পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
বধ্যভূমির নাম লখিমপুর খেরি। সময় রবিবার, ৩ অক্টোবর, অপরাহ্ণ। ক্ষমতার দম্ভে মন্ত্রিপুত্রের গাড়ির চাকায় নির্মমভাবে পিষে মারা হল চার জলজ্যান্ত কৃষককে। নক্ষত্র, দলজিৎ, লাভপ্রীত আর গুরবিন্দর। তাঁরা কেউ সন্ত্রাসবাদী কিংবা পাকিস্তানের চর এমন অভিযোগ অতিবড় গেরুয়া ভক্তরাও তোলেনি। নক্ষত্র আর দলজিতের বয়স যথাক্রমে ৫৫ আর ৩৫। লাভপ্রীত আর গুরবিন্দর তরুণ, বয়স ১৮ থেকে ২০’র মধ্যে। তাঁদের গাড়ির চাকায় এভাবে পিষে দিল কে? তার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, গাড়িতে আলবাৎ ছিলেন মন্ত্রিপুত্র। তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই পুরো ঘটনাটা ঘটেছে। এরই বিপরীতে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র রাষ্ট্রমন্ত্রী অর্থাৎ আশিসের বাহুবলী পিতা স্বাভাবিকভাবেই ছেলের পক্ষ নিয়ে আসরে নেমেছেন। ছেলেকে সার্টিফিকেট দিয়ে তিনি বলেছেন, গাড়িটা তাঁর, কিন্তু তাতে
পুত্র আশিস ছিলই না। সে ছিল ঘটনাস্থল থেকে দূরে। তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। তাই প্রকৃত সত্যটা দেশবাসীর কাছে আজও পরিষ্কার হয়নি। অথচ ইতিমধ্যেই কুস্তিগির পিতা দিল্লিতে অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করে, ছেলেকে নির্দোষ সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন। নিজের হয়েও সওয়াল করেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ও ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম প্রধান ভরকেন্দ্র অমিত শাহ তাতে আপাত সিলমোহরও দিয়েছেন। যার দৌলতে আপাতত মন্ত্রিত্ব বেঁচে গিয়েছে অজয় মিশ্রের। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আদালতের গুঁতোয় পুত্র আশিস অবশেষে শনিবার ক্রাইম ব্রাঞ্চের সামনে হাজির হতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই এভাবে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও তাঁর পুত্রকে ক্লিনচিট দেওয়া প্রশাসনিক দিক দিয়ে কতটা সঙ্গত? খুনের তদন্তে সবক্ষেত্রেই কি এমনটা হয়, প্রশ্ন তুলেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। অভিযুক্ত প্রভাবশালী হলে প্রথম ক’দিন তাঁকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। গ্রেপ্তার করা তো দূরঅস্ত! একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, উন্নয়ন হোক না হোক, হয় কে নয় করতে কেন্দ্র ও রাজ্যের ডবল ইঞ্জিন সরকার যে বিশেষ উপযোগী তা যোগীরাজ্যের প্রশাসনের গত সাতদিনের ভূমিকা থেকেই বোঝা যায়!
অভিযুক্ত আশিসের পিতা অজয় মিশ্র আবার যে সে মন্ত্রী নন, মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী বলে কথা! অমিত শাহের জুনিয়র। মন্ত্রী সাহেবের বিরুদ্ধেও খুনের মামলা আছে এবং ক্ষমতার জোরে তা স্বাভাবিকভাবেই ঝুলে আছে মহামান্য আদালতে। চার বছর ধরে রায়দানই স্থগিত রেখেছে এলাহাবাদ হাইকোর্ট। যাঁর হাত এতটা লম্বা সেই ক্ষমতাবানের ছেলের বিচার নিঃসন্দেহে খুব সহজ কাজ নয়। এহেন মন্ত্রিপুত্রের ধরাকে সরা জ্ঞান করাও খুবই স্বাভাবিক। ঘটনার কথা শুনেই শিউরে উঠল দেশ, এ তো আগেকার জমিদারি ও রাজতন্ত্রে শোনা যেত আকছার। কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে অহঙ্কার করা মহান ভারতবর্ষে এতটা নির্মম ও অত্যাচারী কী করে হল এক নেতা-পুত্র! বিশেষত একেবারে আটপৌরে ঘর থেকে উঠে আসা মহান নেতা নরেন্দ্র মোদির জমানায়, এক আদ্যন্ত যোগীর শাসনে! লাখ টাকার প্রশ্ন সেটাই।
১০২ বছর আগে ১৯১৯-এ পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরীহ নারীপুরুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল ব্রিটিশ শাসক। দেশ তখন পরাধীন ছিল। তাই গোটা বিশ্ব ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠে মুষড়ে পড়লেও সুবিচার মেলেনি। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে যখন মোদি সরকার অমৃত মহোৎসবের প্রস্ততি নিচ্ছে, তখনও কি তৎক্ষণাৎ সুবিচার পেল চার স্বজন হারানো নিরীহ কৃষক পরিবার? নাকি প্রত্যেক নাগরিকের সমান মর্যাদা ও অধিকারকে সম্মান দিয়ে নিরপেক্ষ আচরণ করল পুলিস প্রশাসন ও মাথা উঁচু করা নির্ভীক আমলারা? নাকি এই মর্মন্তুদ ঘটনা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, শিক্ষা সংস্কার, গণতন্ত্র সব মিছে, স্রেফ কথার কথা। আষ্টেপৃষ্ঠে সরকার নামক যন্ত্রটাকে ঘিরে ফেলেছে নির্লজ্জ রাজনীতিকরণ ও নিষ্ঠুর দলতন্ত্রের অভিশাপ। আর সেজন্যই মাঝে মাঝে মনে হয় প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের এই ঘোর লাগা গলিটা ঘোর মিছে, ওখানে সত্য আর নিষ্পেষিত বিবেকের টানাপোড়েনে সাধারণ মানুষ রক্তাক্ত হয়ে গুমরোতে থাকে!
