সবার উপর সত্য ক্ষমতার দম্ভ
শান্তনু দত্তগুপ্ত
সেপ্টেম্বর ১১। এই তারিখটাকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সন্ত্রাসের দিন হিসেবে মনে রাখতে চান না। তিনি বলেন, এই দিনেই তো স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোর মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশ্বজয় করেছিলেন। বলেছিলেন ঐক্যের কথা, ভারতের বৈচিত্র্যের কথা, সংস্কৃতির কথা। বলায় তাঁর এতটুকুও ভুল নেই। কিন্তু খটকা এখানেও আছে। তিনি যা বলেন, তাই কি করেন? স্বামী বিবেকানন্দ আজও প্রাসঙ্গিক। আগামী ১০০ বছর পরও থাকবেন। নরেন্দ্রনাথ দত্তর ভাবনা, বিশ্বাস বা কর্মকে প্রাসঙ্গিক বা সময়োপযোগী করে তোলার জন্য নতুন কোনও নরেন্দ্রভাইয়ের প্রয়োজন নেই। মানুষ বরং আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বাণীবর্ষণে জর্জরিত হয়, আর বসে দাঁড়িপাল্লা নিয়ে। এক একটা ভোট, এক একটা ঘটনা (দুর্ঘটনা) বা একের পর এক সিদ্ধান্ত... আদৌ কি স্বামীজির আদর্শের সঙ্গে খাপ খায়? এক কথায় উত্তর, না খায় না। তেমনটা হলে মিনিটে মিনিটে প্রধানমন্ত্রীকে ‘সাফল্যে’র ঢাক পেটাতে হতো না। ক্ষমতা দখল এবং টিকে থাকার যে রকমারি চাল হয়, আপামর জনসাধারণ সে সবও জানতে পারতেন না। তাই তিনি ভোটের আগে বাংলায় আসেন (বছরের অন্য সময় রাজ্যে আসা বা এখানকার হাল হকিকত সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় তাঁর নেই)। ‘দিদি ও দিদি’ বলে ব্যঙ্গ করেন, আর হেরে দিল্লি ফিরে যান। কারণ, ততদিনে এই রাজ্য বা রাজ্যবাসীর প্রতি তাঁর প্রদেয় প্রতিশ্রুতির অন্তর্জলি যাত্রা হয়েছে। তিনি বারাণসীর সাংসদ। কিন্তু কালেভদ্রে তাঁকে সেখানে দেখা যায়। এমন গেরো, সেখানকার মানুষ নিরুদ্দেশ সম্পর্কে পোস্টারও ছাপতে পারেন না! টিভিতে আর বিজ্ঞাপনে যে তাঁদের এমপি সবসময় বিদ্যমান! গত বছর মে মাসের ৭ তারিখ গুজরাতের একটি পোর্টালের সম্পাদক লেখেন, ‘খুব শিগগিরই মুখ্যমন্ত্রী বদলে যাচ্ছেন। সরিয়ে দেওয়া হবে বিজয় রুপানিকে। কারণ, কোভিড মোকাবিলায় তিনি ব্যর্থ। অমিত শাহ বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেছেন। এমনকী গুজরাতের রাজ্যসভার সদস্য মনসুখ মাণ্ডব্যকে দিল্লিতেও ডেকে পাঠানো হয়েছে। উচ্চপর্যায়ের দলীয় বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে, রুপানিকে সামনে রেখে পরবর্তী বিধানসভা ভোটে বিজেপি যাবে না।’ মারাত্মক অপরাধ করেছিলেন সম্পাদক ধবল প্যাটেল। তাই তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় দেশদ্রোহের অভিযোগ এবং তাঁর ঠিকানা হয় জেল। শুধু তাই নয়, ‘রাষ্ট্র’ তাঁর বিরুদ্ধে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনেও মামলা করে।
ধবল প্যাটেল কি খুব ভুল লিখেছিলেন? সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম বলছে, একেবারেই না। করোনা মহামারী এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ইস্যু। সরকারকে নড়বড়ে করে দিয়েছে এই রোগ। উত্তরপ্রদেশের ভোট আগে। তারপরই গুজরাত। যোগীরাজ্যে নদীর চরে মৃতদেহের সার... কিংবা গঙ্গায় ভাসতে থাকা লাশ এমনিতেই কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে রেখেছে বিজেপি সরকারকে। গুজরাতে গঙ্গা নেই, তাই মৃতদেহ বয়ে যাওয়ার অপশনও নেই। কিন্তু মোদিজির রাজ্যের মানুষ কি কোভিড মোকাবিলায় খুশি? একেবারেই না। তার উপর রয়েছে প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব। সেই নয়ের দশক থেকে প্যাটেল সম্প্রদায়ের ২০ শতাংশ ভোট বিজেপিকে ক্ষমতার স্বাদ পাইয়েছে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়েছে, কিন্তু প্যাটেল ভোটের বিশ্বাসে এতটুকু ফাটল ধরেনি। তাই আনন্দীবেন প্যাটেলের ‘অপসারণে’র পর যখন প্যাটেল বা পাটীদার সম্প্রদায়ের বাইরের নেতা রুপানিকে মুখ্যমন্ত্রী করা হল, অনেকেই চোখ কুঁচকেছিলেন। কারণ তাঁরা জানতেন, নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ পুরোপুরি ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। যেখানে ক্ষীর, সেখানেই বাটি হাতে যুগল। এই ‘অন্য বার্তা’ তাই তাঁদের রাজনীতির আদর্শের সঙ্গে মোটেও খাপ খায়নি। পোড়া ঘায়ে বার্নল লাগাতে নীতিন প্যাটেলকে উপ-মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত করে দেওয়া হল। তাতেও ক্ষত খুব একটা শুকোয়নি। গুজরাতে সরকারের নিয়ন্ত্রক হবে প্যাটেল-পাটীদার। যত দিন গিয়েছে, ততই জোরালো হয়েছে এই সমীকরণ। মোদিবাহিনীর একটাই লক্ষ্য—এই ভোটের ভাগ হবে না। অথচ, গত বিধানসভা ভোট থেকেই প্যাটেল ভোট ভাগ হচ্ছে। সৌজন্যে কংগ্রেসের হার্দিক প্যাটেল। খাবি খাওয়ার মতো অবস্থাতেও সমানে সমানে টক্কর সেবার বিজেপিকে দিয়েছিল কংগ্রেস। ফল? ২০১৭ বিধানসভা নির্বাচনে গুজরাতে বিজেপির আসন সংখ্যা ছিল ৯৯টি। ১৮২টি আসনের মধ্যে। ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলা কংগ্রেস পেয়েছিল ৭৭টি আসন। পাঁচ বছরে কংগ্রেস আরও ভালোভাবে ঘর গুছিয়েছে। মোদি-শাহ বুঝেছেন, প্যাটেল অঙ্ক ছাড়া কিছুতেই এবার আর গুজরাত ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তাই অজানা-অচেনা পাটীদার মুখ আমদানি করলেন তাঁরা। ভূপেন্দ্র প্যাটেল। প্রথমবার বিধায়ক। তাতেই মুখ্যমন্ত্রী! তিনি নিজেও এতটা ভাবেননি। কিন্তু ভূপেন্দ্রভাই বুঝতে পারছেন না, এই পরিবর্তনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ নন। জরুরি ভোটের অঙ্কটা... যা অমিত শাহ খুব ভালো কষেন। জগৎপ্রকাশ নাড্ডা বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি হতে পারেন, কলকাঠি এখনও অমিত শাহেরই হাতে। বৈচিত্র্য, ঐক্য সব বকওয়াস। ভোটটা নিশ্চিত হচ্ছে কি? ক্ষমতা থাকছে কি? এই প্রশ্নগুলো অনেক বেশি এখন প্রাসঙ্গিক বিজেপির কাছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ কোন নেতা বা নেত্রী তাঁদের বেশি ইয়েস ম্যান। জো হুজুরি না পারলে বিজেপিতে যোগ্যতার মাপকাঠি ছোঁয়া যায় না। এই অপরাধের সাজা তখন একটাই—পরিবর্তন। লাগসই মন্তব্যটি করেছিলেন গুজরাতে বিজেপির সেই সাংগঠনিক নেতা—‘আমরা তো সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পরি। কিন্তু তা বলে কি নতুন জামা পরব না? নতুন জামা পরব, আর তখন পুরনো সেই ভালো জামাও ফেলে দেব। তাই না? মানুষ পরিবর্তন পছন্দ করেন... বুঝলেন?’ অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের কাছে রাজ্য বিজেপির নেতা-নেত্রীরা পুরনো জামাকাপড়ের বেশি নন। যতদিন ভালো লাগছে, লোকে বাহবা দিচ্ছে... গায়ে চড়িয়ে রাখছেন। আর অন্যথা হলেই তার গন্তব্য, সোজা আস্তাকুঁড়। এখন যেমন বিজয় রুপানির হয়েছে।
তাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে চর্চিত প্রশ্ন হল, বিজয় রুপানি কি পদত্যাগ করলেন? নাকি তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হল! গুজরাতের সদ্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলবেন না। কিন্তু তাঁর একটি মন্তব্য যা বোঝার সবটাই বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দল যা সিদ্ধান্ত নেবে, সেই কাজই আমি করব।’ অর্থাৎ মর্মার্থ স্পষ্ট, দিল্লির কর্তাব্যক্তিরা তাঁকে সরে যেতে বলেছেন। আর সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন তিনি। রুপানি পদত্যাগ করছেন, আর উল্লাসে ঝকমক করছেন তাঁরই দলের একাংশ। বৈচিত্র্যই বটে। কিন্তু তাতে ঐক্যের লেশমাত্র নেই। নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ এই সত্যটি যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই তাঁদের পক্ষে মঙ্গল। তবে এখন আর বুঝেও খুব একটা কিছু হবে বলে মনে হয় না। রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ্বের জল গলা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। কোথাও দু’টো, আবার কোথাও খান চারেক গোষ্ঠী। তাদের প্রচুর ক্ষোভ। সেইসবে মলম না লাগিয়ে বিজেপির হর্তাকর্তা বিধাতারা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আর কিছু সিদ্ধান্ত... যা তলে তলে ক্ষোভের আঁচ বাড়িয়ে চলেছে। উন্নয়ন, সংস্কার... সংখ্যাগরিষ্ঠতার দম্ভে অনেক কৌশলই মানুষের উপর চাপানো হয়েছে গত সাত বছরে। কিন্তু সবটাই কাঁচকলায় পর্যবসিত হয়েছে। অগত্যা উপায় এবং ব্রহ্মাস্ত্র একটাই—হিন্দুত্ব। কিছু রগরগে প্রচার, কিছু টেনশন আর খানিকটা দেশাত্মবোধ। মারাত্মক সুস্বাদু চাটনি বিশেষ। এই দিয়েই তো এত বছর ভোটারদের আপ্যায়ন চালিয়ে এসেছেন। আরও কয়েক বছর চালিয়ে যাওয়াই যাবে। কিন্তু একটাই অনুরোধ, দয়া করে স্বামীজিকে বারবার এই সমীকরণের মধ্যে টেনে আনবেন না। শিকাগো বক্তৃতায় তাঁর ডালিতে হিন্দুধর্ম সাজানো ছিল ঠিকই... কিন্তু তাতে না ছিল ঘৃণার লেশ, না ছিল সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি। তিনি বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করিয়ে রাখিয়াছে। ইহারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়াছে, বারবার ইহাকে নরশোণিতে সিক্ত করিয়াছে, সভ্যতা ধ্বংস করিয়াছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করিয়াছে।’ দাদামশাই একবার মন দিয়ে লাইনগুলো পড়ে দেখবেন... এখনও দেশের নানা প্রান্তে এই শব্দগুলো প্রাসঙ্গিক। এখনও ধর্মের বেশে মোহ এবং উন্মত্ততা ঘিরে ধরে ভারতকে। এখনও মানুষের বিচার হয় মেথর, মুচি, দলিতে। এখনও ধবল প্যাটেলের মতো সাংবাদিককে মুচলেকা দিতে হয়, ‘আর কখনও এমন কিছু লিখব না’। তাঁকে নিঃশব্দে ছাড়তে হয় দেশ। ওটাই শর্ত ছিল এফআইআর তুলে নেওয়ার। রাষ্ট্র যে বড়ই শক্তিশালী। এই জমানায় মানুষের জন্য রাষ্ট্র নয়... রাষ্ট্রের প্রয়োজনে মানুষ। আর সেই রাষ্ট্রের মসনদে এখন ‘সর্বশক্তিমান’ এক ব্যক্তি। সবার উপর সত্য তাঁর ক্ষমতার দম্ভ।
14th September, 2021