পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
ধুরন্ধর শাসক এভাবেই নিজের চারপাশটা গুছিয়ে নিয়ে অদ্ভুত প্রশান্তি খোঁজেন। কিন্তু তবু সিঁদ কেটে দুর্নাম জোটে, জনগণেশ ক্ষিপ্ত হয়ে হিসেব উল্টে দেয়। খাতায় কলমে সব ঠিকঠাক থাকলেও ইতিহাস এমনই নিষ্ঠুর। বড় কঠিনভাবে তা ফিরে ফিরে আসে। আচমকা জীবন্ত হয়ে উঠে শাসকের দু’গালে আচমকা কষিয়ে থাপ্পড় মেরে কিছু না বলেই অদৃশ্য হয়ে যায়। কোথাও দু’শো গোল দেওয়ার অলীক স্বপ্ন দেখলেও বাস্তবের মাঠে থেমে যেতে হয় সত্তরের ঘরেই। কখনও আবার হুকুম ফলে না। মাঝখান থেকে টানাটানির কঠিন আবর্ত শিক্ষা দিয়ে যায় নির্মমভাবে। বুঝিয়ে দেয়, তুমি নও, উপর থেকে সুতো ধরে টান মারার লোক আলাদা। এরই মধ্যিখানে কেটে যায় কয়েক দশক। শতাব্দীও হতে পারে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ক্ষমতার দৌলতে সময়কে সাময়িক হারিয়ে দেওয়া গেলেও ইতিহাস ঠিক অতীতকে মনে রেখে নীরবে একই দান ফিরিয়ে দেয় অকপটে। ২০১৪ থেকে বিজেপির থুড়ি নরেন্দ্র মোদির অভাবনীয় যে জয়যাত্রায় উত্তরপ্রদেশই ছিল প্রধান ভরসাস্থল, একুশে মহামারীর আবহে তাতেই যেন কোথায় চিড় ধরেছে। দম নিতে না পেরে কখন মানুষের আস্থা হারিয়েছে সরকার। শুধু বিরোধীরাই এতে চাঙ্গা হয়নি, পারস্পরিক বিশ্বাসটাও কোথাও ষোলোআনা টাল খেয়েছে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে। সাধারণ মানুষ সেখানে বলছে, বিরোধীদের খতম করতে গিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা উন্নয়নে নজরই দেয়নি যোগী সরকার। যার ফলে গঙ্গায় লাশের সারি, হাসপাতালে অক্সিজেন বাড়ন্ত, দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতে প্রশাসনের সেই কাহিল অবস্থাটা কতটা এনকাউন্টার আর নির্মীয়মাণ রামমন্দিরের গৌরব দিয়ে ঢেকে দেওয়া যাবে তারই উত্তর দেবে আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচন। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে আসন্ন লোকসভা ভোটেও। কারণ ৮০ আসনের উত্তরপ্রদেশই কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলেরও নির্ণায়ক ফ্যাক্টর।
কিন্তু ভোটের ফলের চেয়েও যেটা গেরুয়া শিবিরকে বেশি ভাবাচ্ছে তা হচ্ছে মোদি ও যোগীর এই বাড়তে থাকা ইগোর লড়াই। আর সেখানেই ইতিহাসের আর এক অদ্ভুত সমাপতন দেখছে দেশ। ২০০২ থেকে ২০২১ সময়ের দূরত্ব মাত্র ১৯ বছর। এই উনিশ বছরেই আক্কেলগুড়ুম হয়ে গিয়েছে নরেন্দ্র মোদির। প্রায় দু’দশক আগের রক্তক্ষয়ী গুজরাত দাঙ্গা সারা বিশ্বের কাছে প্রবাদপ্রতিম অটলবিহারী বাজপেয়ির মাথা হেঁট করে দিয়েছিল। তিনি নিজেও মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে শিষ্য নরেন্দ্র মোদির অপসারণ চেয়ে সরব হয়েছিলেন। কিন্তু দলের কট্টরপন্থী অংশ সেদিন লালকৃষ্ণ আদবানির নেতৃত্বে বাজপেয়িজির অব্যক্ত যন্ত্রণার সঙ্গে সহমত হয়নি। ফলে মোদিজি এতবড় গণহত্যার পরও গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদেই আসীন থেকেছিলেন বুক ফুলিয়ে অবলীলায়। আর আজ ঠিক ১৯ বছর পর সেই একই খেলা আবার উত্তরপ্রদেশে। নীরবে ‘গুরুপ্রণাম’ই কি ফিরিয়ে দিচ্ছেন গোরক্ষপুরের যোগী আদিত্যনাথ? একের পর এক ঘটনায় সেখানে বিজেপির জনভিত্তি ধাক্কা খাচ্ছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলের ভরাডুবি হয়েছে। তার উপর কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় যোগী সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতার হরেক কিসিমের আখ্যান রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে আজ মুখে মুখে ঘুরছে। প্রধানমন্ত্রীর আত্মনির্ভর ভারতকে দুয়ো দিয়ে, স্বচ্ছ ভারতকে লজ্জা দিয়ে গঙ্গায় লাশের সারি দেখছে মানুষ। এ কার লজ্জা! তবু ১৯ বছর আগের বাজপেয়িজির মতো নরেন্দ্র মোদিও আজ অসহায়। কট্টরপন্থীদের চাপে নেতৃত্বে নতুন মুখ নিয়ে আসা দূরে থাক, গেরুয়া বসন পরিহিত যোগীজিকে একটি কথা বলারও জো নেই তাঁর। নীরবে সয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এমনও শোনা যাচ্ছে মোদির পর বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীও নাকি তিনিই। বাগে আনতে না পেরে যোগীকে নজরে রাখতে সম্প্রতি এক পোড় খাওয়া আইএএসকে লখনউ পাঠিয়েছেন মোদি। নাম অরবিন্দ শর্মা। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি, উল্টে অবিশ্বাসের ফাটল আরও চওড়া হয়েছে। দিল্লির সাম্প্রতিক বৈঠকও দু’তরফের দূরত্ব মেটাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। এরই মাঝে আবার রামমন্দির নির্মাণের জমি কেনাবেচা নিয়েও বিরাট দুর্নীতি সামনে এসেছে। ২ কোটি টাকার জমি মন্দির ট্রাস্ট কিনেছে ১৮ কোটি টাকায়। অগণিত ভক্তের বিশ্বাসের মন্দির নিয়ে অসাধু ব্যবসা? এতবড় দুর্নীতির লাভের গুড় খেল কে? নিশ্চয় গেরুয়া বিরোধী কেউ হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর তৈরি করে দেওয়া মন্দির ট্রাস্ট কি তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই!
যদি প্রশ্ন ওঠে হঠাৎ বিধানসভা ভোটের আগেই এমনটা হল কেন? অনেকগুলি উত্তর সামনে আসবে। বিগত ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভোট রাজনীতির স্বার্থে দিল্লি থেকে প্রশ্রয় বড় কম দেওয়া হয়নি যোগীকে। আর সেই সুযোগকে সম্পূর্ণ কাজে লাগিয়ে হিন্দুত্বের পোস্টার বয় সেজে কখনও সংখ্যালঘু, আবার কখনও দুর্বল বিরোধীদের উপর একতরফা হত্যালীলা নামিয়ে এনেছেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী আদিত্যনাথ। গুজরাতে মোদিজির ভয়াবহ দাঙ্গা রাজনীতির উল্টোপিঠে যোগীর এনকাউন্টার রাজনীতিতে কি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সায় ছিল না? সম্মতি ছিল না নিরপরাধ সাংবাদিক হত্যায়? আলবাৎ ছিল। গুন্ডাগর্দি খতম করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আরএসএসের ছত্রছায়ায় সংগঠন বিস্তারের আড়ালে যখন ক্রমাগত অপশাসনের বীজ বপন করা হয়, তখন স্বভাবতই জনসমর্থনেও টান পড়তে বাধ্য। হাতরাস থেকে শুরু করে একের পর এক খুন ও ধর্ষণ, গো রাজনীতির নামে সংখ্যালঘু নিপীড়ন, সবই চলেছে সঙ্ঘের ভাবধারা মেনেই। উপরন্তু রাজপুত মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একটা বড় দূরত্ব তৈরি হয়েছে উত্তরপ্রদেশের প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ সমাজের। এই ফাঁকটাও দলকে ভাবাচ্ছে। সেই কারণেই কংগ্রেস ভাঙিয়ে দলে আনা হয়েছে ব্রাহ্মণ সন্তান রাহুল গান্ধী ঘনিষ্ঠ জিতিন প্রসাদকে। বাংলায় দল ভাঙার কৌশল ব্যুমেরাং হয়েছে দেখেও সেই পথেই দল আবার হাঁটছে মানেই গেরুয়া শিবির যথেষ্ট চাপে। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রশ্রয়েই যোগী আদিত্যনাথ আজ কালের নিয়মে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। যাই ঘটে যাক মোদির বিজেপি তাঁকে না পারবে গিলতে, না পারবে ওগড়াতে! চোখ রাঙিয়ে যতই বলা হোক আপনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, জনগণের সামনে সত্যিটা একদিন না একদিন বেরিয়ে আসবেই। ভারতবর্ষ এমনই এক গণতন্ত্রের আদর্শকে বহন করে যেখানে একজন ব্যক্তি বা দল সহজে দেশের বহুমাত্রিক এই বিচারধারার বদল ঘটাতে পারে না। বারে বারে তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আজ স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তীর ঠিক আগের বছরেও তা কোনও যোগী বা মোদির পক্ষে যে সম্ভব হবে না। দেশবাসী এই সার সত্যটা জেনে ফেলেছে এবং উপলব্ধিও করছে হাড়ে হাড়ে। তাই এবার একনায়কতন্ত্রের দড়ি ধরেই টান মারার পালা। বাংলা পথ দেখিয়েছে, উত্তরপ্রদেশ তাকে আরও প্রশস্ত করবে।
মোদিজিও বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন, যোগীর এই অনাচার বেশিদিন চললে তার নিশ্চিত প্রভাব পড়বে আগামী চব্বিশ সালের সাধারণ নির্বাচনেও। এবং তারও আগে আগামী বছরের বিধানসভা ভোটে। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভূতপূর্ব সাফল্য এবং স্বাধীনতার পর দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে কেন্দ্রের শাসক দলের বিপর্যয় বিরোধী শক্তিকে চাঙ্গা করেছে। যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথে বিজেপি বিরোধী ভোটের বিভাজন রুখে অবিজেপি দলগুলি একজোট হয়ে ময়দানে নামতে পারে তাহলে দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র দ্রুত বদলে যেতে বাধ্য। সেই আশাই দেখাচ্ছেন ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোর। কংগ্রেস, অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি, মায়াবতীর দলের একটা বড় অংশ মিলে যদি বিরোধী ভোট বিভাজনের রাস্তা আটকাতে পারে সেক্ষেত্রে যোগী আদিত্যনাথের বিপদ অবশ্যম্ভাবী। আর বাইশে উত্তরপ্রদেশে ধাক্কা খেলে দু’বছর বাদে লোকসভা ভোটে মোদির পক্ষে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করা মোটেও খুব সহজ হবে না। কারণ পাঞ্জাব, হরিয়ানা সহ উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষকরা ক্ষোভে ফুঁসছেন। ফুঁসছেন শ্রমিক ও সাধারণ দিন আনা দিন খাওয়া মানুষও। নিশ্চিত ব্যবসা পথে বসেছে নোট বাতিল আর জিএসটির জোড়া সর্বনাশে। এই অবস্থায় একনায়কতন্ত্রের নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে উত্তরপ্রদেশই। বাংলার ঐতিহাসিক নির্বাচনের পর উত্তরপ্রদেশেও গেরুয়া রথ থামানো গেলে নতুন করে লিখতে হবে ভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ। সেই রেশ ধরেই চব্বিশের সাধারণ নির্বাচনে দিল্লির তখতে অবিজেপি সরকারের প্রত্যাবর্তন হলেই মঙ্গল। সেক্ষেত্রে বাংলার ভাগ্যেও শিকে ছিঁড়তে পারে। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে বহু গৌরবের অধিকারী হয়েও প্রধানমন্ত্রী পদ বারবার হাতছাড়া হয়েছে আমাদের। বিরোধীদের মুখ হিসেবে চব্বিশে বাংলার জননেত্রীর হাতে দেশের ভার এলে তা হবে ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসের সবচেয়ে হীরকখচিত ঘটনা।