দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
গুল আগা সিরাজি ছিলেন নিছক এক জমির মালিক। তাঁকে একটি প্রদেশের গভর্নর পদে বসিয়েছিল আমেরিকা। কারণ তিনি আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন তালিবানের বিরুদ্ধে সংবাদ দিয়ে। সেই গভর্নরের ভাই কান্দাহারের এয়ারপোর্ট নিয়ন্ত্রণ করতো বাণিজ্যিকভাবে। সেই এয়ারপোর্টের তাবৎ পরিকাঠামো নির্মাণের উপকরণ ক্রয় করা হয়েছে আমেরিকার সংস্থা থেকে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানকে পুনর্গঠন করতে আমেরিকা বিপুল অর্থ বরাদ্দ করেছে। শুধু আমেরিকা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র আফগানিস্তানকে স্বাভাবিক চেহারায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অর্থ দিয়েছে আফগান সরকারকে। সেই টাকায় তৈরি হয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, ব্রিজ, সরকারি ভবন। কিন্তু সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যত টাকা আফগান সরকারকে অনুদান হিসেবে দিয়েছিল বিভিন্ন রাষ্ট্র, তার ৪০ শতাংশই আবার ফিরে গিয়েছিল ওইসব রাষ্ট্রের কর্পোরেট কোম্পানিগুলির কাছে। কারণ, যাবতীয় পুনর্গঠনের কাজের কন্ট্রাক্ট ওই কোম্পানিগুলি পেয়েছিল। স্কুল, হেলথ ক্লিনিক, রাস্তা তৈরির জন্য আমেরিকার নিউ জার্সির কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লুই বার্গার গ্রুপ কত অর্থ পেয়েছিল? দেড়শো কোটি ডলার। একটি কন্ট্রাক্টে। শুধুমাত্র একটি কোম্পানি। এরকম অসংখ্য সংস্থা আছে ছোটবড়।
আমেরিকার সেন্টার ফর পাবলিক ইন্টিগ্রিটির একটি রিপোর্টে মজার তথ্য জানা যাচ্ছে। সাদ্দাম হোসেন জমানা শেষ করার পর ইরাক পুনর্নির্মাণের কাজে নিয়োজিত আমেরিকা ইরাকের মন্ত্রীদের কীভাবে নতুন করে শুরু করতে হবে জানিয়ে একাধিক অ্যাডভাইসর কোম্পানিকে ইরাকে কাজ করার জন্য কন্ট্রাক্ট দিয়েছিল। তাদের মধ্যে একটি কোম্পানি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেই কোম্পানির একজন মাত্র কর্মী। কোটি কোটি ডলারের চুক্তি হওয়া সেই সংস্থার একজনই মালিক এবং একজনই কর্মী আসলে কে? আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক মহিলা অফিসারের স্বামী। আফগানিস্তানেও ঠিক তাই। আফগানিস্তানের আশপাশে থাকা কাস্পিয়ান রিপাবলিক রাষ্ট্রগুলিতে তেলের সম্পদ পাওয়ার লড়াইয়ে নিজেদের কোম্পানিগুলিকে স্থায়ী স্থান করে দেওয়ার দরকার ছিল। আমেরিকার তেল ও অস্ত্র সংস্থাগুলির সম্পর্কে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এইসব সংস্থার প্রাক্তন কর্মীরা পরবর্তীকালে হয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অথবা প্রতিরক্ষা সচিব কিংবা পেন্টাগনের অ্যাডভাইসর।
আমেরিকা বিগত ২০ বছরে আফগানিস্তানকে পুনর্নির্মাণ করতে বরাদ্দ করেছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি ডলার। যুদ্ধের জন্য পৃথকভাবে খরচ হয়েছে অন্তত ৮৫ হাজার কোটি ডলার। এছাড়াও রয়েছে রিকনস্ট্রাকশন বাজেট। অন্তত তিন লক্ষ কোটি ডলার। কিন্তু সাধারণ আফগানদের জীবনযাপনের কোনও হেরফের হয়নি। বিপুল মুনাফা করেছে আফগান সরকারে থাকা মন্ত্রীরা, ব্যবসায়ীরা এবং আমেরিকা ও অন্য বিদেশি রাষ্ট্রগুলির কর্পোরেট।
