে ক্যালিফোর্নিয়ার মার্টিন কাউন্টির এক বেআক্কেলে শিক্ষকের কথা ফলাও করে প্রচার করেছে, যিনি মাস্ক পরতেন না এবং ভ্যাকসিনও নেননি। সেই শিক্ষক ২৬টি ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুকে (প্রাথমিক পড়ুয়া) একলপ্তে সংক্রামিত করেছিলেন।
বিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন বদ্ধ ঘরের তুলনায় খোলামেলা বহিরাঙ্গন কোভিডে বহুগুণ বেশি নিরাপদ। তাই স্কুল চালুর সময় ক্লাসঘরের সমস্ত জানলা দরজা খোলা থাকবে, পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অন্যথায় ‘হেপা ফিল্টারের’ বন্দোবস্ত জরুরি। একদিন বাদে একদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্রই কেবল স্কুলের নির্দিষ্ট ক্লাসে আসবে/বসবে, খেয়াল রাখতে হবে কারুর জ্বর রয়েছে কি না। মোবাইল ক্যামেরায় ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রতিদিন ছাত্রদের উপস্থিতির ছবি তুলে রাখলে পরবর্তীতে কোনও ছাত্র/ছাত্রী কোভিডে আক্রান্ত হলে ‘কন্টাক্ট ট্রেসিং’-এ সুবিধা হবে। সপ্তাহে একদিন হলেও স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-ছাত্রছাত্রীদের র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা রাখা ভালো। ছাত্রছাত্রীদের গলাগলি/ঘাড়েপড়া, বিশেষত টিফিন বা মিড ডে মিলের সময় অবশ্যই কড়া হাতে দমন করতে হবে। ক্যাম্পাসেও জারি থাকবে কোভিডবিধি, বিধিসম্মত সতর্কতা। তাতেই সংক্রমণ শৃঙ্খল ভাঙা যাবে। আশপাশের এলাকায় সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হলেই, এবং ভাইরাসটির ‘আরনট’ বাড়তে থাকলেই স্কুল বন্ধ করতে হবে। স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী-পড়ুয়াদের সর্বক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে হবে। দূরত্ববিধি যতটা সম্ভব মানতে হবে। কোভিড বায়ুবাহিত বলেই বিজ্ঞানীদের অনুমান তাই স্কুলঘর স্যানিটাইজেশনে একটু ঢিলে দেওয়া যেতে পারে। হাত ধোওয়ার অভ্যাসটি যথাপূর্বং বজায় থাকবে।
গোটা বিশ্বেই বিধিসম্মত সতর্কতায় ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চালানো সম্ভব হয়নি। ফাইজার-মডার্নার ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, প্রতি ৫০০০ জনে ১ জন, ১৭-১৮ বয়সি, মায়োকার্ডাইটিস ও পেরিকার্ডাইটিসে আক্রান্ত হচ্ছে (জটিল হৃদরোগ)। কমবয়সিদের ইন্টারফেরন-গামা ও ইন্টারলিউকিন-১৭ এবং রিসেপ্টর এমডিএফাইভ-এর প্রাচুর্য নভেলকরোনাকে খাপ খুলতেই দিচ্ছে না। প্রকৃতির আশীর্বাদে কমবয়সিরা কোভিডের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন ছাড়াই যুদ্ধে জিতে যাচ্ছে এবং যাবেও। বড়দের ভ্যাকসিন, মাস্ক এবং দায়িত্বশীল আচরণেই শিশুরা স্কুল এবং স্কুলের বাইরেও নিরাপদ থাকবে।
দি ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনা অফ চ্যাপেল হিল।
মতামত ব্যক্তিগত