পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
মন্তব্যটিতে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মোটামুটি জিআই স্বীকৃতি আদায় করে ফেলেছেন। বেকায়দায় পড়লেই ক্রোনোলজি টানেন তিনি, সময়ের কাহিনি শোনান। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং প্রতিবাদের ঝড়ঝাপ্টার মধ্যে ঠান্ডা গলায় এই কথাটিই বলেছিলেন তিনি। সময়? বছর দুয়েক আগে... লোকসভা ভোটের ঠিক মুখে। আবার তিনি একই মন্তব্য বাজারে ছেড়েছেন। কারণ, কয়েকটি ঘটনাক্রম। ১) পেগাসাস: ফোনে আড়ি পাতা কাণ্ডে গোটা দেশ এখন উত্তাল। পেগাসাস স্পাইওয়্যার খায় না মাথায় দেয়, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তা বোঝে না। কিন্তু এই প্রযুক্তি গুঁজে দিয়ে একজন নাগরিকের স্বাধীন সত্ত্বার যে দফারফা হয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে আমাদের বিলক্ষণ বোধ হয়েছে। অমিত শাহ বলছেন, সংসদের বাদল অধিবেশনের ঠিক আগে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগটি ডিম পেড়েছে। অর্থাৎ, ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়। ২) রাকেশ আস্থানা: জোর চর্চা ছিল, রাকেশ আস্থানা সিবিআইয়ের প্রধান হয়ে জাঁকিয়ে বসবেন। কেন? কারণ, তিনি গুজরাতের আইপিএস এবং নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের ‘জো হুজুর’ অফিসার। কিন্তু সেটা হল না। সিবিআইয়ের মতো এজেন্সির মাথায় বসার জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল তাঁর ছ’মাসের চাকরির মেয়াদ। তারপরই যে অবসর! তাই ক্ষতিপূরণ বাবদ দিল্লির পুলিস কমিশনারের পোস্টিং। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে উড়িয়ে দিয়ে। না হলে এক্ষেত্রেও তো ছ’মাসের হিসেবটা কাজ করত! এক বছরের এক্সটেনশন দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হল তাঁকে। এবং ৩) সংসদের বাদল অধিবেশন: বাংলায় স্বপ্নভঙ্গের পর বিজেপি বাস্তবিকই বেশ অস্বস্তিতে। মোদি জাঁহাপনার জনপ্রিয়তা কি শেষ?—এই হাওয়াই এখন চতুর্দিকে। সুযোগ বিরোধীরা নেবে এবং নিচ্ছে। প্রতি পদক্ষেপে চেপে ধরা হচ্ছে সরকারকে। তাদের অপদার্থতা নিয়ে চোখা চোখা শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ, সরকার বেকায়দায়। এক কথায়, সময়টা বড্ড খারাপ। অমিত শাহ এবেলায় ক্রোনোলজির প্রশ্ন যে তুলবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক!
কিন্তু মহামান্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুলে যাচ্ছেন, ঘটনা পরম্পরা আরও আছে। যারা জন্ম নিচ্ছে এবং দেশের নানা প্রান্তের ‘গোকুলে’ বেড়ে উঠছে। মন্ত্রী মহাশয়, আপনি কি অসম-মিজোরামে আপনার ব্যর্থতা অস্বীকার করতে পারেন? সমস্যাটা দীর্ঘকালীন, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। লুসাই হিলস... এটাই ছিল মিজোরামের এক সময়ের পরিচিতি। ১৯৭২ সালে এই অংশটিই আলাদা হয়ে যায় অসম থেকে। প্রথমে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, আর তারপর ১৯৮৭ সালে পৃথক রাজ্য মিজোরাম। ১৬৪ কিমি দীর্ঘ সীমানা এই দুই রাজ্যের। সেই সঙ্গে দু’পক্ষের সংঘর্ষ। শুধু জনজাতি নয়, এই হিংসার শরিক দুই রাজ্যের পুলিসও। ফল? প্রাণহানি। সবচেয়ে বড় কথা, এই দুই রাজ্যেই বিজেপির শাসন। সোজা কথায় ডবল ইঞ্জিন। তারপরও এতটুকু সমন্বয় নেই! আইন-শৃঙ্খলার এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি? আর আপনারা কি না বাংলা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন! প্রতিনিধি দল পাঠান, তারা শুধু বিজেপির ঘরে ঘরে যায়, তারপর বাংলার বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেয়। ভালো খেলা বটে! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গণতন্ত্রের ‘খেলা হবে’র পক্ষে সওয়াল করেন। আর আপনারা দুরমুশ করেন গণতন্ত্রকে। এই খেলায় আপনাদের অস্ত্র বিভাজনের রাজনীতি, ধর্ম-জাতপাত, পেটোয়া লোককে রেফারির আসনে বসিয়ে আগাপাশতলা ‘খেলাটা’ নিয়ন্ত্রণে রাখা। অমিত শাহ মহাশয় নাকি অসম এবং মিজোরামের দুই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। হুঁশিয়ার করেছেন, আলোচনার মাধ্যমে সব সামলে নাও। নাহলে সমূহ বিপদ। ঠিকই বলেছেন, আসন্ন বিপদ যত না উত্তর-পূর্বের দুই রাজ্যের, তার থেকে অনেক বেশি আপনাদের মসনদের। মোদি-শাহের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ আগামী দিনগুলো। বাইশ সালে ছ’টি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। তার জন্য রাজধানীতে কর্তৃত্ব কায়েম রাখা খুব জরুরি। দিল্লিতে আম আদমি পার্টির রাজ চললেও পুলিসের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। ওটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সুতোয় ঝুলছে। এটাই আস্তিনের গোপন তাস। গোপন, আবার ওপেন সিক্রেটও বটে। যা করার এই পুলিসকে দিয়েই করতে হবে। এমনিতেই গত দু’-তিন বছর ধরে দিল্লি পুলিসের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে। দাঙ্গা পরিস্থিতি, জামিয়া মিলিয়া ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গণ্ডগোল, ছাত্রছাত্রীদের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের সঙ্গে পরিচয় করানো... একেবারে সোনায় মোড়া ‘সন্ত্রাস’। পুলিসে দিল্লিবাসীর ভরসা আর হবে কী করে? তাই ‘গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব’ সঁপে দিল্লি পুলিসের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা করে দেওয়া হল রাকেশ আস্থানাকে। জন্ম নিল নতুন বিতর্ক। গোধরা কাণ্ডে বিশ্বাসভাজন, আমেদাবাদ বিস্ফোরণ কাণ্ড, সুশান্ত সিং রাজপুতের মামলায় অতি সক্রিয়তা... চাকরির প্রতিটা বছর তিনি নিজেকে নতুন করে ‘প্রমাণ’ করেছেন। তিনি পুরস্কার না পেলে আর কে পাবেন? আর কেন ‘ইনাম’? এর নেপথ্যেও যে বড় অঙ্ক! মোদি বিরোধী জোট বাস্তবায়িত হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেই দিয়েছেন, ‘এবার থেকে দু’মাস অন্তর দিল্লি আসব। বিজেপিকে হারাবে মহাজোটই।’ কংগ্রেসও ইগো ত্যাগ করে আসরে। অখিলেশ বা তেজস্বী, প্রত্যেকেরই এখন একটাই এজেন্ডা—মোদিমুক্ত ভারত। বিরোধীদের চারণক্ষেত্র দিল্লিতে তাই এমন কাউকে চাই, যাঁর চোখ, কান এবং নাক সমানে চলবে। কোথাও বিজেপি বিরোধী কিছু হলেই গন্ধ পাবেন তিনি। বুঝবেন নরেন্দ্র মোদির পালস, অমিত শাহের ইঙ্গিত।
নরেন্দ্র মোদি মুখ... আর চালিকাশক্তি অমিত শাহ। সেই গুজরাত শাসনের জমানা থেকে। আমাদের দেশের অধুনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় গুণ, তাঁর হিমশীতল মাথা। বিতর্ক যেমনই হোক, হাসিমুখে তার জবাব দিয়ে থাকেন তিনি। আর সেইসব উত্তর (অজুহাতও পড়তে পারেন) তাঁর ঠোঁটের ডগায় থাকে। তাই তিনি নরেন্দ্র মোদির চাণক্য... ম্যানেজ মাস্টার। কিন্তু বাণীবর্ষণে তো প্রশাসন চলে না! নিজের পছন্দসই, পেটোয়া লোকজনকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালেও নয়। তাতে শুধু পুতুল নাচ হয়। আপনি মশাই যেমন যেমন দড়ি টানবেন, তেমন তেমন পুতুল নাচবে। অবশ্য আপনাদের কাছে সরকার চালানো মানে ওই পুতুল নাচানোর থেকে বেশি