সেই অমোঘ অনিবার্য পরিণতি থেকেই আজ ওই ঘটনার সাতদিন পরও এই বর্বর কাজ কে করল, তার সদুত্তর মেলেনি। সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত মামলায় কেন্দ্রকে নিশানা করে যোগী সরকারকে জোরালো ভর্ৎসনা না করলে হয়তো গ্রেপ্তারির প্রক্রিয়া শুরু হতো না। সমনের নোটিসও ইস্যু হতো না মন্ত্রিপুত্রের নামে। শুধু একটা এফআইআর করেই দায় সারতে চেয়েছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার। যেন মৃতদের পরিবারের জন্য নেহাতই একটা সান্ত্বনা পুরস্কার। এর বেশি আর কোন সুবিচারটাই-বা করতে পারত যোগীর পুলিস? এইখানেই প্রশ্ন তুলেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। বলেছে, সবক্ষেত্রে এমনটাই কী করে থাকেন পুলিস কর্তারা? নাকি হাইপ্রোফাইল কেস বলেই কর্তারাও যথারীতি ঠুঁটো? তল্লাশি, গ্রেপ্তারের সময় কোথায়!
উল্টোদিকে, প্রথমদিকটায় পুলিসের অজুহাতও ছিল অকাট্য, খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না মন্ত্রিপুত্রকে! প্রথম কয়েকদিন শুধু তাঁর অসীম ক্ষমতার অধিকারী মন্ত্রী পিতার বাঁশি শোনা গিয়েছে মাত্র। সুপ্রিম কোর্টের পরপর দু’দিনের ভর্ৎসনার পর অভিযুক্ত আশিস অবশেষে শনিবার ক্রাইম ব্রাঞ্চের সামনে হাজির হয়েছেন। পুলিস তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। যদিও আগেই সংবাদমাধ্যমে, দিল্লির অমিত শাহের সঙ্গে সাক্ষাতে মন্ত্রী ছেলে আশিসকে বেকসুর ঘোষণা করে দিয়েছেন। বলেছেন, ওই নতুন কেনা এসইউভি ‘থর’ গাড়িটি আমার পরিবারের, তবে ঘটনার সময় ছেলে ওই গাড়িতে ছিল না। অথচ যে পুলিস কর্তারা নেতা-পুত্রের টিকিটিও খুঁজে পায় না, তারা অক্লেশে বিরোধী নেতানেত্রীদের গ্রেপ্তার করবেই। আটক করে চলবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেনস্তা। এসবই নাকি নিরাপত্তা ও শান্তিরক্ষার স্বার্থে, উত্তেজনা কমাতে। আর সেই লক্ষ্যেই কখনও প্রিয়াঙ্কা-রাহুল, কখনও কাকলি ঘোষদস্তিদারদের রাস্তায় গাড়ি থামানো হবেই, চলবে দীর্ঘ পুছতাছ। সেই ফর্মুলা মেনেই একাধিক বিরোধী নেতা নেত্রীকে আটক, গ্রেপ্তার করা হলেও প্রধান অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র রাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলেকে থানায় সমনের নোটিস দিতেই ১০০ ঘণ্টা পার হয়ে গেল! তাও সুপ্রিম কোর্টের কড়া সমালোচনার পর। প্রধান বিচারপতি রামনার সমালোচনার পর তা হল নাম কা ওয়াস্তে, স্রেফ দায়সারা।
গত বছর থেকেই কৃষকবিরোধী তিনটি আইন বাতিলের দাবিতে উত্তাল আন্দোলন চলছে দিল্লির সীমানা ঘিরে। তারই মাঝে গোটা দেশকে যাঁরা অন্ন জোগায় তাঁদের চার প্রতিনিধিকে নতুন কেনা গাড়ির তলায় কুচলে মারার কলঙ্ক পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করেছে।
যে বা যাঁরা অপরাধ করল তাঁদের টিকিটাও যোগীর পুলিস খুঁজে পেল না, অথচ বিরোধীদের স্বজন হারানো পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে না দেওয়ার শপথে পুলিস অবিচল। দেখে শুনে মনে হয়, শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন রক্ষার বদলে আজ পুলিসের একটাই কাজ যোগী সরকার ও তাঁর বশংবদদের রক্ষা করা। তার জন্য সত্যকে অন্ধকারে ঢেকে দিতে চেষ্টার বিরাম নেই। মাঝে মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনা, সাধারণের সমালোচনার তির তাঁদের মোটা চামড়া ভেদ করে খুব বেশি দূর পৌঁছয় না।
কিন্তু কেউ স্রেফ তোতা পাখি আর কেউ হুকুম তামিল করার যন্ত্র হয়ে গেলে দেশের মেরুদণ্ডটাই একদিন ভেঙে যাবে। সেদিন দেশের পক্ষে নিশ্চিতভাবে কালো দিন হবে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন বিপথগামী হলে ভারত আর আফগানিস্তানের পার্থক্য ঘুচে যেতে কিন্তু খুব বেশি সময় লাগবে না। তখন এই মহান গণতন্ত্রের সমাধির উপর বসে হাহুতাশ করলেও কোনও ফল হবে না।