ইরাক ও আফগানিস্তান ওয়ার ইকনমির আদর্শ উদাহরণ। আগস্ট মাসের ৩১ তারিখ আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে এটাই সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু তার ঠিক দু’মাস আগেই ওয়াশিংটনে বসে তৎকালীন আফগান সরকার ও আমেরিকার মধ্যে একটি চুক্তি হয়ে গেল। আমেরিকা ৩৭টি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার দেবে আফগানিস্তানকে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার আগে। আরও দেবে এ২৯ সুপার ফিক্সড উইং অ্যাটাক এয়ারক্র্যাফট। আফগান সরকার আগাম অর্থ বরাদ্দ করে দিল দ্রুত। কারা পেল সেই কন্ট্রাক্ট? সিক্রোস্কি গ্রুপ। আমেরিকার বিখ্যাত অস্ত্র কোম্পানি। সেইসব কন্ট্রাক্ট অথবা বিগত ২০ বছর ধরে দেওয়া অস্ত্র, ফাইটার জেট, মিসাইল কী কাজে লাগল? বিনা বাধায় তালিবান যোদ্ধারা দখল করে নিল অনায়াসে। লাভ হল কার? আর্মস আর কনস্ট্রাকশন কর্পোরেটের। সবথেকে বেশি লাভবান কারা হয়েছে আফগান যুদ্ধে? লকহিড মার্টিন, ডায়ান কর্প, অ্যাকাডেমি, ব্ল্যাক অ্যান্ড ভিচ, এক্সন মোবিল। ইরাক, সিরিয়া এবং আফগানিস্তান, এই তিন যুদ্ধে ২৭ হাজারের বেশি কনট্রাক্ট সার্ভিস দেওয়া হয়েছে নানাবিধ কোম্পানিকে।
আমেরিকার শেয়ার বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয় কখন? ঠিক যখন কোনও একটি অথবা দুটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আমেরিকা সরকার হুমকি হুঁশিয়ারি দেওয়া শুরু করে। ওই রাষ্ট্রকে শিক্ষা দেওয়ার বার্তা দেয়। এই উদ্যোগ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায় আমেরিকার পাঁচটি ডিফেন্স উপকরণ কোম্পানির সবথেকে বেশি বেড়ে যাচ্ছে এবং বাণিজ্যমহল দ্রুত সেইসব কোম্পানির শেয়ার কিনছে। কারা এই পাঁচটি কোম্পানি? লকহিড মার্টিন, বোয়িং, রেথিওন, নর্থক্রপ গ্রুম্যান এবং জেনারেল ডায়নামিকস। যুদ্ধের আগে যারা ১০ হাজার ডলারে এইসব শেয়ার কিনেছিল, তারাই এখন দেখতে পাচ্ছেন শেয়ারের দাম বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। একইসঙ্গে আফগান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিগত ২০ বছর ধরে লুটে নিয়েছে আমেরিকা এবং অন্য দেশগুলির বিপুল আর্থিক অনুদান। সাধারণ আফগানবাসীর কাছে রয়ে গেল একদিকে তালিবান এবং অন্যদিকে চরম দারিদ্র। তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে।
কিন্তু এসবের আড়ালে আফগানিস্তানে ২০ বছর ধরে কাটিয়ে আমেরিকা এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে অন্য একটি বিপদ। তারা যখন আফগানিস্তান, ইরাক আর সিরিয়ায় যুদ্ধ এবং যুদ্ধবাণিজ্যে ব্যস্ত ছিল, সেই সুযোগে চীন নিজেকে বিপুল এক প্রভাবশালী জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। কেন চীন আগ বাড়িয়ে ভারতের জমিতে ঢুকে পড়ছে? ভারতকে হুমকি হুঁশিয়ারি দিচ্ছে? তাইওয়ানের আকাশে ফাইটার জেট নিয়ে চ্যালেঞ্জ করছে যে কোনও সময় বম্বিং-য়ের? হংকং থেকে জাপান প্রত্যেককে ভয় দেখাচ্ছে? কারণ, চীন একদিকে যেমন মিলিটারি শক্তি নিয়ে চরম আত্মবিশ্বাস পেয়েছে, একইসঙ্গে বিশ্বের প্রতিটি মহাদেশের অন্তহীন রাষ্ট্রকে আর্থিক অনুদান, লগ্নি আর ঋণের ফাঁদে নিজেদের শিবিরে নিয়ে এসেছে। আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা, এই দুই মহাদেশের প্রতিটি দেশে চীনের ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে এবং সেইসব দেশকে দেওয়া হয়েছে নিয়ম করে বিপুল আর্থিক প্যাকেজ। বহু দেশ চীনের আর্থিক প্যাকেজ নিয়েই বেঁচে আছে। তাই চীনের পাশে দাঁড়ানোর মতো রাষ্ট্রের অভাব নেই।
গত ২০ বছর ধরে আমেরিকান ফোর্স লড়াই করেছে তালিবান ও আল কায়েদার সঙ্গে। আর চীন নিশ্চিন্তে আফগানিস্তানের পাকিস্তান লাগোয়া জনপদগুলিতে নিজেদের লগ্নি, তেলের পাইপলাইন বসিয়েছে। পূর্বতন আফগান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে চীন সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ কোন কন্ট্রাক্ট নিয়েছে? সিকিউরিটি প্রদান করার। চীন বিপুলভাবে প্রাইভেট সিকিউরিটি প্রক্রিয়ায় বিগত ৮ বছর ধরে লগ্নি করেছে। তেল শোধনাগার, ইস্পাত প্ল্যান্ট, প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজের উৎপাদন কেন্দ্র ইত্যাদি স্ট্র্যাটেজিক যে স্টানগুলি আছে, সেখানে বিশ্বের বহু দেশে চীনের প্রাইভেট সিকিউরিটি কাজ করছে। এইসব স্থানকে পাহারা দেওয়া, নিরাপত্তার খুঁটিনাটি কিংবা কীভাবে প্রতিরোধ করা হবে কোনও অন্তর্ঘাত, এই বিষয়গুলি নিয়েই চীনের প্রাইভেট সিকিউরিটি কোর্স হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এই সেক্টরে চীন ক্রমেই সেরা প্রাইভেট সিকিউরিটি প্রদানকারী দেশে পরিণত হচ্ছে।
মিলিটারিতে প্রবল শক্তি, আর্থিকভাবে বিভিন্ন দেশকে মৈত্রীবন্ধনে বেঁধে ফেলেছে চীন। তাহলে কি আমেরিকার পরাজয় স্রেফ সময়ের অপেক্ষা? একেবারেই নয়। আমেরিকার সবথেকে বৃহৎ শক্তি টেকনোলজি। চীন অর্থ ও মিলিটারির শক্তিতে আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু এখনও বিশ্বজোড়া প্রযুক্তি যুদ্ধে আমেরিকাই সেরা। ২০০৭ সাল আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বাঁক। ঘটনাচক্রে এই বছরে একঝাঁক কোম্পানির নতুন করে নিজেদের বদলে ফেলায় একটি মহাযাত্রার সূত্রপাত হয়েছিল। কোম্পানিগুলি হল, ইউটিউব, আমাজন, ট্যুইটার, ফেসবুক এবং অ্যাপল! এদের বড় দাদা হিসেবে আগে থেকেই রয়েছে অসীম ক্ষমতাধর দুটি নাম। গুগল এবং মাইক্রোসফট। আজ গোটা বিশ্ববাসীর মনের, জীবনের, বাণিজ্যের, সম্পর্কের এবং জীবিকার চালিকাশক্তি এই সাত আমেরিকান কোম্পানি! এগুলো ছাড়া আধুনিক পৃথিবীবাসীর চলবে একটিও দিন?
চীন অথবা আমেরিকা? অলক্ষ্যে চলছে এক মরণপণ প্রতিযোগিতা! কে হবে আগামী সুপার পাওয়ার? ঠিক এই সময়ে রাশিয়া প্রাণপণে চাইছে একটি দেশকে চীনের কাছে নিয়ে আসতে। আবার আমেরিকা চাইছে সেই দেশটি যেন তাদের শিবিরেই থাকে। কেন? কারণ, এই চীন ও আমেরিকার সুপার পাওয়ার হওয়ার যুদ্ধে ওই দেশটির ভূমিকাই হতে পারে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। কোন দেশ? ভারত! ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ এবং অসংখ্য গুরুত্বহীন ইস্যুকে পরিত্যাগ করে ভারত সরকার কি পারবে এই আন্তর্জাতিক মহারণে বুদ্ধিমানের মতো কোনও স্ট্র্যাটেজি নিতে?