কিছু নয়। তাই রাকেশ আস্থানাদের মতো আধিকারকরা আপনাদের পছন্দের। অশোক লাভাসারা নন। কারণ, তাঁরা কোনও ব্যক্তি বা সরকারের আগেও গুরুত্ব দেন দেশের সংবিধানকে। তাঁরা ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং ধরে রাখার সমীকরণকে ঘেন্না করেন। কিন্তু অমিত শাহ এই খেলা চালিয়ে যান। কারণ, এই একটি খেলা ওলিম্পিকসে থাকলে তিনি অবশ্যই সোনা পেতেন। গুজরাতের সরখেজ ছিল তাঁর রাজনৈতিক ক্ষেত্র। এই কেন্দ্রে লড়াই করেই তিনি প্রথমবার বিধায়ক হয়েছিলেন। প্রথমবার এবং তারপর বারবার। প্রতিদ্বন্দ্বীকে গোড়াতেই ‘ফিনিশ’ করে দিতেন তিনি। ঠিক যেমন করেছিলেন কংগ্রেসের শশীকান্ত প্যাটেলকে। সালটা ছিল ২০০৭। তখন তিনি গুজরাতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বুঝেছিলেন, শশীকান্ত তাঁর পথের কাঁটা হতে পারেন। তাই ভোটের ঠিক আগেভাগে খুলে গেল কংগ্রেসের এই প্রতিদ্বন্দ্বীর যাবতীয় পুরনো কেস। অমিত শাহ সুযোগ দেবেন না। এটাই তাঁর বিশেষত্ব। সেই একই ধারা তিনি এখনও বজায় রেখেছেন। পরপর দু’টি লোকসভা নির্বাচন এবং একের পর এক রাজ্যের বিধানসভা ভোটে। ব্রহ্মাস্ত্র? সেই বিভাজন।
রাজদীপ সারদেশাইয়ের একটা লেখা পড়েছিলাম। গুজরাতের সাংবাদিক রাজীব শাহের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন তিনি। গোধরা কাণ্ডের ঠিক পরের কথা। গান্ধীনগরে মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বেরনোর সময় মুখোমুখি হয়েছিলেন অমিত শাহের। বিলক্ষণ চিনতেন তিনি এই সাংবাদিককে। রাজীব শাহ রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘সরখেজ কেন্দ্রে আপনি সব সম্প্রদায়ের মাথাদের নিয়ে বসছেন না কেন? আপনি বসলেই তো সাম্প্রদায়িক সমস্যাগুলো মিটে যায়!’ অমিত শাহের উত্তর ছিল আশ্চর্যজনক—‘দাঙ্গা নিয়ে আপনার এত চিন্তা কীসের?’ রাজীব স্বীকার করেছিলেন, ওই বিধানসভা কেন্দ্রে তাঁর বাড়ি। অমিত শাহের পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, ‘কোন এলাকায়?’ উত্তর শোনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসবাণী, ‘চিন্তা নেই, আপনার বাড়ির কিছু হবে না। যা হবে, হিন্দু এলাকার সীমানার ওদিকে।’ এই হলেন জনপ্রতিনিধি। প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে তিনি হিন্দু-মুসলমান বিভেদের পক্ষে সায় দেন। তাই এর বেশি তাঁর থেকে আর কিছু আশা করা যায় কি?
কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন না, উল্টো ক্রোনোলজি শুরু হয়ে গিয়েছে। একের পর এক ব্যর্থতার থেকে দানা বাঁধছে বিক্ষোভ, চাপা প্রতিবাদ। আপনি বরং এখন থেকেই ঘটনাক্রম সাজানো শুরু করে দিন। অসম-মিজোরামের হিংসা ওই সীমানাতেই শেষ হয়ে যাবে না। আড়ি পেতে গণতন্ত্রের হত্যার বিচারও হবে একদিন। নরেন্দ্র মোদি এখন আপনাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেন। এর নেপথ্যে শোনা যায় একটি ঘটনা...। সোহরাবুদ্দিন খুনের ঘটনার পর জেলে ছিলেন অমিত শাহ। বারবার তাঁর উপর সিবিআই চাপ দিয়েছিল... খোঁজার চেষ্টা করেছিল গোটা ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর ‘যোগে’র চিহ্ন। অমিত শাহ মুখ খোলেননি। সেই কৃতজ্ঞতা মোদিজির আছে। এখনও। কিন্তু ঘটনা পরম্পরা উল্টোপথে হাঁটলে এই বিশ্বাস, কৃতজ্ঞতা থাকবে তো? ক্ষমতার অলিন্দে বিচরণ যে ভয়ানক নেশা! এই নেশা জলাঞ্জলি দেওয়া যায় না। মোদিজি নিশ্চয়ই অনুভব করছেন... কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে... উল্টো। অমিতজি এবার আপনার ক্রোনোলজি বোঝার সময়... ২০২৪ সাল পর্যন্ত।