পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
আমাদের মনের জানালা শিশুকাল থেকেই খুলে দেওয়ার জন্য এখনও এরকম প্রধানশিক্ষকরা আছেন কি না সেটা তর্কসাপেক্ষ! হয়তো আছেন। অথবা নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, আমরা নিজেরা ক্রমেই বহির্জগতের জানালা বন্ধ করে দেওয়ার দিকেই অগ্রসর হয়েছি। পারিপার্শ্বিকের বাইরে কী ঘটছে, সেটা আর আমরা জানতে চাই না। আমাদের আগ্রহ নেই। আমরা ক্রমেই মনে করছি, আমাদের চারপাশে যা ঘটছে অথবা এই রাজ্যের মধ্যেই যেটুকু চোখে পড়ছে, কানে আসছে, সেটাই পৃথিবী। অতএব আমরা সেই মনোভাবকেই পাথেয় করে মতামত দিচ্ছি, তর্ক করছি, প্রতিবাদ করছি। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই যে আমাদের ওই মতামত ও তর্কগুলো একপ্রকার সচেতনতার অভাব হিসেবেই পরিগণিত হচ্ছে, এটা বুঝতে পারছি না। এই প্রসঙ্গটি এল কেন?
মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়নি এবং যেখানে পরীক্ষাই হয়নি সেখানে আবার ফল কীসের? আর সর্বোপরি এ আবার কী আশ্চর্য কথা যে, একটি পরীক্ষায় ৭৯ জনই প্রথম স্থান পেয়েছে! এসব ছাত্রছাত্রীর এত আনন্দ করার কী আছে যে, পাশ করেছে কিংবা বেশি নম্বর পেয়েছে? এই মন্তব্যগুলি মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলপ্রকাশের পর প্রচুর পরিমাণে শোনা যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তো বটেই, আড্ডায়, আলোচনায় ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে হাসাহাসি করা হয়েছে। তাদের কটাক্ষ করা হয়েছে। রাজ্য সরকার ও বিদ্যালয় দপ্তরকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। এই নাগরিকেরা এরকম মন্তব্যগুলি কেন করেছেন? কারণ, ওই একটাই। মন ও জ্ঞানের জানালা বন্ধ। তাঁদের ধারণা, এই ব্যবস্থাটি শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারই বলবৎ করেছে এবং একমাত্র এই রাজ্যেই এরকম পরীক্ষা ছাড়াই ফলপ্রকাশ হচ্ছে। সকলকে পাশ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বহু ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে ফার্স্ট হচ্ছে। যা তাঁদের মতে অন্যায্য ও গর্হিত অপরাধ। তাঁরা যদি ইনফরমেশন আর নলেজের জানালাটি সামান্য খুলে রাখতেন, জানতে পারতেন, ভারতের অন্য রাজ্যগুলিতে এই একই সিস্টেম চলছে। বিদেশেও। কর্ণাটকে ৬০০ মার্কসের মধ্যে ৬০০ মার্কসই পেয়েছে ২২৩৯ জন ছাত্রছাত্রী। গুজরাতে সরকারিভাবে প্রথম থেকে একাদশ পর্যন্ত গণপাশ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। দ্বাদশের ফলপ্রকাশ হয়েছে। সকলেই পাশ। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা সর্বত্রই একই ব্যবস্থা। পরীক্ষা ছাড়াই কীভাবে এই ফলপ্রকাশ কিংবা মার্কস দেওয়া হল? সর্বত্র একই মূল্যায়ন। সিবিএসই পর্যন্ত এই মূল্যায়ন ঘোষণা করেছে। এসব কথা না জেনে আমাদের মধ্যে একশ্রেণির সহনাগরিকবৃন্দ প্রকাশ্যে গোটা ব্যবস্থাটি নিয়ে নিন্দা এবং বিদ্রুপ করে চলেছেন! জীবনের অমূল্য কিছু সময়কে হারিয়ে ফেলে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এই ছাত্রছাত্রীরা তাকিয়ে রইলেন, তাঁদের অসহায়তা সমালোচকরা উপলব্ধি করল না। উল্টে কটূক্তি করা হচ্ছে। কারণ কী? বুদ্ধি ও মেধার অভাব। যা বিবেচনা ও যুক্তি তৈরি করে। এঁদের যদি প্রশ্ন করা হয়, কী হতে পারতো বিকল্প? বলতে পারবেন?
