কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে শুরু হয়ে রাজপথ নামাঙ্কিত যে রাস্তা ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত বিস্তৃত, সেই সদাব্যস্ত প্রশস্ত সড়কের দুই পাশে রয়েছে নর্থ ও সাউথ ব্লক। ভারতের প্রশাসনের শীর্ষ পদাধিকারীদের অফিস এই দুই ভবনেই অবস্থিত। রাজপথের দু’পাশে ছড়িয়ে আছে সবুজ ঘাসের আঙিনা। প্রবীণ বৃক্ষরাজি এই প্রান্তরের সীমানা নির্ধারণ করে। এখানেই এখন চলছে দিবারাত্রি এক করে বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে চলছে ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্প’-এর কাজ।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দিল্লিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিটি’ ঘোষণা করার জন্য আবেদন জমা পড়েছিল রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংস্থা ‘ইউনেস্কো’র কাছে। ব্রিটিশদের তৈরি ‘ইমপেরিয়াল নিউ দিল্লি’ ও মোগল সম্রাট শাহজাহানের তৈরি ‘শাহজাহানাবাদ’-কে তুলে ধরা হয়েছিল রাষ্ট্রসঙ্ঘের দরবারে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার ঠিক এক মাস আগে আচমকাই জানা গিয়েছিল, নরেন্দ্র মোদি সরকার সেই আবেদন প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সেটা ২০১৫ সাল। সবেমাত্র এক বছর হয়েছে, নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসেছেন। এই ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তে সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, মোগল সম্রাট শাহজাহান বা ব্রিটিশ স্থপতি হার্বাট বেকার-এডউইন লুটিয়েন্সের দিল্লি নয়— তিনি চান ‘মোদির দিল্লি’। যা তাঁকে একদিন অমরত্বের পথ খুঁজে দিতে পারে।
সর্বব্যাপী করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার আগেই কখন যেন চুপিসারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, দেশের রাজধানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকার বেশ কয়েকটি বিশিষ্ট ও ঐতিহ্যবাহী অট্টালিকার আর প্রয়োজন নেই। অথবা সেই বাড়িগুলি স্বপ্নের নতুন ভারতের উপযোগী নয়। কাজেই সেগুলিকে হয় ভেঙে ফেলা হবে অথবা তাদের অন্য কাজে ব্যবহার করা হবে। মোদি সরকার আসলে কংগ্রেস আমলে তৈরি কোনও ভবনকেই হেরিটেজ ভবন বলে মানতে নারাজ। প্রধানমন্ত্রী চাইছেন, এক ডজন ভবন ভেঙে দ্রুত গড়ে তোলা হোক ‘কংগ্রেস-মুক্ত’ রাজপথ।
কে না জানে, ব্রিটিশ ভারতের ফেডেরাল কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি মরিস গয়ার তৈরি করেছিলেন ন্যাশনাল মিউজিয়ামের নীল নকশা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতি ভবনের মধ্যেই ন্যাশনাল মিউজিয়াম চালু হয়। তারপর জনপথে ন্যাশনাল মিউজিয়ামের বর্তমান ভবনের শিলান্যাস করেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ১৯৬০-এ এই মিউজিয়ামের উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত তিন কিলোমিটার দীর্ঘ রাজপথ ও তার দু’পাশের এলাকা ঢেলে সাজাতে গিয়ে এ বার সেই ন্যাশনাল মিউজিয়ামই ভাঙা পড়তে চলেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, অর্থ মন্ত্রক এবং কর্মীবর্গ মন্ত্রকের প্রধান দপ্তরের ঠিকানা নর্থ ব্লক। রাস্তার অন্য পাশের সাউথ ব্লকে রয়েছে বিদেশ মন্ত্রক এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রধান দপ্তর। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের মন্ত্রী-উপমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী নর্থ ব্লক ও সাউথ ব্লকে বসে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেন। সাউথ ব্লকের একটি সংযুক্ত অংশে অবস্থিত প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বা পিএমও। লোকে বলে এখন নাকি ওই দপ্তরই দেশ চালায়। এহেন দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভবন প্রস্তাবিত প্রকল্প অনুসারে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হবে। আর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দপ্তরগুলি নতুন ঠিকানায় সরে যাবে। ন্যাশনাল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ভারতের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসের চিহ্ন, প্রায় ২ লক্ষ সামগ্রী সাজানো হবে নর্থ ব্লক ও সাউথ ব্লকে।
শুধু ন্যাশনাল মিউজিয়াম নয়। দেশের রাজধানী বলতেই যে সব ছবি ভেসে ওঠে, তার মধ্যে অন্তত এক ডজন ভবন, সরকারি দপ্তর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। নির্মাণ ভবন আর শাস্ত্রী ভবন স্বপ্নের নতুন ভারতের উপযোগী নয়। অহেতুক প্রচুর জায়গা জুড়ে নাকি দাঁড়িয়ে আছে। কাজেই এই দু’টি বাড়িকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেই জায়গায় বানানো হবে দশটি আটতলা বাড়ি। সেইসব ঝাঁ চকচকে আধুনিক বাড়িগুলি হবে নতুন কেন্দ্রীয় সচিবালয়। সমস্ত মন্ত্রকের সত্তর হাজার কর্মী-আধিকারিক সেইসব নতুন বাড়িতে বসে নতুন ভারতের প্রশাসন পরিচালনা করবেন। নবনির্মিত প্রতিটি বাড়ির বাইরের চেহারা নর্থ ব্লক এবং সাউথ ব্লকের মতো প্রস্তর আচ্ছাদিত হলেও ভিতরে কিন্তু ইস্পাত এবং কাচের ব্যাপক ব্যবহার হবে। প্রতিটি বাড়ি আবার ভূগর্ভস্থ পথ দিয়ে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে।
১৯৩০-এ ব্রিটিশ স্থপতি স্যর এডউইন লুটিয়েন্সের নকশা অনুযায়ী রাজধানীতে যে প্রশাসনিক স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল, দেশের সংসদ ভবনও তার মধ্যে পড়ে। মোদির সৌজন্যে অস্তিত্ব হারাবে সেই সংসদ ভবনও। গড়ে তোলা হবে নতুন সংসদ ভবন। তার স্থাপত্যশৈলী নাকি এককথায় অনবদ্য। সেখানে বারোশো সাংসদের বসার বন্দোবস্ত করা হবে। মন্ত্রী তো বটেই প্রত্যেক সাংসদের জন্য থাকবে আলাদা বসার ঘর এবং দপ্তর। প্রশ্ন হল, ভারতের নতুন সংসদ ভবনের আসন সংখ্যা বাড়ানো কি বিজেপির নয়া কৌশল? বিজেপি যে সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের যথেষ্ট আগে শেষ করাতে চাইছে, তার পিছনে কি কাজ করছে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বড় কোনও পরিকল্পনা? কেউ কেউ বলছেন, জনসংখ্যার সমানুপাতিক হারে আসন সংখ্যা বাড়ানোর অর্থ গণতন্ত্রকে ঠেলে দেওয়া হবে সংখ্যাগুরুবাদের দিকে। সম্প্রতি কার্নেগি এনডাওমেন্টের এক গবেষণা-প্রবন্ধে জানা গিয়েছে, যদি ২০২৬ সালেই জনসংখ্যার সমানুপাতিক হারে লোকসভার আসনবণ্টন হয়, তা হলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে। সে ক্ষেত্রে কেরলের এখনকার ২০টি আসন ২০২৬ সালে হয়ে যাবে ১২। তামিলনাড়ুর আজকের ৩৯ নেমে আসবে ৩১-এ। পশ্চিমবঙ্গের আসনও কমে আসবে ৪২ থেকে ৩৮-এ। আর অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশের ৮০ হবে ৯১ এবং বিহারের ৪০ পৌঁছবে ৫০-এ। হিন্দিভাষী দুই বৃহৎ রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে অবিরল জন বিস্ফোরণ— লোকসভার আসনে তা প্রতিফলিত হলে অন্যান্য রাজ্যবাসীর কাছে তা কাম্য হতে পারে না। তাছাড়া কোনও রাজ্যই রাজি হবে না লোকসভায় তার সদস্যসংখ্যা কমিয়ে আনতে। কিন্তু মোদি-অমিত শাহ বিরোধীদের কোনও যুক্তি মানেন না। ফলে আশঙ্কা বাড়ছেই।
বিরোধীদের অভিযোগ, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের গোটা প্রক্রিয়াটাই অস্বচ্ছ। সরকারের কী পরিকল্পনা, কোন ঐতিহাসিক ভবন ভাঙা হবে, রাজপথের দু’পাশে কত গাছ কাটা পড়বে, তার কোনও তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের অবশ্য দাবি, প্রতিটি স্তরেই হেরিটেজ সংরক্ষণ কমিটি, পরিবেশ কমিটির ছাড়পত্র নেওয়া হচ্ছে। বিরোধীদের দাবি, সরকার একবারে গোটা পরিকল্পনা পেশ না করে বিচ্ছিন্নভাবে এক-একটি কাজের ছাড়পত্র আদায় করে নিচ্ছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে মহামারীর মধ্যে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ তকমাপ্রাপ্ত সেন্ট্রাল ভিস্টার কাজ এগচ্ছে। এই বিশাল পরিকল্পনার মানচিত্র শুধু প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর গুজরাতি স্থাপত্যকার বিমল প্যাটেলই জানেন।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই প্রকল্পের জন্য দরপত্র হাঁকা শুরু হয়। গুজরাতের এইচসিপি ডিজাইন, প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট নামে একটি সংস্থা দরপত্র জমা দিয়েই প্রকল্পের বিষয়ে বিবৃতি দেয়। তখনও পর্যন্ত সরকারের তরফে ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প’ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য ছিল না। পরে দেখা গেল ওই সংস্থাই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে। তখনও যদিও করোনা হানা দেয়নি। কিন্তু নোটবন্দি, জিএসটি নীতির ধাক্কায় দেশে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কালো ছায়া নেমে এসেছিল। সেই পরিস্থিতিতে খামোকা নতুন করে সংসদ ভবন নির্মাণের প্রয়োজন পড়ল কেন, প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। অন্য সব বিষয়ের মতো সেন্ট্রাল ভিস্তা নিয়ে ওঠা প্রশ্নের জবাব তো দূরের কথা কর্ণপাতই করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ, নোট বাতিলের পর থেকে অর্থনীতির মন্দ দশা, বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলা, কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থতা— এই সব কিছু ভুলিয়ে দিতে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদি এক নতুন দিল্লি তুলে ধরবেন।
ভাবুন একবার, আজ কোভিডে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। সরকারের হাতে তেমন টাকা নেই। কোভিডে মৃতদের পরিবারকে সামান্য ক্ষতিপূরণ দেওয়াও সম্ভব নয়। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। অথচ, সেন্ট্রাল ভিস্তা গড়তে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে কেন্দ্র। বারোটি বিরোধী রাজনৈতিক দল এই প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছে। দেশের তো বটেই বিদেশের খ্যাতনামা পত্র-পত্রিকায় এই প্রকল্প নিয়ে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়। সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প বাতিলের দাবিতে দেশ বিদেশের বুদ্ধিজীবীরা সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। তবুও ঔদ্ধত্যের শেষ নেই। আসলে অমরত্বের লালসায় নরেন্দ্র মোদি কখন যেন হয়ে গিয়েছেন ‘সম্রাট নিরো’!