পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
আর আজ এই একুশ সালের আগস্ট মাসে এসে সরকার কী করছে? আবার সেই বৃহৎ বেসরকারি পুঁজির হাতেই ঘটা করে ব্যাঙ্ক, এলআইসিকে তুলে দেওয়ার আইন আনছে। এ ছাড়া ব্যাঙ্ক চাঙ্গা করার নাকি আর কোনও পথ নেই। যাঁরা টাকা মেরে বসে আছেন তাঁদের হাতেই এবার গোটা প্রতিষ্ঠান, আমার আপনার কষ্টার্জিত অর্থের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার কী সুবিশাল আয়োজন!
এই মহতী উদ্যোগ চলছে ফোনে আড়ি পাতা নিয়ে যখন দেশ উত্তাল, পেগাসাসে সংসদের অধিবেশন অচল ঠিক তখন। মুলতুবির পর মুলতুবি, কিন্তু নতুন আইন প্রণয়নের বিরাম নেই। সবমিলিয়ে ১৭টি বিল পাশ করতেই হবে। নিঃশব্দে পাশ হয়ে চলেছে এমন সব বিল যা আম জনতার ঘুম ছুটিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সংসদের চলতি অধিবেশন চলবে আর মেরে কেটে দু’সপ্তাহ। তার মধ্যেই পাশ হয়ে যাচ্ছে দু’টি এমন আইন যা সাধারণ মধ্যবিত্তের সারা জীবনের সঞ্চিত টাকার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার বদলে বিপন্নই করে তুলবে। দুটি আইন। প্রথমটি ডিপোজিট ইনসিওরেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গ্যারান্টি কর্পোরেশন (ডিআইসিজিসি) সংশোধনী বিল আর দ্বিতীয়টি জেনারেল ইনসিওরেন্স বিজনেস বিল। দু’টি বিলেরই তাৎপর্য বিরাট। এরই সঙ্গে আসছে ব্যাঙ্কিং আইন সংশোধনী বিল। তিনটি আইনই সাধারণের পক্ষে এক একটা মারণাস্ত্রই বটে। বিশেষত শেষ বয়সে যাঁরা সঞ্চিত অর্থের উপর নির্ভর করে সংসার চালাতে চান তাঁদের কাছে তো বটেই। এমনিতেই সুদ কমতে কমতে পাঁচ শতাংশের সামান্য বেশি। তার উপর যদি আসলটাই মার চলে যায় তাহলে আমাদের মতো দেশে যেখানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রায় নেই বললেই চলে তাঁদের করুণ অবস্থাটা সহজেই অনুমান করা যায়।
গত কয়েক মাসে ব্যাঙ্ক লাটে ওঠার বেশ কয়েকটি নজির আমরা দেখেছি। যার ফলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে লেনদেনে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা (মরেটোরিয়াম) পর্যন্ত ঘোষণা করতে হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ইয়েস ব্যাঙ্ক, লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক ও পাঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক। লাটে ওঠা ব্যাঙ্কে আপনার যত টাকাই থাকুক আপনি আইনগত ভাবে পাঁচ লক্ষ টাকার বেশি সুরক্ষা পাবেন না। এতদিন বিমায় সুরক্ষিত ছিল মাত্র ১ লাখ টাকা। মোদি সরকার পরিমাণটা বাড়িয়েছে। এর অর্থ কী? আপনার যতই টাকা ব্যাঙ্কে থাকুক না কেন, আইন বদলে মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকারই সুরক্ষা দিচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তার বেশি নয়। এখন সাড়ে পাঁচ শতাংশ সুদে ৫ লাখ টাকার মাসিক সুদ কত? পুরো আড়াই হাজার টাকাও হবে না। ওই টাকায় বৃদ্ধ দম্পতির সুগার, প্রেশারের ওষুধ, ডাক্তারের ফি, দুবেলা ডাল ভাত খাওয়া ও সব আনুষঙ্গিক খরচ চলবে? চলতে পারে! সরকারের পাল্টা ব্যাখ্যাটাও বড় অদ্ভুত। তামাম সমীক্ষা চালিয়ে নাকি দেখা গিয়েছে, এ দেশে ৯৮ শতাংশ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ৫ লাখ টাকার বেশি গচ্ছিতই থাকে না। তাই ৫ লক্ষ টাকাকেই এ ক্ষেত্রে বেঞ্চ মার্ক ধরা হয়েছে। সেই কারণেই এমন আইন! তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? আপনার টাকার উপর শুধু ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্তই বিমার সুরক্ষা দিচ্ছে সরকার বাহাদুর, তার বেশি নয়। তাও সঙ্গে সঙ্গে নয়, মিলবে ৯০ দিনে। বলা বাহুল্য, সুদও মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশের আশপাশে। তাহলে আপনি পেট চালাতে এই অবস্থায় কী করবেন? ঘুরিয়ে সরকারই কি আপনাকে চিট ফান্ডের দিকে হাঁটতে প্রলুব্ধ করছে না? সরকারের পাল্টা বক্তব্য, আগে ব্যাঙ্ক লাটে উঠলে মাত্র ১ লক্ষ টাকা পেতেও দশ বছর লেগে যেত। সরকার তা ৯০ দিনে দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে, এটাই বা কম কী, তাই তালি বাজাও। আর বলো মোদি সরকারের জয়!
এখানেই শেষ নয়। ব্যাঙ্ক ও বিমার বেসরকারিকরণের কাজ জোরকদমে এগিয়ে নিয়ে যেতে আসছে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ আইন। জেনারেল ইনসিওরেন্স বিজনেস সংশোধনী ২০২১ ও ব্যাঙ্কিং আইন সংশোধনী ২০২১ বিল দুটি। এর ফলে ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণই শুধু প্রশস্তই হবে না, বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনাও বহুগুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ঢালাও বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশের সঙ্গেই আসবে একরাশ অনিশ্চয়তা। ব্যাঙ্কে চাকরির ক্ষেত্রে তা যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি আমানতকারী বা ডিপোজিটরদের ক্ষেত্রেও। টাকা রেখেও আপনি বুক বাজিয়ে বলতে পারবেন না আপনার ব্যাঙ্কে বিশ লাখ টাকা আছে। কারণ নয়া আইনে মাত্র ৫ লাখের উপরই বিমার সুরক্ষা দিচ্ছে সরকার। তেমনি ধীরে ধীরে ব্যাঙ্ক শিল্প যেদিকে যাচ্ছে তাতে একজন কর্মীর অবসর পর্যন্ত চাকরিও আর কতটা নিরাপদ, সেই প্রশ্নও উঠবেই। এককথায় আর পাঁচটা বেসরকারি চাকরির মতো অশোক স্তম্ভের নিরাপত্তার বেষ্টনীটাও ক্রমেই খসে পড়ছে। যেমন খসে পড়ছে রেল, বিএসএনএল সহ অধিকাংশ সরকারি সংস্থায়। এমনকী একের পর এক নবরত্ন তেল কোম্পানি বিক্রির ব্লুপ্রিন্টও তৈরি। এয়ার ইন্ডিয়া, কোল ইন্ডিয়া, বার্ন ব্রেথওয়েট জেসপের কথা না হয় বাদই দিলাম।
আকাশে বাতাসে রটে গিয়েছে একটাই বার্তা, গুজরাতি অস্মিতার প্রতীক নরেন্দ্র মোদি ব্যবসাটা ভালোই বোঝেন। তাই ঢালাও সরকারি সংস্থার শেয়ার বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা মুনাফার দিকে ঝুঁকছেন তিনি। আপাতত চলতি আর্থিক বছরেই সরকারের টার্গেট প্রায় পৌনে দু’লক্ষ কোটি টাকা। এই তালিকায় সেন্ট্রাল ও ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক যেমন আছে তেমনই আছে দেশবাসীর আশ্রয়স্থল এলআইসিও। শোনা যাচ্ছে, লাভজনক তেল সংস্থা ভারত পেট্রলিয়ামকেও দ্রুত বিক্রির পথে হাঁটতে চলেছে সরকার। অথচ পেট্রল ডিজেল থেকে শুল্ক বাবদ খুব অল্পদিনে অতিরিক্ত প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা আয় করছে সরকার। এবং যা হওয়ার তা আগামী লোকসভা ভোটের আগেই হবে। অর্থাৎ ক্রমেই সঙ্কুচিত হবে সরকারি চাকরির ক্ষেত্র। থাকবে না কোনও নিরাপত্তা। আর আপনি যে কষ্টে অর্জিত অর্থ ব্যাঙ্কে রেখে সুদের টাকায় কোনও রকমে ভাত ডালটা খাবেন, তাও এক থাপ্পড়ে কেড়ে নেবে ব্যবসা লাটে ওঠার নাম করে। তাহলে আপনি মানে মধ্যবিত্ত দিন আনা দিন খাওয়া হতশ্রী মানুষ কোথায় যাবেন?
আসলে এই অনিশ্চিয়তাটাই গ্রাস করছে দেশবাসীকে। তাঁরা কেউ ভোটে দাঁড়াবেন না। প্রধানমন্ত্রী কিংবা নিদেনপক্ষে কোনও দপ্তরের ফাইল না যাওয়া রাষ্ট্রমন্ত্রীও হবেন না। কেউ তোলা তুলতে পারবেন না। কিন্তু সৎ পথে চলেও তাঁরা এই নয়া ব্যবস্থায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর ক্রীড়নকে পরিণত হবেন। এই সব মানুষের ছোট ছোট পুঁজি নিয়েই বৃহৎ কর্পোরেটরা মুনাফা ঘরে তুলবে। আবার পরিস্থিতি বেগতিক দেখলেই গণেশ উল্টে দেবে। আর আইন তো রইলই। আপনি মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ তো ৫ লাখের বেশি দাবি করতে পারবেন না। তাই অনিশ্চয়তার গর্ভে হারিয়ে যাওয়াই আপাতত আমার আপনার ভবিতব্য। দেশকে এক সাধারণ ঘরের গুজরাতির এটাই দান। কৃষক রাস্তায়, শ্রমিক বিপন্ন, ব্যাঙ্ক, রেল, এলআইসির কর্মচারীরা পর্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত, এর অপর নামই তো আচ্ছে দিন! কালো টাকা ধরা পড়বে না, গরিবি আর দারিদ্রের নাগপাশে আরও বন্দি হয়ে যাবে আম জনতা!