স্কুল কেন খুলছে না? এটা হল, রাজনৈতিক চক্রান্ত। নতুন প্রজন্মকে পঙ্গু করে দেওয়ার এক প্রয়াস। এরকম সমালোচনাও উত্তরোত্তর বাড়ছে। হয়তো মনে করা হচ্ছে, এই প্রবণতা একমাত্র এই রাজ্যেই। কেন মনে হচ্ছে? কারণ, বাইরের জগতের কথা জানার আমাদের আগ্রহ নেই। অথচ ভারতের সর্বত্রই এই চিত্র। আইসিএমআর থেকে কেন্দ্রকে স্কুল খোলার পরামর্শ দেওয়ার পর ধীরে ধীরে কিছু কিছু রাজ্যে চেষ্টা চলছে ধাপে ধাপে স্কুল খোলার। অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার দ্বাদশ ক্লাসের জন্য পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট ২৪ জুন ধমক দিয়ে বলেছে, একজন ছাত্রছাত্রীরও যদি মৃত্যু হয় সম্পূর্ণ দায় আপনাদের নিতে হবে। পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রেই যেখানে সুপ্রিম কোর্ট এই চরম কঠোর মনোভাব নিয়েছে, সেখানে কোনও রাজ্যই স্কুল খোলার সাহস করেনি। চলতি সপ্তাহে ভারতের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিকেল রিসার্চ কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েছে, স্কুল খোলার ব্যবস্থা করতে হবে এবার। ঠিক পরদিন সরকারের কোভিড মোকাবিলার টাস্ক ফোর্সের অন্যতম প্রধান সদস্য এইমস হাসপাতালের ডিরেক্টর আশ্চর্য এক দাওয়াই দিলেন। তিনি বলেছেন, স্কুল খুলতেই পারে। তবে যে এলাকায় কোভিড সংক্রমণের পজিটিভিটি রেট ৫ শতাংশের কম, একমাত্র সেখানে। প্রশ্ন হল, এটা কীভাবে মাপা হবে? শ্যামবাজারের কতটা এলাকা ৫ শতাংশের কম সংক্রমণ এবং বউবাজারের কোন কোন চত্বর ৫ শতাংশের কম, এভাবে মেপে মেপে স্কুল খোলা কীভাবে সম্ভব? র্যান্ডম সার্ভে করে? সেই পরিকাঠামো আমাদের দেশে আছে? বউবাজারে না হয় নিয়ম করে সপ্তাহে দুদিন সার্ভে হল। কিন্তু পুরুলিয়া অথবা দিনহাটা পেরিয়ে ব্লকের স্কুলে এটা করা সম্ভব? প্রশ্ন উঠতে পারে, স্কুল কলেজ খোলার দরকার নেই? ১০০ শতাংশ দরকার। এরকম মহাক্ষতি স্বাধীনতার পর সম্ভবত কোনও প্রজন্মের হয়নি। মানসিক ও অ্যাকাডেমিক, দুটোই চরম এক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের। যত দ্রুত খোলা সম্ভব সেটাই কাম্য। কিন্তু পন্থাটি কী? সেটাই তো সম্পূর্ণ অনিশ্চিত? সঠিক ও নিরাপদ পথটি তো গোটা বিশ্বের কেউ স্থির করতে পারছে না! এই ভয়ঙ্কর অতিমারির চরিত্রটাই যেখানে আজ পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে জানা গেল না, সেখানে সরকারও স্বাভাবিক কারণে ছাত্রছাত্রীদের জীবন নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাইছে না। তাহলে উপায়টা কী?
লোকাল ট্রেন কেন চলছে না? রাজ্য সরকারের ষড়যন্ত্র? কিন্তু ভারতের যে রাজ্যে ও শহরে লোকাল ট্রেন সবথেকে বেশি চলে, কোথাও তো লোকাল ট্রেন চলছে না! সর্বত্রই লোকাল স্পেশাল ট্রেন। সকলের ওঠার অধিকার নেই। দিল্লিতে লোকাল ট্রেন এমনিতেই ফাঁকা যায় স্বাভাবিক সময়েও। সেখানেও স্পেশাল লোকাল ট্রেন চলছে ১০ টাকার টিকিট ৩০ টাকা করে দিয়ে। মুম্বইতে জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত যাত্রীই শুধু উঠতে পারছে স্পেশাল লোকাল ট্রেনে। তামিলনাড়ুতেও জরুরি পেশার পরিচয়পত্র দেখিয়ে শর্তসাপেক্ষে ওঠা যাচ্ছে, লোকাল ট্রেনে। অথচ মনে করা হচ্ছে এ বুঝি শুধুই কলকাতার সমস্যা? তাহলে কি লোকাল ট্রেন চালানোর দাবি অসঙ্গত? কে বলেছে? অন্তত মুম্বই ও কলকাতায় এর থেকে সঙ্গত দাবি আর হতেই পারে না। লোকাল ট্রেন একটা আস্ত অর্থনীতিকে বহন করে। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকাহীন। সামাজিকভাবে নেমে যাচ্ছেন বহু মানুষ। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কর্মী, হকার, ব্যবসায়ী সকলেই হাঁসফাঁস করছে। কিন্তু গণ সংক্রমণের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে সরকারের পক্ষেও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া যে সম্ভব নয়, সেটাও স্পষ্ট ও সঙ্গত। তাহলে কী করা উচিত? আমরা বুঝতে পারছি সরকার সতর্ক এবং দোলাচলে। তাদের হয়তো আশঙ্কা, তৃতীয় ঢেউ সত্যিই কি আসবে? এলে সামলানো যাবে তো?
ভ্যাকসিন নেওয়ার পর আর কি মৃত্যু সম্ভাবনা থাকবে না? ভ্যাকসিন কি একবার নেওয়াই যথেষ্ট? নাকি বছর বছর নিতে হবে? কবে থেকে মাস্ক ছাড়া জীবনযাপন সম্ভব হবে? নাবালকদের ভ্যাকসিন কবে দেওয়া সম্ভব হবে? এই কোভিডকালে বিনা পরীক্ষায় পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের আগামীদিনে কেরিয়ারে কী প্রভাব পড়তে পারে? কর্মসংস্থান অথবা উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে কীভাবে মূল্যায়ন হবে তাদের? আমরা সাধারণ মানুষেরা কীভাবে আবার পেশাগতভাবে ঘুরে দাঁড়াব? রাষ্ট্র আমাদের কী সাহায্য করবে? আমরা জানি যে, একটি প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর নেই! তাই শুধু বিনম্র আবেদন, ভ্যাকসিন কর্মসূচিটা সম্পূর্ণ করুন! অন্তত ওটা তো রাষ্ট্রের হাতে! ১৩০ কোটি মানুষের ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন কবে শেষ হবে? সব তর্ককে ছাপিয়ে একমাত্র আশার আলো ওটাই! কবে পৌঁছবো আমরা ওই স্বস্তির গন্তব্যে?