কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
উত্তরাধিকার সূত্রে ‘অধিকার’ বর্তালেও ‘সম্মান’ অর্জন করতে হয়। আর তা আসে যে কোনও মানুষের ধারাবাহিক লড়াই ও সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে। যাঁর লড়াই যত কঠিন, তাঁর সম্মান তত বেশি। আপোসহীন মমতার লড়াই, সংগ্রাম এবং লক্ষ্যে পৌঁছনোর অদম্য ইচ্ছা, তাঁকে এনে দিয়েছে সেই সম্মান। বাংলার নির্বাচনে মমতা শুধু বিজেপিকেই হারাননি, হারিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে। মোদি-অমিত শাহ জুটিকে এভাবে ঘোল খাওয়াতে আর কেউ পারেননি। তাই জাতীয় রাজনীতিতে মমতাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে গগনচুম্বি প্রত্যাশা।
এরাজ্যেও এমনটাই হয়েছিল বাম জমানায়। প্রতিবাদী মমতাকে দেখে রাজ্যের মানুষের মনে জেগেছিল প্রত্যাশা। তাঁর লাগাতার লড়াই, আন্দোলন বুঝিয়ে দিয়েছিল, তিনি ‘সেটিং পলিটিক্সে’ বিশ্বাসী নন। তাই মানুষও তাঁকে বিশ্বাস করেছিল। বলাই বাহুল্য, মানুষের সেই বিশ্বাসের মর্যাদা তিনি দিয়েছেন।
টার্গেট স্থির করে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই মমতার বৈশিষ্ট্য। লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত লড়াই তাঁর চলতেই থাকে। আর লক্ষ্য পূরণের জন্য তিনি লড়াইটা শুরু করেন একেবারে ‘গ্রাউন্ড জিরো’ থেকে। তাই মাটির সঙ্গে সম্পর্ক বড় নিবিড়। লক্ষ্য পূরণের আশায় কখনও নতুন দল গড়েছেন, আবার কখনও ছেড়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব। ঝুঁকি নিয়েছেন, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি। ঝুঁকি নেওয়ায় প্রমাণ এক আধবার নয়, মিলেছে বহুবার। ফলও পেয়েছেন। তাই গণিখান চৌধুরী, প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সোমেন মিত্রের মতো রাজনৈতিক পণ্ডিত এবং বাঘা বাঘা নেতা যা পারেননি, তিনি সেটাই করে দেখিয়েছেন। ‘বাংলা’ ও ‘বাম’ সমার্থক হয়ে ওঠা বঙ্গে তিনি শুধু সিপিএমকে উৎখাতই করেননি, ‘হাঁড়ির হাল’ করে ছেড়েছেন। একের পর এক অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ অগ্নিকন্যার এবার টার্গেট, নরেন্দ্র মোদি।
লড়াইটা কঠিন। সেটা খুব ভালো করেই জানেন বহু রাজনৈতিক যুদ্ধের সফলতম অধিনায়িকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই অনেক আগেই শুরু করেছেন হোমওয়ার্ক। কারণ ভালো ফলের একমাত্র শর্ত বছরভর পড়াশোনা। সেই জন্যই বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে সকলকে এককাট্টা করার সলতে পাকানোর কাজটা আড়াই বছর আগেই শুরু করে দিয়েছেন।
একথা ঠিক, বাংলার নির্বাচনে বিপুল সাফল্য পাওয়ার পরই তৃণমূল সুপ্রিমো মোদি-বিরোধী অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু, মোদি-বিরোধিতায় তিনি অন্যদের ছাপিয়ে গিয়েছেন অনেক আগেই। জিএসটি থেকে নোট বাতিল, এনআরসি থেকে বেসরকারিকরণ, এমনকী ভ্যাকসিন ইস্যুতে তিনিই সর্বপ্রথম মোদির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মানেই সিবিআই, ইডির রোষের মুখে পড়তে হবে, তা জেনেও তিনি পিছু হটেননি। এমনকী, অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা যখন উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে প্রলয় থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন, তখন মমতা প্রতিবাদ করেছেন রাস্তায় নেমে।
নোট বাতিলের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জুটেছে ‘কালো টাকার পাহারাদারের’ বদনাম। তালে তাল না মেলানোয় উম-পুন, যশের ক্ষতিপূরণের বরাদ্দ ক্রমশ হয়েছে সঙ্কুচিত। তবুও মমতা লড়াইয়ের ময়দান ছাড়েননি। পেগাসাস ইস্যুতে তদন্ত কমিশন গড়ে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিধানসভা ভোটে জিতে গেলেই বেশিরভাগ মুখ্যমন্ত্রীকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু মমতা থাকেন লড়াইয়ের ময়দানে।
এ কি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ, নাকি পিছনে রয়েছে কোনও সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা, সেটা একমাত্র নেত্রীর পক্ষেই বলা সম্ভব। তবে, মোদি-অমিত শাহের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস দেখানোয় মমতা হয়ে উঠেছেন জাতীয় রাজনীতির চর্চিত চরিত্র। বাংলার নির্বাচনকে ‘প্রেস্টিজ ফাইটে’র জায়গায় নিয়ে যাওয়ায় নরেন্দ্র মোদিই নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছেন। বাংলায় বিজেপির ভরাডুবির পর থেকেই দেশের মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন, মমতাই পারবেন। বাইরে কুস্তি, ভিতরে দোস্তির লাইনের তিনি ঘোরতর বিরোধী। তাই মমতা যতই বলুন, ‘আমি লিডার নই, ক্যাডার’ প্রধানমন্ত্রীর মুখ হিসেবে তাঁর নামটা এসেই যাবে।
লোকসভায় সদস্য সংখ্যার হিসেব দিয়ে অনেকে এই ভাবনা হাস্যকর প্রমাণের চেষ্টা করবেন। কিন্তু, তাতে তেমন সুবিধে হবে না। কারণ ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুর সামনে যখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল তখন বামেদের আসন সংখ্যা প্রধান দুই দলের অনেক নীচেই ছিল। তবুও তিনিই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদের এক নম্বর পছন্দ। তাই সব সময় ধারে কাটে এমন ভাবনাটা ঠিক নয়। কখনও কখনও ভারেও কাটে। আর বিজেপির দিল্লির নেতারা মমতার ওজনটা বাংলা ভোটে বুঝে গিয়েছেন। তাই ত্রিপুরায় এখন থেকে বাধা দিচ্ছে।
জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়াটা যে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ ছিল তা এখন সিপিএমের অনেকেই মানেন। ফের আরও একটি ভুলের কথা স্বীকার করেছে। পশ্চিমবঙ্গে শূন্য হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে সিপিএমের উপলব্ধি, তাদের ‘বিজেমূল’ থিওরি ভুল ছিল। আব্বাস সিদ্দিকির দলের সঙ্গে জোট করাও তাদের মস্ত ভুল। সিপিএম সেটা চেপে গিয়েছে।
সিপিএম নেতৃত্ব মুখে বিজেপিকে ‘প্রধান শত্রু’ বললেও, এরাজ্যে তারা সব সময় তৃণমূলকেই টার্গেট করে এসেছে। সেই কারণে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও সিপিএমের স্লোগান ছিল, ‘মোদি হটাও তৃণমূল তাড়াও’। সেটা তৃণমূল হটানোর নির্বাচন ছিল না। তা সত্ত্বেও মোদি-মমতাকে এক লাইনেই দাঁড় করিয়েছিল। সিপিএমের শূন্য অভিমুখে অভিযানের সেটাই ছিল শুরু। তখনই যদি তারা আত্মসমীক্ষা করত তাহলে এমন করুণ পরিণতি তাদের দেখতে হতো না।
বিজেপি বিরোধিতায় সিপিএমের লাইন ভুল ছিল। দলের একাংশ এটা বুঝলেও সুজন চক্রবর্তীর মতো কিছু নেতা তৃণমূলকে চিমটি কেটেই যাবেন। কারণ তাঁরা এখনও এরাজ্যে ক্ষমতা দখলের ‘দিবাস্বপ্ন’ দেখেন। তাই বিমান বসু যতই বলুন বিজেপিকে ঠেকাতে তাঁরা যে কোনও দলের হাত ধরতে রাজি, তৃণমূলের সঙ্গে তাঁদের সমঝোতা আপাতত ‘সোনার পাথরবাটি’।
কংগ্রেস হাইকমান্ডও বুঝতে পারছে, মমতাকে শায়েস্তা করতে গিয়ে সিপিএমের হাত ধরায় তাদের কোনও লাভ হয়নি। উল্টে ক্ষতিই হয়েছে। মমতা বিরোধিতা করতে গিয়ে কংগ্রেসও বঙ্গে শূন্য হয়ে গিয়েছে। তাই মমতাকে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন ভাবনা। সেই ভাবনায় বাধ সাধার কেউ নেই। কারণ কট্টর মমতা বিরোধী অধীর চৌধুরীও বুঝতে পারছেন, তৃণমূলের আর্শীবাদ ছাড়া মুর্শিদাবাদে জেতা অসম্ভব। তাই তাঁর মুখেও আর তেমন মমতা বিরোধী কথা শোনা যাচ্ছে না।
রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে ১৪ দলের বৈঠকে তৃণমূলের না থাকার বিষয়টিকে তিনি গুরুত্ব দেননি। রাহুলকে পাশে নিয়েই সোনিয়া মমতার সঙ্গে আলোচনা সেরেছেন। কারণ সোনিয়াও বুঝেছেন, মোদি-বিরোধী জোটের বৃত্ত যত বড়ই হোক না কেন, মমতা না থাকলে তা অসম্পূর্ণ থেকেই যাবে।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘সেল্ফ মেড ম্যান’। এঁরা নিজেরাই নিজেদের মেন্টর। কঠিন পরিস্থিতিতে বুক চিতিয়ে লড়াই করে জয় ছিনিয়ে আনায় এঁরা সিদ্ধহস্ত। অনিশ্চয়তা আর ধোঁয়াশার জাল ভেদ করে লক্ষ্যে পৌঁছনোর ক্ষমতা এঁদের মজ্জায়।
মমতা তাঁদেরই একজন। কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হওয়া আঞ্চলিক দলগুলিকে একছাতার নীচে আনা ভীষণ কঠিন কাজ। সম্ভবত এই কাজটা কুকুরের লেজ সোজা করার চেয়েও শক্ত। মমতা সেটাই করতে চাইছেন। হয়তো নেলসন ম্যান্ডেলার সেই বিখ্যাত উক্তিতেই তাঁর বিশ্বাস, ‘It always seems impossible until it’s done.’ অর্থাৎ যতক্ষণ না কোনও কাজ শেষ হচ্ছে ততক্ষণ তা অসম্ভব বলেই মনে হয়। আপাতত সেই অসম্ভবকে সম্ভব করাই মমতার লক্ষ্য।