দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
মিশ্র তথ্য
র্যাঙ্কের দিক থেকে ভারতের অবস্থান মোটামুটি মাঝামাঝি জায়গায়। ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে পিছিয়ে পড়েও ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার জন্য সামাজিক ক্ষেত্রে মানুষের গাছাড়া ভাবকে দায়ী করা চলে। মৃতের সংখ্যাটাকে অন্যায়ভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। ভ্যাকসিনের জোগান ও বণ্টনে ব্যর্থতার কারণে ‘সকল পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের টিকাকরণ’ কর্মসূচি গোড়ার দিকের মাসগুলোতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধীরগতির ছিল। গরিব মানুষকে সহায়তার প্রশ্নে সরকারের তরফে ছিল নির্দয় অবহেলা। তবে গত তিনসপ্তাহে টিকাকরণে কিছুটা গতি এসেছে বলে মনে হয়।
এই ফলাফলগুলো সংখ্যা অথবা টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায়। চর্মচক্ষে দেখা যায় না এমনকিছু পতনও হয়েছে। যেসব পতন নজরে কম এসেছে সেগুলোকে আমি ‘মহাবিপর্যয়’ বলব। আমাদের স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রসঙ্গটা আনছি। যেসব শহুরে পরিবারের ছোট ছেলেমেয়ে আছে, তারা বুঝেছে ছোটদের ঘরের চৌহদ্দিতে আটকে রাখা কত বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে, গ্রামীণ পরিবারগুলো, মাস কয়েক পরে আর আগল রাখতে পারেনি, বাচ্চাদের স্থানীয় রাস্তাঘাটে এবং মাঠে-ময়দানে ঘুরে বেড়াবার অনুমতি দিয়েছে। অসুস্থতার কবলে পড়ার ভয় পেয়েছে সব পরিবার। ভয়ের প্রথম দফা তারা কাটিয়ে উঠেছিল কিন্তু ছেলেমেয়েদের স্কুলে না-যাওয়ার ব্যাপারটা তাদের ভাবায়নি। পড়ুয়াদের স্কুলে অনুপস্থিতি একসময় কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসে গড়িয়ে গেল। তারপর মাসের হিসেব পেরিয়ে সমস্যাটা একসময় পূর্ণ করল একটা বছর। স্কুলে অনুপস্থিতির বাধ্যবাধকতা অবশেষে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ল। এবার আতঙ্কই গ্রাস করল পরিবারগুলোকে।
বিরাট মূল্য চোকানো হল
সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারে ভয়ানক ভীতি অথবা শিক্ষার অভাবটা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। দেড় বছর যাবৎ স্কুল বন্ধ রাখার কারণে দেশকে যে বিরাট মূল্য চোকাতে হয়েছে তার সপক্ষে তথ্য রয়েছে। ২০২০ সালে করোনার প্রথম ঢেউ চলাকালে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার হাল কী হয়েছিল তা রিপোর্ট [দি অ্যানুয়াল স্টেটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট (রুরাল) ২০২০ ওয়েভ ১] আকারে ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ সালের এএসইআর রিপোর্টে গ্রামাঞ্চলের শিশুদের শিক্ষায় ঘাটতির যে দিক উন্মোচিত হয়েছিল ২০২১-এর রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছে সেই প্রসঙ্গটি। লকডাউনে স্কুল বন্ধের প্রভাব তাদের উপর আরও কী মারাত্মক হয়েছে নতুন রিপোর্টে রয়েছে তার অনুসন্ধানী পর্যবেক্ষণ। পিতামাতার শিক্ষাস্তর, পরিবারের হাতে স্মার্ট ফোন থাকা কিংবা না-থাকা, পড়ুয়াদের পাঠ্যবই ও লার্নিং মেটেরিয়ালের লভ্যতা প্রভৃতির ভিত্তিতে তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তারপর রিপোর্ট নীচের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে:
১. সার্বিকভাবে, মাত্র ৩৫ শতাংশ শিশু জানিয়েছে যে তারা স্কুল থেকে যেকোনও একরকমের লার্নিং মেটেরিয়াল পাচ্ছে।
২. আর ওই লার্নিং মেটেরিয়ালের ৭২ শতাংশ তারা পেয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ মারফত। এই শিশুদের বেশিরভাগই (৫৫ শতাংশ) তুলনামূলক গরিব পরিবারের এবং তাদের কোনও স্মার্ট ফোন নেই। সুতরাং স্কুল থেকে যে লার্নিং মেটেরিয়ালই বিতরণ করা হোক তা ভীষণ সীমিত সংখ্যক পড়ুয়ার কাছে পৌঁছচ্ছে।
৩. স্কুলশিক্ষার এই ক্ষতি সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটা সমীক্ষাতেও আলোকপাত করা হয়েছে। তারা বলেছে, সাতমাস স্কুল বন্ধের কারণে ছেলেমেয়েদের মোটামুটি একবছরের স্কুলশক্ষিার জলাঞ্জলি হয়েছে।
৪. স্কুল বন্ধের পরিণামটা পিছিয়ে-পড়া পরিবারের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার পক্ষে এক বিরাট ক্ষতি। সম্পন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েদের থেকে তারা এমনিতেই পিছিয়ে ছিল। দুই শ্রেণির মধ্যেকার পুরনো তফাতটা এবার আরও বেড়ে যাবে।
৫. সমস্ত পড়ুয়ার জন্য কিছু প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, স্কুল যখনই খুলুক।
প্রতিবিধানমূলক শিক্ষা
স্কুলশিক্ষায় অগ্রণী রাজ্যগুলোর একটা হল কর্ণাটক। এই রাজ্যের ২৪টা গ্রামীণ জেলার শিশুদের বুনিয়াদি শিক্ষার কী হাল (ফাউন্ডেশনাল স্কিলস) হয়েছে তার উপর একটা সমীক্ষা করা হয়েছে। বুনিয়াদি শিক্ষা বলতে বই পড়া এবং অঙ্ককষার (পাটিগণিত) ক্ষমতা যাচাই করা হয়েছে। কর্ণাটকের মতো রাজ্য থেকেও যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তাতে মন খারাপ হয়ে যায়:
১. গত ২০১৮ সালে ছেলেমেয়েদের ফাউন্ডেশনাল স্কিলস যতটা ছিল ২০২০ সালে তা কার্যত ধসে গিয়েছে।
২. গত ২০১৮ সালে পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই পড়তে পারত। সংখ্যাটা ২০২০ সালে ৩৩.৬ হয়ে গিয়েছে। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের শিক্ষার মান অনুরূপভাবেই যাচাই করা হয়েছে।
৩. গত ২০১৮ সালে পঞ্চম শ্রেণির ৩৪.৫ শতাংশ পড়ুয়া বিয়োগ এবং ২০.৫ শতাংশ ভাগ অঙ্ক কষতে পারত। ২০২০-তে ওই দুটো সংখ্যা যথাক্রমে ৩২.১ এবং ১২.১-এ নেমে এসেছে। বৃহত্তর ক্ষেত্রে অবনমনের এই ছবিটা প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একইরকম পাওয়া গিয়েছে।
১৫টা রাজ্যের ১৩৬২টা পরিবারকে নিয়ে আর একটা সমীক্ষা করা হয়েছে। কো-অর্ডিনেটর জিন ড্রেজের এই সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, গ্রাম ভারতের মাত্র ৮ শতাংশ পড়ুয়া অনলাইন শিক্ষার পাঠ নিতে পেরেছে এবং অন্তত ৩৭ শতাংশ ছেলেমেয়ে পড়াশোনার পাঠ পুরোপুরি চুকিয়ে দিয়েছে।
হাসপাতালে বেড, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স, কবর বা শ্মশানঘাটের জায়গা, ভ্যাকসিন প্রভৃতি কতটা পাওয়া গিয়েছে না-গিয়েছে তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। এসব কাজ আরও বেশি করার জন্য আদালতগুলো সরকারগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। অনেক সরকারকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে এবং তারা বাস্তবে অনেকটা করেছেও। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, বাচ্চাদের শিক্ষার এই যে বিপুল ক্ষতি হয়ে গেল এবং এর প্রতিবিধানের প্রয়োজন—তা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক এবং পদক্ষেপ করা হল না।
এই মুহূর্তের সঙ্কটমোচনের কথা বিস্মৃত হয়ে সরকার ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচারের সূচনা করেছে। উদ্দেশ্য কী? শিক্ষায় বৈষম্য দূরীকরণ। দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা এবং যুবসমাজের ভবিষ্যৎ, প্রধানমন্ত্রী চান, বিশ্ব প্রতিযোগিতার উপযোগী করে গড়ে তুলতে। কোনও সন্দেহ নেই, লক্ষ্যটা গর্ব করার মতোই এবং উদ্দেশ্যও মহৎ। কিন্তু আমাদের সর্বপ্রথম বাচ্চাদের সেইভাবে তৈরি করা উচিত নয় কি যে, তারা পাঠ্যবই পড়বে এবং যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের অঙ্কগুলো কষতে পারবে?
আমাদের এই মুহূর্তে প্রয়োজন প্রতিবিধানমূলক শিক্ষা। স্কুলে শিক্ষকদের আরও বেশি সময় দিতে হবে, সেইমতো তাঁদের উৎসাহ দেওয়া দরকার। বাচ্চাদের পড়াশোনার যে বিরাট ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার মতো সাহায্য তাদের করতে হবে। প্রতিটা বাচ্চার জন্য যথাযথ স্কুলশিক্ষা নিশ্চিত করার খরচ আহামরি নয়। প্রধানমন্ত্রী ভূরিভোজের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার জন্য অপেক্ষা করা যেতে পারে। সবার পাতে প্রথমে রুটি, ভাত এবং সব্জিটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত