গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
রাজ্য এবং জাতীয় রাজনীতিতে বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে যা ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। একটার সঙ্গে অন্যটার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিশেষ করে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মাথা গুলিয়ে দেওয়ার জন্য তা যথেষ্ট। প্রথমে আসা যাক, ভবানীপুরের উপনির্বাচনের কথায়। নির্বাচন কমিশন রাজ্যের পাঁচটির মধ্যে কেবলমাত্র ভবানীপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচন ঘোষণা করল। আর সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ শুরু করে দিল বিজেপি।
সাধারণভাবে মনে হতেই পারে, রাজ্যের মুখ্যসচিবের লেখা চিঠিকে মান্যতা দিয়ে ভবানীপুরের উপনির্বাচন করা হয়েছে। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সময় মমতার হাজার অনুরোধ সত্ত্বেও কমিশন বাংলায় শেষ তিন দফার ভোট একসঙ্গে করায়নি। তাহলে পাঁচ মাসে কী এমন ঘটল যে কমিশন মমতার প্রতি এত সহানুভূতিশীল হয়ে গেল!
নিন্দুকেরা বলছে, এর পিছনেও নাকি আছে কৌশল। প্রথমত, এই মুহূর্তে বিজেপির হাতে মমতার সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারের কোনও ইস্যুই নেই। উল্টে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করে মমতা আরও জনপ্রিয় হয়েছেন। এই অবস্থায় কমিশন কেবল ভবানীপুরের উপনির্বাচন ঘোষণা করায় বিজেপি প্রচারের মোক্ষম ইস্যু পেয়ে গিয়েছিল। হতে পারে কমিশনের কর্তারা এসব ভাবেননি। তবুও অনেকেই কমিশনের এই ‘উদারতায়’ ভুরু কোঁচকাচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, এই একটি সিদ্ধান্তে বাংলায় বিধানসভা ভোটে কমিশনের বিরুদ্ধে ওঠা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ কিছুটা হলেও ‘লঘু’ হয়ে গেল। ‘নিরপেক্ষ’ হওয়ার এমন সুযোগ কে আর হাতছাড়া করতে চায়? আগামী দিনে কমিশনের দিকে তৃণমূল অভিযোগের আঙুল তুললেই বিজেপি ভবানীপুরের উপনির্বাচনকে ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করবেই।
এবার উপনির্বাচনের মুখে কংগ্রেসকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্রমণ প্রসঙ্গে আসা যাক। সোনিয়া গান্ধীর নির্দেশে ভবানীপুর উপনির্বাচনে মমতার বিরুদ্ধে প্রার্থী দেয়নি কংগ্রেস। তা সত্ত্বেও নির্বাচনের আগে মমতা কংগ্রেসকে আক্রমণ করলেন। তাতে অনেকেই হতভম্ব হলেন। ভাবলেন, হচ্ছেটা কী? শুভানুধ্যায়ীরা বললেন, নির্বাচনের আগে এসব না বললেই পারতেন। কেউ কেউ বললেন, মমতা ভুল করছেন। নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনছেন।
না, মমতা ভুল করেননি। আমার বিশ্বাস, তৃণমূল সুপ্রিমো অঙ্ক কষেই কংগ্রেসকে আক্রমণ করেছিলেন। কী সেই অঙ্ক? মমতা বুঝেছিলেন, ভবানীপুরে তিনি বড় মার্জিনে জিতবেন। সেই জয়ে কংগ্রেস যাতে ভাগ বসাতে না পারে, তার জন্য আগাম রাস্তা পরিষ্কার করে রেখেছিলেন। নির্বাচনের আগে এসব না বললে কংগ্রেস নেতৃত্ব বলতে পারত, এটা পুরো মমতার ভোট নয়, তাদেরও ভাগ আছে। ২০১১ সালে জোট করে রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর কংগ্রেসের নেতারা উঠতে বসতে সেকথাই শোনাতেন। মমতা সেই দরজাটা খুব সচেতনভাবে সপাটে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
ভবানীপুরের প্রচারে বেরিয়ে মমতা বললেন, ‘আপনারা ভোট না দিলে আমি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারব না। অন্য কেউ হবে।’ ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বিজেপির ক্যাম্পেন, ভবানীপুরে মমতা হারছেন। এমনকী, তৃণমূলেরও কেউ কেউ শঙ্কিত হয়ে খবর নিতে শুরু করলেন, ভবানীপুরে কি তাহলে ‘আন্ডার কারেন্ট’’ বইছে?
