কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
দুশানবে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জয়শঙ্কর। তিনি বুঝেছেন, আমেরিকা, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার তৈরি ‘কোয়াড’-এর পাল্টা আরও এক ‘কোয়াড’ আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে। চীন, পাকিস্তান, রাশিয়া ও ইরান। এই চতুর্ভুজের প্রথম দু’জন বহু বছর ভারতের মিত্রের তালিকায় নেই। শেষ দু’জন আমেরিকার জন্য ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে। তবে চীন ও রাশিয়া যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা ভারতের পক্ষে আপাতত স্বস্তির বার্তা। দুই দেশের প্রস্তাব, আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসী জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য হতে দেওয়া চলবে না। অন্তত দু’-তিন বছর তালিবান আফগান সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার চালাক। পাশাপাশি স্থায়ী মীমাংসার জন্য কথা বলুক। ইরানও তাতে সহমত। তিন দেশের মূল লক্ষ্য, তালিবানি হিংসা যেন সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশে না ঢোকে। তালিবান নেতাদের সেটাই বারবার বলা হচ্ছে। ভারতও চায়, আগামী দিনে সে দেশে ক্ষমতার অলিন্দে যারাই পদচারণ করুক, তারা যেন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা হাসিল করে, হিংসার মাধ্যমে নয়। তালিবান তা মানবে কি না, বলা কঠিন। না মানলে ভারতের চিন্তা ক্রমশ পরিণত হবে দুশ্চিন্তায়।
দুশ্চিন্তার প্রথমটা আফগানিস্তানে ভারতীয় স্বার্থরক্ষা নিয়ে, দ্বিতীয়টা অবশ্যই পাকিস্তান ও কাশ্মীর। গত কুড়ি বছরে আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশে ভারত চারশোরও বেশি প্রকল্প তৈরি করেছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ দেড় বিলিয়ন ডলার। ভারতীয় প্রকল্পের ক্ষতি তালিবানরা করবে না বলে মৌখিক আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু ভারত নিশ্চিত নয়। চীন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পে তালিবানকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে পুরোদমে। চীনের অভিযোগ, আমেরিকার সেনা সরানোর সিদ্ধান্তে আফগানিস্তানে নিরাপত্তাজনিত এক নতুন কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হয়েছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার, আফগান সেনাদের কোণঠাসা অবস্থা, তালিবানের অগ্রযাত্রা—এমন এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান নিয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ভিত্তিতে ও একত্রে কাজ করবে বলে ঘোষণা করেছে চীন ও পাকিস্তান। দুই দেশের বিদেশমন্ত্রীরা এ কথা জানিয়ে আঞ্চলিক যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ‘চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি)’ প্রতিষ্ঠারও প্রস্তাব দিয়েছেন। চীনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বেজিং ও ইসলামাবাদের মধ্যে জোরালো সহযোগিতার প্রয়োজন।
তালিবান উত্থান নিয়ে চীনের ভয় একটাই—সীমান্ত। চীন মনে করে, আফগানিস্তান অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে তার ধাক্কা জিনজিয়াং প্রদেশে গিয়েও লাগবে। যে প্রদেশে লাখ লাখ সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে বেজিংয়ের বিরুদ্ধে। তবে, এই সীমান্ত বিপদ রয়েছে রাশিয়া, পাকিস্তান, ভারতেরও। আফগানিস্তানে তালিবানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া, রাশিয়ানদের জন্য তাজিকিস্তান, ভারতের পক্ষে কাশ্মীর এবং অন্য অনেক দেশের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। প্রশ্ন উঠছে, ধর্মীয় আধার যে তালিবানে রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত, তারা কতটা আধুনিক হয়ে আজন্মলালিত বিশ্বাসের জলাঞ্জলি দেবে?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ভারতকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করার পাশাপাশি ঘোর আঞ্চলিক অনিশ্চয়তাও সৃষ্টি করেছে। উল্টোদিকে চীন-রাশিয়ার উল্লাসের কারণ, তাদের কাছে এটা আমেরিকার আরও একটা পরাজয়। আমেরিকার উসকানির কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটা সময় আফগানিস্তান থেকে দেশে ফিরতে হয়েছিল পরাজিতের তকমা কপালে সেঁটে। মস্কো সেটা ভোলেনি। আমেরিকারও আজ একই হাল। আমেরিকার পিছু হঠা চীনকেও খুশি করেছে। কারণ, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে রুখতে আমেরিকার চেষ্টার অন্ত নেই। আমেরিকার অসম্মান একইভাবে খুশি করেছে তাদের হাতে কোণঠাসা ইরানকেও। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সিদ্ধান্তে স্বস্তির শ্বাস নিচ্ছে পাকিস্তান, যারা মনে করে মার্কিন বাহিনীর পিছু হটা তাদের সামরিক জয় এবং আফগানিস্তানে তাদের উপস্থিতি নিষ্কণ্টক করবে। পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশির সদর্প ঘোষণা, পৃথিবীর কোনও শক্তিরই পাকিস্তানকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। চীন, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তান তাই যতটা উৎফুল্ল, ততটাই চিন্তায় ভারত। একদিকে আফগানিস্তানে স্বার্থরক্ষার তাগিদ, অন্যদিকে কাশ্মীরকে সুরক্ষিত করা, দুটোই বিরাট চ্যালেঞ্জ।
এই ভারত কিছুকাল আগেও জঙ্গি-চরিত্রে ভালো-মন্দের বিচারে অনিচ্ছুক ছিল। মনে করত জঙ্গিরা জঙ্গিই। ভালো বা খারাপ হতে পারে না। তালিবান সম্পর্কেও সেই কাঠিন্য ভারতের ছিল। জঙ্গিদের সংস্রব না-রাখার নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে ভারত এখন তালিবান তোয়াজে সচেষ্ট। কাতারের রাজধানী দোহায় তালিবানদের সঙ্গে দহরম মহরমের চেষ্টা মোটেই আর গোপন নয়। বিদেশমন্ত্রকের বিবৃতিতেও স্বীকার করা হয়েছে, ‘আফগানিস্তান পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ভারত সে-দেশের বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।’ স্বার্থরক্ষায় মোদি সরকার কতটা মরিয়া এবং আফগান সমস্যা ভারতকে কোন বিপদের মুখে দাঁড় করিয়েছে, এই বিবৃতি তার প্রমাণ। অথচ এই তালিবান জমানার একটা সময় পর্যন্ত পাকিস্তানের ‘প্রক্সি’ বলে ভারত মনে করত। আজ তাদের মন পাওয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত, জঙ্গিদের প্রতি ভারতের ‘দৃঢ় অবস্থান’ পরিস্থিতির বিচারে কতটা ঠুনকো! এখন যখন সবাই ক্রমশ নিশ্চিত যে, আফগান সরকারের পতন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা, ‘চিন্তিত’ ভারত তখন স্বার্থরক্ষায় উদগ্রীব। তিন বিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যে সে-দেশে লগ্নি হয়েছে। তা রক্ষা করা, ভারতীয় প্রকল্পগুলো চালু রাখা ও পাকিস্তানের প্রভাব রোখার চেষ্টায় ভারত এখন সেসব তালিবান গোষ্ঠীর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছে, যারা সেখানে পাকিস্তান ও ইরানের হস্তক্ষেপের বিরোধী। আফগানিস্তানে ভারতের ভালো-মন্দ নির্ভর করছে অন্যদের মর্জির উপর। ভারতের ভূমিকা স্রেফ দর্শকের।
তালিবানের সঙ্গে ভারতীয় কূটনীতিকদের ‘গোপন’ বৈঠকের কথা চাপা রাখার বহুচেষ্টা করেছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। পারেনি। ওয়াশিংটনের আরব সেন্টারে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে সে কথা ফাঁস করে দিয়েছেন কাতারের এক সিনিয়র কূটনীতিক মুতলক বিন মাজেদ অল কাহতানি। কিন্তু তালিবানের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে এতো লুকোচুরির কী আছে? আসলে, ভারতের আফগান-নীতি অনুযায়ী, নয়াদিল্লি বরাবরই আফগান প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছে। আফগান রাজনীতিতে কখনওই তালিবানের গুরুত্ব স্বীকার করেনি ভারত। সে ক্ষেত্রে এখন ভারতীয় কূটনীতিকরা তালিবানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করছেন, সে কথাই বা নয়াদিল্লি স্বীকার করে কী করে!
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. সঞ্জয় ভরদ্বাজের কথায়, অনেক দেশই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, কিন্তু অন্য যে কোনও দেশের চেয়ে আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি স্বার্থ এখন ভারতের। তালিবান আবার ক্ষমতায় বসলে ভারতের ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি। আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে ভারত গত দুই দশকে চার শতাধিক সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং বড় বড় পরিকাঠামো প্রকল্পে ৩০০ কোটি ডলারেও বেশি বিনিয়োগ করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ডজন ডজন প্রকল্প ছাড়াও, ২১৮ কিমি দীর্ঘ দিলারাম-জারাঞ্জ নামে গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক তৈরি করে দিয়েছে। কাবুলে নতুন আফগান পার্লামেন্ট ভবনটিও তৈরি করেছে ভারত। নির্মীয়মান শত শত প্রকল্পের এখন কী হবে? যে উদ্দেশ্যে এসব বিনিয়োগ, তার ভবিষ্যৎ কী? ভারতের নীতি-নির্ধারকরা এখন সেই চিন্তায় অস্থির। তাছাড়া মধ্য এশিয়ার বাজারে ঢুকতে ভারতের জন্য আফগানিস্তান খুবই জরুরি। সেই পথও কি আটকে যাবে?
কে না জানে, তালিবানের সঙ্গে বরাবর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক উপভোগ করে পাকিস্তান। আফগানিস্তানে দুই দশক ধরে যে তালিবানবিরোধী অভিযান চলেছে, তখন দলে দলে আফগান-তালিবানরা তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনসহ আশ্রয় পেয়েছিল পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে। আর ওটা যে ইসলামাবাদের চমৎকার এক কৌশলগত বিনিয়োগ ছিল সেটাই দেখা যাচ্ছে সম্প্রতি। এখনও পাকিস্তানে প্রায় ২৫ লাখ আফগান শরণার্থী আছে। তাদের অনেকেই খুব তাড়াতাড়ি স্বদেশে ফিরবে। তালিবান জঙ্গিরা চাইবে পাকিস্তানের সঙ্গে যতটা সম্ভব কাছাকাছি থেকে রাজনৈতিক সহযোগিতা বজায় রাখা। ভারতবিরোধী হাক্কানি গ্রুপের সঙ্গে এক ধরনের মিথোজীবী সম্পর্কে জড়াতে তালিবান জঙ্গিদের একটা বড় অংশের এখন আর কোনও বাধা নেই। এখানে আর আলাদা করে পাকিস্তানি আর্মি কিংবা আইএসআই-এর কথা না বললেও চলে।
আফগানিস্তানে এখনই যে ‘সম্ভাবনা’ দেখছে পাকিস্তান, তাতে এটা পরিষ্কার যে, ‘ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ চালাতে নানা ‘প্রক্সি’র সাহায্য নেবে। যে প্রক্সিগুলোর অনেকে এখনও জঙ্গি গোষ্ঠী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত হয়নি। আর এর ফাঁকতালেই নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠনের আবির্ভাব যে ঘটবে, সেটাও বা রুখবে কে! পাশাপাশি, আচমকা আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার প্রস্থানে ভারতের জন্য একটা বড় শিক্ষাও রয়েছে। বার্তাটা হল—অফিসিয়াল চুক্তি বা কূটনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে আমেরিকা তার মিত্রদের যত যাই বলুক না কেন, জাতীয় স্বার্থ রক্ষা কিংবা তার ভোটারদের তুষ্ট করার প্রশ্ন যখন আসে, তখন ওয়াশিংটন নিজের বন্ধুরাষ্ট্রকেও ছেড়ে যেতে দ্বিধা করে না। এমনকী তাদের বিপদের মুহূর্তেও! যার সর্বশেষ উদাহরণ আফগানিস্তান।
আর তাই তালিবানের নব উত্থান মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভাগ্য কীভাবে নির্ধারণ করবে, সেই অনিশ্চয়তার দুলুনিতে আজ দুলতে হচ্ছে মোদি সরকারকে।