সন্তানের সাফল্যে গর্ব বোধ। আর্থিক অগ্রগতি হবে। কর্মে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। ঘাড়, মাথায় যন্ত্রণা বৃদ্ধিতে বিব্রত ... বিশদ
সুন্দরবনে লোকালয়কে বাদ দিলে বাংলাদেশ এবং আমাদের দেশে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ গাছ রয়েছে। তা বাংলাদেশে রয়েছে ১০,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার (৬২শতাংশ) এবং পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ৪,৭২৬ বর্গ কিলিমিটার (৩৮শতাংশ)। গোটা বনে খান-পঁচিশ প্রজাতির ম্যানগ্রোভের অস্তিত্ব টিকে রয়েছে। প্রাকৃতিক কারণে জঙ্গলের পাড় ভাঙতে ভাঙতে বনের অংশ ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। নদীরগুলির নাব্যতাও কমে যাচ্ছে। অল্প বৃষ্টিতে এবং সামান্য ঝড়ে জলোচ্ছ্বাসের কারণে নদীর বাঁধ ছাপিয়ে কৃষিজমি প্লাবিত হচ্ছে। অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে কৃষি-জীবিকা।
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশে প্রায় ৪,৭২৬ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল রয়েছে। প্রশ্ন হল, তা সত্ত্বেও কেন আবার নতুন করে ম্যানগ্রোভ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হল? আসলে মাটি ধ্বংসের ফলে সুন্দরবনের জঙ্গল ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। পলি জমে-জমে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় প্রায়ই বন্যা দেখা দিচ্ছে। সুন্দরবন এখন অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে রয়েছে। সুন্দরবন মূলত গড়ে
উঠেছে ম্যানগ্রোভকে ঘিরেই। আর এই ম্যানগ্ৰোভই এখানকার মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন।
অথচ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের জীবন-জীবিকা। সেই কারণেই বর্তমানে ম্যানগ্রোভের প্রসার ঘটানো খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
এখানকার অধিকাংশ মানুষ জল-জঙ্গলের উপর সরাসরি নির্ভরশীল। সরকারি নির্দেশে বনে ঢোকায় বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নদীর বাঁধ ভেঙে বারবার বন্যাও হচ্ছে। অতিবর্ষণেও হয় ফসলের ক্ষতি। চাষিদের তাই মাথায় হাত। যুব সম্প্রদায়ের একটা বিশাল অংশ এখন জীবিকার খোঁজে সুন্দরবন ছেড়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। এদিকে, দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে সেখানে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মহিলা ও শিশু পাচারের অসাধু চক্র। অসহায় মহিলাদের অনেকেই আবার অভাবের কারণে তো স্বেচ্ছায় ‘বিকোচ্ছেন’। বিষয়টি খুবই বেদনাদায়ক।
পরিবেশবিদ, প্রকৃতিবিদ, ভূতাত্ত্বিক এবং গবেষকরা বারবার বলছেন, সুন্দরবন ক্রমশ ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সুন্দরবন বাঁচানো এখন রাজ্য সরকারের প্রধান লক্ষ্য। কীভাবে সুন্দরবনকে রক্ষা করা যাবে? সেই নিয়েও চলেছে বিস্তর কাটাছেঁড়া। ২০০৫ সালে ‘আয়লা’ ঝড় এবং ২০২০ সালে ‘উমপুনে’ ক্ষতি হয়েছে নদী বাঁধের। কিন্তু ম্যানগ্রোভ অধ্যুষিত এলাকা রক্ষা পেয়েছিল। এরপরই প্রয়োজন বুঝেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ম্যানগ্রোভ প্রকল্প’ গ্রহণ করেন। তাঁর নির্দেশে প্রকল্প কার্যকর করতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক ড. পিউলগানাথন ম্যানগ্রোভ অভিজ্ঞদের নিয়ে বারবার বৈঠক করেছেন। এবং বিভিন্ন দপ্তরের অধিকারিকদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ‘ম্যানগ্রোভ প্রাচীর’ গড়ার কাজে। জেলাশাসক ম্যানগ্রোভ তৈরির পাশাপাশি গ্রামীণ কর্মসংস্থানের উপরও জোর দিয়েছেন। এমজিএনআরইজিএ-র মাধ্যমে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদেরও এই কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে। জেলাশাসকের এই উদ্যোগে গ্রামের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। খুশিতে আপ্লুত সুন্দরবনের মানুষ।
নদী লাগোয়া এলাকার মানুষজনকে সঙ্গে নিয়েই নদীবাঁধের ধারে চলছে ম্যানগ্রোভ নার্সারি তৈরি, পাশাপাশি রোপনের কাজও। পুরো ম্যানগ্রোভ প্রকল্পের কাজ সফল করার ভার এসে পড়েছে এমজিএনআরইজিএ দপ্তরের জেলা আধিকারিকের উপর। নাওয়া-খাওয়া ভুলে তিনিও পড়ে রয়েছেন বাদাবনে। প্রতিটি মানুষকে নিয়মিত কাজ দেওয়া এবং সঠিক পারিশ্রমিক পাইয়ে দেওয়ায় দায়িত্ব ম্যানগ্রোভপ্রেমী ওই আধিকারিকের। এছাড়াও দক্ষিণ ২৪পরগনা বন বিভাগের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার, সহকারী অফিসার ও ম্যানগ্রোভ নোডাল অফিসার, সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিল্ডের ডিরেক্টর এবং ম্যানগ্রোভ নোডাল অফিসাররাও রোদবৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বাদাবনে পড়ে রয়েছেন প্রকল্পটির সার্থক রূপায়ণের তাগিদে। সুন্দরবনের মানুষের কাছে তাঁরা যেন হয়ে উঠছেন কল্পতরু। নদীর পাড়ে-পাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে এবং শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ম্যানগ্রোভপ্রেমী সরকারি আধিকারিকরা আনন্দের সঙ্গেই তাঁদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাই খুশি সুন্দরবনবাসী। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০২০-২১ আর্থিক বছরে সুন্দরবনে আড়াই হাজার হেক্টর চরে পাঁচ কোটি ম্যানগ্রোভ রোপন করা হয়েছে। (সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের অধীনে ৫০০ হেক্টর এবং দক্ষিণ ২৪-পরগনা বন বিভাগের অধীনে ২০০০ হেক্টর)। চলতি ২০২১-২২ আর্থিক বছরে আরও তিন হাজার হেক্টর চরে নতুন করে চারা বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চারা বসানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পনেরো কোটি। নার্সারিতে জন্মানো সমস্ত চারাগাছ তুলে আগামী তিন মাসের (ডিসেম্বর) মধ্যে রোপন করতে হবে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার জন্য একাজে যুক্ত মানুষের মধ্যে চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। আধিকারিক এবং শ্রমিকদের মনোবল বাড়াতে জেলাশাসকও মাঝেমধ্যে সময় করে চক্কর মেরে আসছেন।
এবার বিরল প্রজাতির ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সুন্দরী, ওড়া, কেওড়া’র বিশেষ নার্সারি বানানো হয়েছে। শীতে সুন্দরবন ভ্রমণ পর্ব শুরু হলে পর্যটকদের মাধ্যামেও একটি করে ম্যানগ্রোভ চারা সুন্দরবনের মাটিতে রোপণ করানোরও চিন্তাভাবনা প্রশাসনের তরফে করা হয়েছে । এর ফলে সুন্দরবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে তাঁদেরও একটা অবদান থাকবে। এইভাবে সকলেরই অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুন্দরবনকে বাঁচানোর যে চেষ্টা শুরু হয়েছে এই রাজ্যে তা সম্ভব হলে ম্যানগ্রোভপ্রেমী সুন্দরবনবাসীদের আর সুন্দরবন ছেড়ে অন্য কোথাও পালাতে হবে না। আবার নিশ্চিত করা যাবে তাঁদের জীবন-জীবিকাও।