মমতা খুব ভালো করেই জানতেন, মোদি-অমিত শাহের সঙ্গে লড়াই করে ২১৩টি আসনে জয় ছিনিয়ে আনার পর ভবানীপুর উপনির্বাচনে জেতাটা তাঁর কাছে ‘জলভাত’। তবুও তিনি একথা বলেছিলেন। কারণ গোটা দেশের নজর ছিল ভবানীপুরের উপনির্বাচনের দিকে। তাই মিশন-২০২৪ এর লড়াইয়ে নামার আগে তিনি চমকপ্রদ রেজাল্ট করতে চেয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যেই তিনি ভোটার ও দলের কর্মীদের চাঙ্গা করতে এই ‘টোটকা’ প্রয়োগ করেছিলেন।
একে উপনির্বাচন। তার উপর প্রার্থীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উনি হেলায় জিতবেন। তৃণমূল কর্মীদের এই ধরনের আত্মতুষ্টিতে ভোগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই তিনি এভাবেই ভোটার ও কর্মীদের চাঙ্গা করে গিয়েছেন। তার ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। ভবানীপুর কেন্দ্রের সব ওয়ার্ড থেকেই লিড নিয়েছেন। আর বিজেপি নেতৃত্ব মমতার এই স্ট্র্যাটেজিকে তাঁর ‘দুর্বলতা’ বলে ভুল করেছে।
বিজেপির অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। তার অন্যতম কারণ পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাস সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। তারপর উত্তরপ্রদেশের লখিমপুরে মন্ত্রীপুত্রের গাড়ি চাপা দিয়ে আন্দোলনরত চাষিদের খুন করার অভিযোগটা গেরুয়া শিবিরের কাছে মরার উপর খাঁড়ার ঘা। কোনও সন্দেহ নেই, লখিমপুর বিজেপিকে খাদের কিনারায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে। এই অবস্থায় দেশের প্রাচীনতম দল কংগ্রেস বিরোধীদের নিয়ে মালা গাঁথার কাজটা ঠিকমতো করতে পারলেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে নরেন্দ্র মোদির হ্যাটট্রিক করার স্বপ্ন। আর সেই দায়িত্বটা কংগ্রেসের অভিভাবক গান্ধী পরিবারের।
স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে এযাবৎ দেশের স্বার্থে এই পরিবারটির অবদান এবং আত্মবলিদান অতি বড় সমালোচকও স্বীকার করতে বাধ্য। এখনও দেশের প্রতিটি কোণায় রয়েছেন কংগ্রেস অনুরাগী। তাই কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিজেপি বিরোধী লড়াই অসম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, রাহুল গান্ধী সেই কাজটা করে উঠতে পারছেন না। অন্য দলগুলিকে কাছে টানা তো দূরের কথা, নিজের ঘর সামলাতে পারছেন না। বিভিন্ন রাজ্যে ভাঙছে কংগ্রেস।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আন্তরিকভাবেই বিজেপি বিরোধী লড়াই জারি রাখতে চান। তাই তিনি বলেছেন, ‘আমরা কখনওই কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে মঞ্চের কথা ভাবছি না বা বলছি না।’ তবে বিগত দু’টি নির্বাচনে কংগ্রেস যে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি, সেটাও তিনি স্পষ্ট করেছেন। তাই বিজেপি বিরোধী সমস্ত শক্তিকে এক করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিতে চাইছে তৃণমূল। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ বিজেপি বিরোধী দল এগিয়ে আসবে। ভবানীপুর উপনির্বাচনে মমতার জয়ের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নেতানেত্রীদের শুভেচ্ছাবার্তা তারই ইঙ্গিত। ব্যতিক্রম সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী।
অধীরবাবু বলেছেন, ‘কংগ্রেসকে শেষ করতে বিজেপির সঙ্গে অলিখিত জোট করেছে তৃণমূল এবং আপ। এটা আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে লখিমপুরে নিহত কৃষকদের পরিবারের কাছে শুধুমাত্র এই দুই দলের প্রতিনিধিদের যাওয়ার মধ্যে দিয়ে। গোটা দেশে একমাত্র কংগ্রেসই বিজেপির বিরুদ্ধে আদি ও অকৃত্রিম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।’
কংগ্রেসের বিজেপি বিরোধিতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। তবে যাবতীয় সংশয় নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা নিয়ে। কারণ একের পর এক নির্বাচনে রাহুলের নেতৃত্ব দানে ব্যর্থতা প্রমাণিত। অন্যদিকে মমতার সাফল্য প্রশ্নাতীত। বাংলার ভোটে টক্কর নিতে এসে খোদ নরেন্দ্র মোদি নাকে ঝামাঘষা খেয়েছেন। সেই কারণে মমতাকে ঘিরে বিরোধীদের স্বপ্ন দেখা। সম্ভবত কংগ্রেস সেটাই মেনে নিতে পারছে না।
তবে, এই প্রথম নয়। তৃণমূল সুপ্রিমোর বিরুদ্ধে অধীরবাবুরা ১৯৯৮ সালেও এমনই অভিযোগ তুলেছিলেন। বলেছিলেন, কংগ্রেসকে ভেঙে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিএমের হাত শক্ত করছেন। কিন্তু, বাস্তবে হল কী? মমতার আপসহীন লড়াইয়ের তোড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল সিপিএম। আর অধীরবাবুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসে এখন সাইনবোর্ড টাঙানোর লোক খুঁজে পাওয়া যায় না।
২৩ বছর পর ফের একই অভিযোগ। ভাষাও এক। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে আক্রমণের লক্ষ্যকে তার ‘বন্ধু’ বানিয়ে দেওয়ার এ এক ভয়ঙ্কর কৌশল। জাতীয় রাজনীতিতে দ্রুত উঠে আসছেন মমতা। তাই তাঁকে নামানোর জন্য শুরু হয়েছে কাঁকড়ার মতো পা ধরে টানাটানি। কারণ এই প্রথম দেশের জোট রাজনীতিতে নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস।