সন্তানের সাফল্যে গর্ব বোধ। আর্থিক অগ্রগতি হবে। কর্মে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। ঘাড়, মাথায় যন্ত্রণা বৃদ্ধিতে বিব্রত ... বিশদ
যুদ্ধগুলো সংঘটিত হয়েছিল যিশু খ্রিস্টের এক হাজার বছর এবং পয়গম্বর মহম্মদের সাড়ে চারশো বছর পর। তাঁরা দু’জনেই একেশ্বরবাদ প্রচার করেছিলেন। দু’জনেরই অনুপ্রেরণা ছিলেন আব্রাহাম এবং মোজেস। মুসলিমদের কাছে তাঁরা ইব্রাহিম এবং মুসা নামে পরিচিত। ইহুদি ধর্মমতকে নিয়ে এই তিনটিকে একসঙ্গে আব্রাহামীয় ধর্ম বলা হয়। সুতরাং এসব লড়াইয়ের পিছনে যুক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এত যুদ্ধের পরেও, লাখো লাখো অনুগামী সমেত, খ্রিস্টান এবং মুসলিম ধর্মমত রয়ে গিয়েছে। অনুগামীদের বেশিরভাগই সহনশীল এবং শান্তিপ্রিয়, কিছু আছে সমরপটু। ইউরোপ হল খ্রিস্টান প্রধান অঞ্চল। আর যে-সমস্ত জায়গার উপর দিয়ে এই যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে সেসবের মধ্যে প্যালেস্তাইন, সিরিয়া, মিশর এবং অন্য কিছু অঞ্চলে প্রাধান্য মুসলিমদের। এই কাহিনির সারকথা এই যে, কোনও ধর্ম বা ধর্মীয় গোষ্ঠী অন্যকে পরাভূত করতে পারে না।
জিহাদ কী?
তবু জিহাদ শব্দটা চালু আছে। ব্রিটানিক অনুসারে, ইসলামে জিহাদ হল, এক ধরনের প্রশংসনীয় সংগ্রাম বা প্রচেষ্টা; প্রথমত সঠিকটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং ভুলটাকে রুখে দিতে মানুষের সংগ্রাম। তবে, আধুনিক যুগে এটা হিংসাত্মক প্রচারের রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে, লাভ জিহাদ নামক কাল্পনিক দৈত্যমূর্তিটা মৌলবাদী হিন্দুদের আবিষ্কার। উদ্দেশ্য, তরুণ-তরুণীদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। নারকোটিক জিহাদ নয়া এক মনস্টার বা কাল্পনিক দৈত্যমূর্তি। আমি এবং লাখো লাখো ভারতবাসী ব্যথিত যে, পালা নামক স্থানের বিশপ জোসেফ কাল্লারানগাট, যিনি ধর্মযাজকের ভূমিকায় অবতীর্ণ একজন, জিনিসটা তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। ‘লাভ’ এবং ‘নারকোটিকস’ বাস্তবে আছে। অতএব, জিহাদ শব্দটা লাভ (মানুষের একটা স্বাভাবিক আবেগ) এবং নারকোটিকস (এক ধরনের বেদনানাশক এবং আসক্ত করে তোলার মতো মাদক) কথার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা। মতলবটা পরিষ্কার, প্ররোচনামূলক। বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের মনে অবিশ্বাস এবং দ্বন্দ্ব ঢুকিয়ে দেওয়া, যার একদিকে হিন্দুত্ব ও খ্রিস্টমত এবং অন্যদিকে ইসলাম। ধর্মোন্মাদদের কাছে ইসলাম ‘অন্য’ এবং মুসলিম জনগণ ‘অন্য’ বলে গণ্য হয়। একটা সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ জাতির অবশ্যই উচিত, এই ধরনের ফ্যানাটিসিজম বা ধর্মোন্মাদনার মূলোচ্ছেদ করে দেওয়া—এই অপকর্ম কথায়, কাজে অথবা বৈষম্যের ফন্দিফিকিরের মাধ্যমে—যেভাবেই করা হোক না কেন।
কোনও প্রমাণ নেই
ইসলাম ভারতে ‘এক্সপ্যানশনিস্ট’ বা সম্প্রসারণবাদী, তার কোনও প্রমাণ নেই। গত জুনে প্রকাশিত পিইডব্লু সমীক্ষা রিপোর্ট অনেক মিথ ভেঙে দিয়েছে, ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে অনেক ভাষণ। ১৯৫১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী মানুষের মধ্যেকার অনুপাতটির (রিলিজিয়াস কম্পোজিশন) আহামরি হেরফের হয়নি। দুটি কারণে মুসলিমদের অনুপাত সামান্য বেড়েছে: (১) মাইগ্রেশন এবং (২) মুসলিমদের ফার্টিলিটি রেট। যদিও এটা পরিষ্কারভাবে ৪.৪ (১৯৯২) থেকে ২.৬ (২০১৫)-তে নেমে এসেছে। এই ফার্টিলিটি রেট হিন্দু এবং অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর থেকে একটু বেশি। তবু বলব যে ২০৫০ সালেও ভারতে হিন্দুরাই থাকবে মোট জনসংখ্যার ৭৭ শতাংশ (১৩০ কোটি)। পিইডব্লু সমীক্ষায় যাঁরা উত্তর দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৮১.৬ শতাংশ নিজেদের হিন্দু পরিচয়ে বেড়ে ওঠার কথা জানিয়েছিলেন, কিন্তু এখন হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন ৮১.৭ শতাংশ। তেমনি ২.৩ শতাংশ জানিয়েছিলেন যে তাঁরা বেড়ে উঠেছেন খ্রিস্টান হিসেবে এবং এখন খ্রিস্টানরা ২.৬ শতাংশ। ইসলামে গণধর্মান্তর একটা মিথ্যে প্রচার।
মৌলবাদী দক্ষিণপন্থী হিন্দুরা পালা-র বিশপকে যে সমর্থন করছেন এর মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ দু’জনেরই লক্ষ্য ‘অন্য’, সোজা কথায় মুসলিমরা। আমাদের ভুললে চলবে না যে একাধিক ঘটনায় মৌলবাদী দক্ষিণপন্থী হিন্দুরা খ্রিস্টানদের সঙ্গেও ‘অন্য’ হিসেবে ব্যবহার করেছে। জনগণের মধ্যেকার যে-কোনও অংশের মানুষকে ‘আলাদা’ দেগে দেওয়ার এই মানসিকতা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আমার স্কুলের অভিজ্ঞতা
আমি একটি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছি। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি থেকে যারা আসত তাদের মধ্যে হিন্দুদেরই ছিল বিপুল গরিষ্ঠতা। খ্রিস্টানরা আসত সামান্য সংখ্যায় আর মুসলিম দু-চারজন। প্রতিটা ক্লাসকে অনেকগুলো সেকশনে ভাগ করা হলেও ক্লাস লিডার থাকত একজনই, প্রবাদপ্রতিম হেড মাস্টার মশায় কুরুভিলা জেকব তাকে বেছে নিতেন। ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত, যে পাঁচবছর আমি সেখানে পড়েছি, আমাদের ক্লাস লিডার ছিল এ কে মুসা। মুসা ছিল হাসিখুশি ও বন্ধুবৎসল কিন্তু গড়পড়তা একজন ছাত্র। ক্লাস ইলেভেন, মানে ফাইনাল ইয়ারে যে ক্লাস লিডার, অটোমেটিকালি সে-ই গণ্য হবে স্কুল লিডার হিসেবে। কাণ্ড দেখুন, হেড স্যার যাকে মনোনীত করলেন তার নাম হারুন মহম্মদ! কোনও ছাত্র, এবং অবশ্যই হিন্দু অথবা খ্রিস্টান ছাত্ররা, এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু করা হয়েছে বলে ভাবেনি। ‘তোষণ’ শব্দটা আমাদের কাছে পুরোপুরি অজানাই ছিল।
আমি খুশি যে মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন ওই বিশপকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন, ‘যারা ভুলভাল তত্ত্ব প্রচার করবে সরকার তাদের কাউকেই রেয়াত করবে না।’ আমি আরও বেশি খুশি হয়েছি এটা জেনে যে, বিরোধী নেতা ভি ডি সতীশন মুখ্যমন্ত্রীর এই বিবৃতিকে সমর্থন করেছেন।
যারা নষ্টামি করার জন্য নারকোটিক জিহাদের কথা বলে, তাদের তিন হাজার কেজি বা তিন টন পরিমাণ হেরোইন বাজেয়াপ্ত হওয়ার নজিরবিহীন ঘটনাটির কথা ভেবে দেখা উচিত। মনে রাখতে হবে, ওই বিশাল পরিমাণ মাদক একটি বন্দর মারফত গুজরাতে ‘আমদানি’ করার চেষ্টা হচ্ছিল। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি যে, সরকারি পর্যায়ের অত্যন্ত উঁচু মহলের মদত ছাড়া এই বিপুল পরিমাণ মাদক ‘আমদানি’ করার হিম্মত কারও (মুসলিম নয়, এমন এক দম্পতিকে আটক করা হয়েছে) হতো না।
প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত, লাভ কিংবা নারকোটিক, যে-কোনও জিহাদ নিয়ে কথাবার্তার বিরোধিতা করা। তিন হাজার কেজি হেরোইন আটকের ব্যাপারেও তাঁদের মন্তব্য প্রার্থনীয়। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং সামাজিক ঐক্যের উপর এই ইস্যুগুলোর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত