পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
নতুন সমবায় মন্ত্রক তৈরির লক্ষ্য হিসাবে কেন্দ্রের তরফে বলা হয়েছে এমনই কথা। অর্থাৎ, গ্রামে যে মহাজনী শোষণ চলে তার থেকে মুক্তি দিয়ে সেখানে সমৃদ্ধির জোয়ার বইয়ে দিতে চায় এই মন্ত্রক। এও বলা হয়েছে, মন্ত্রক সমবায় চালানোর জন্য আলাদা প্রশাসনিক কাঠামো, আইন ও নীতি গ্রহণ করবে। তার লক্ষ্য হবে সমবায় আন্দোলনকে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দেওয়া। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মতো সেই পুরানো ‘সহজ ব্যবসার পথ করবে’ সমবায়। সত্যিই কি তাই? নাকি এর পিছনে রয়েছে কোনও রাজনীতি? কাজ যদি সমবায়েরই হয়, তাহলে মন্ত্রকের নাম সমন্বয় রাখা হল কেন? নতুন মন্ত্রকের দায়িত্ব খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে কেন?
বিরোধীদের দাবি শুনছে কে?
প্রশ্ন উঠছে, আগামী লোকসভা ভোটের আগে মোদি কেন দেশের সমবায় সংস্থা ও ব্যাঙ্কগুলি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন? বিরোধীদের দাবি, মোদি সরকার নয়া কৃষি আইন জারি করে যে কর্পোরেটদের হাতে কৃষিক্ষেত্র তুলে দেওয়ার পথ সুগম করেছে, সেই কর্পোরেটের হাতেই সমবায়ের অর্থ তুলে দেওয়ার ছক কষছে। যদিও নয়া কৃষি আইনের জেরে গ্রাম ভারতে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে বিজেপি। বিচ্ছিন্নতা কাটাতে তাই দেশের সমস্ত সমবায়ের দখল নিয়ে গ্রাম ভারতে সমর্থন বাড়ানোর একটা কৌশল নিচ্ছে বিজেপি।
দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে সমবায়ের প্রভাব অপরিসীম। বিভিন্ন রাজ্যে সমবায় ব্যাঙ্কের কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণ বিলির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে ঋণসহায়তায় উল্লেখযোগ্য সমবায়। রাজ্যে এই মুহূর্তে রয়েছে ৬ হাজার প্রাথমিক কৃষি সমবায় সমিতি। সেই সমবায় সমিতির ৪০ শতাংশ রাজ্যে কৃষি ঋণ বিলির কাজ করে চলেছে। সমবায় প্রসারে অগ্রণী পাঞ্জাবও। সেই রাজ্যে প্রাথমিক কৃষি সমবায় সমিতির সংখ্যা হবে সাড়ে ৩ হাজার। এছাড়া রয়েছে ৫ হাজার সমবায় দুগ্ধ ফেডারেশন। সমবায়ে এগিয়ে থাকা রাজ্য মহারাষ্ট্রও। প্রাথমিক কৃষি সমবায় ও দুগ্ধ সমবায়ের সংখ্যা ২০০। রয়েছে চিনি কলের বড় ২০০টি সমবায়। উত্তরপ্রদেশে সমবায়ের সংখ্যা ২৫ হাজার ৯০৭টি। পড়শি রাজ্য বিহারে সমবায়ের প্রসার ঘটেছে। কর্ণাটক, গুজরাত, তামিলনাড়ু, কেরল সহ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও সমবায়ের অগ্রগতি লক্ষণীয়। সবমিলিয়ে বছরে দেশে ২০ লক্ষ কোটি টাকার উপর ঋণ লেনদেন করে থাকে এই সমবায়গুলি। এই বিপুল অর্থের উপর কেন্দ্রের কোনও প্রভাব থাকবে না? মোদি তা মানবেন কেন? অতএব, নতুন মন্ত্রক, নয়া মন্ত্রী। অথচ, সংবিধানের ৭ তফসিল অনুসারে এতদিন সমবায় ছিল রাজ্য সরকারের অধীনস্ত বিষয়।
সমবায়ের শক্তি চিনিয়েছিল ‘আমুল’
গ্রামীণ ভারতে সমবায়ের প্রভাব নরেন্দ্র মোদি টের পেয়েছিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই। সেই গল্পের শুরুটা অবশ্য ১৯৪৯ সালে। ভার্গিজ কুরিয়েনের হাত ধরেই গুজরাতের আনন্দ জেলায় জন্ম নিয়েছিল একটা বিপ্লব। এ দেশের গ্রামীণ সমবায় শিল্পোদ্যোগের ইতিহাসকে ‘আমুল’-এর বদলে দেওয়ার বিপ্লব। যার দৌলতে গুজরাতের গ্রামে ৩২ লক্ষ মানুষ আর্থিক ভাবে স্বয়ম্ভর, যার দৌলতে ভারত বিশ্বের পয়লা নম্বর দুধ উৎপাদক দেশ। আমুল মানে পৃথিবীর বৃহত্তম দুগ্ধ সমবায়। আমুল পরিচালনা করে গুজরাত কো-অপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন লিমিটেড। যার অংশীদার গুজরাতের ৩৬ লক্ষ দুধ উৎপাদক। গুজরাতের ১৩ হাজার গ্রামে বিস্তৃত ১৩টি জেলার মিল্ক ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা। তাঁরাই এখন ঠিক করেন গুজরাতের গ্রাম কার হাতে থাকবে।
গুজরাতের গ্রামাঞ্চলে দুধ উৎপাদন দীর্ঘদিনেরই রেওয়াজ। তৈরি হয়েছিল কাইরা জেলা দুধ উৎপাদক ইউনিয়ন। ১৯৪৯ সালে ওই সংস্থায় যোগ দেন কুরিয়েন। তারপর শুধুই সমৃদ্ধির ইতিহাস।
শুরু হয়েছিল মাত্র দু’টি গ্রাম নিয়ে, দিনে ২৪৭ লিটার দুধ আসত তখন। ১৯৫৫ সালের মধ্যে এলাকা যেমন বাড়ল, তেমনই বাড়ল দুধের পরিমাণ। দৈনিক ২০ হাজার লিটার। গোরুর দুধে আটকে না থেকে মোষের দুধকে কাজে লাগানোর পথিকৃৎ কুরিয়েনের সমবায়ই। শ্বেত বিপ্লব, অপারেশন ফ্লাড, ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, গুজরাত কোঅপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন... কুরিয়েনের কর্মযজ্ঞ আরও যত ধাপই পেরোক না কেন, শুরুটা ওই তিনটি বর্ণে— ‘আমুল’।
১৯৭৩ সালে গড়ে উঠেছিল গুজরাত কোঅপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন। আনন্দ জেলার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে গোটা গুজরাতের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিল ‘আমুল’। কুরিয়েন বিশ্বাস করতেন, উন্নয়নের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, উন্নয়নের হাতিয়ারকে মানুষের হাতে তুলে দেওয়া। জীবনের শেষ অঙ্কে নিজের হাতে গড়া কর্মীদের চাপেই নিজের হাতে গড়া সমবায় থেকে সরতে বাধ্য হয়েছিলেন যদিও। কিন্তু কুরিয়েন তাঁর ভাবনা বদলাননি। সেই ভাবনা বলত, ‘আমি ক্ষমতায়নের ব্যবসা করি, দুধ তার উপাদান মাত্র।’ তাঁর সেই ভাবনায় ভর করে ‘ব্যবসা’ করছে বিজেপি। তফাৎ শুধু একটাই, কুরিয়েন চেয়েছিলেন উন্নয়নকেন্দ্রিক ক্ষমতায়ন। বিজেপির হাতে তা হয়ে উঠেছে রাজনীতির ক্ষমতায়ন। আর সেটা করতে গিয়ে কুরিয়েন সমবায় পরিচালনায় যে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র ধারা গড়েছিলেন, তা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে বিজেপি।
নব্বইয়ের দশকে গুজরাতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত নষ্ট হতে শুরু করে আমুল সহ গুজরাতের সমস্ত জেলার দুগ্ধ সমবায়গুলির স্বতন্ত্রতা। মুখ্যমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে বাড়তি গতি পায় দুগ্ধ সমবায়গুলির গৈরিকীকরণ। তা নিয়ে কুরিয়ানের সঙ্গে মোদির তিক্ততা এমন পর্যায়ে যায় যে, ২০১২ সালে ভার্গিজ কুরিয়ানের মৃত্যুর দিনে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকলেও শেষ শ্রদ্ধাটুকু জানাতে আসার ভদ্রতা দেখাননি নরেন্দ্র মোদি।
বর্তমানে গুজরাতের ১৮টি জেলার প্রতিটির দুগ্ধ সমবায়গুলি বিজেপির দখলে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, গুজরাতের বিজেপির দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রাখার পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে জেলা দুগ্ধ সমবায়গুলির উপরে বিজেপির দখলদারি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে জেলা দুগ্ধ সমবায়গুলির প্রভাব প্রায় ১ কোটি ভোটারের উপর। আসলে আমুল হয়ে উঠেছে বিজেপির গুজরাতের ভোট প্রক্রিয়ার রসায়নাগার। কে না জানে, গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমুলের দুধের দাম কমানো বা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এবং সেই বাড়তি আয় থেকে প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারের খরচ বহন করার প্র্যাকটিস বিজেপির ইউএসপি। নোট বাতিলের সময়, দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাতিল ৫০০ কিংবা ১০০০ টাকার নোট জমা পড়েছিল যে সমবায় ব্যাঙ্কে সেই ব্যাঙ্কটির নাম আমেদাবাদ জেলা সমবায় ব্যাঙ্ক, অধিকর্তা অমিত শাহ। আবার অমিত শাহের পুত্র জয় শাহের কোম্পানির অ্যাকাউন্টে স্রেফ একটা চিঠির ভিত্তিতে ২৫ কোটি টাকার খণ দিয়েছিল যে ব্যাঙ্ক সেটাও গুজরাতের কালুপুর কমার্শিয়াল সমবায় ব্যাঙ্ক। মোদি-অমিত শাহরা জানেন, গুজরাতের মতো গোটা দেশের সমবায় ক্ষেত্র হাতের মুঠোয় থাকা মানে মৌরসি পাট্টা। বিজেপিরও পোয়াবারো।
সমবায় মানেই গ্রামীণ ভারতের ভোট
এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ার, অজিত পাওয়ারের উত্থান সমবায় আন্দোলন থেকে। এনসিপি নেতাদের বক্তব্য, শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোট সরকারের আগে বিজেপির দেবেন্দ্র ফড়নবিশ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। তখনও এনসিপি, কংগ্রেসের হাতে সমবায়ের লাগাম থেকেছে। বিজেপি সেখানেই হস্তক্ষেপ চাইছে বলে বিরোধীদের আশঙ্কা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করে কেন্দ্রের নতুন গড়া সমবায় মন্ত্রক নিয়ে তাঁর আপত্তির কথা জানিয়ে দিয়েছেন শারদ পাওয়ার। সমবায় মন্ত্রকের বিরোধিতা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বিরোধীরা বলছেন, গুজরাতে কংগ্রেসের হাতে থাকা সমবায় সংস্থাগুলি একে একে দখল করেই নিজেদের রাজনৈতিক শিকড় ছড়িয়েছিল বিজেপি। সেই কৌশলেই এগতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি।
জার্মানি ও ব্রিটেনেও সমবায়ে তাক লাগানো বিকাশ হয়েছিল গত শতাব্দীর গোড়ার দিকেই। নাৎসি ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেই খোঁজ পাবেন, হিটলারও ক্ষমতায় আসার পর জার্মানির সমবায়গুলিকে রাজনৈতিকভাবে দখল করেছিলেন। অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, ইউরোপের প্রতিটি জায়গায় সমবায়গুলিকে খর্ব করা বা সেগুলি দখল করার ক্ষেত্রেও হিটলার ও নাৎসি পার্টির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের সেই পথেই অমিত শাহ এখন দেশের সমস্ত সমবায় ব্যাঙ্কের হর্তাকর্তা। তিনিই ব্যাঙ্কের সর্বসময়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিয়োগ করবেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সার্কুলার অনুসারে, প্রত্যেক সমবায় ব্যাঙ্ক একজন পেশাগত দক্ষ একজিকিউটিভ ডিরেক্টর নিয়োগ করবে। এই নিয়োগের অনুমোদন দেবে কেন্দ্রীয় সরকার, অর্থাৎ অমিত শাহ। আর এর অর্থ, পশ্চিমবঙ্গে সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে একজিকিউটিভ ডিরেক্টর কে নিযুক্ত হবেন সেটার সুপারিশ করবেন স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব। এক্ষেত্রে দলের সুপারিশের ব্যক্তিকেই যে অমিত শাহ নিয়োগ করবেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে বাইপাস করে, গুজরাত মডেলে আমুলের মতো দেশের সমবায়গুলির
উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ চাইছে মোদি সরকার। যার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন চাইছে গেরুয়াবাহিনী। আসলে মোদি সরকারের সমবায় মন্ত্রক তৈরির সিদ্ধান্ত বিজেপির স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের নয়া বিচ্ছুরণ ছাড়া কিছু নয়!