পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সংক্রমণের শিখর ছোঁয়ার মুহূর্তে বাংলার দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছিল সিবিআই। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, সিবিআই দেখিয়ে বিজেপির ভাঙন আটকানো। কারণ ‘চাণক্য’ বুঝেছিলেন, নির্বাচনে গোহারা হারার পর বঙ্গে বিজেপির ভাঙন সময়ের অপেক্ষা। এই অবস্থায় দল অটুট রাখার একটাই অস্ত্র—‘সিবিআই জুজু’। কারণ ভয় দেখিয়ে জয় করাই হল মোদি-অমিত শাহ জুটির ট্র্যাডিশন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হ্যাটট্রিক করার অনন্য গৌরব সৃষ্টির কারণে বাংলা যখন ‘মমতাময়’, ঠিক তখনই আছড়ে পড়েছিল আঘাত। নির্বাচনে নাস্তানাবুদ হওয়ার পর প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার এমন নির্লজ্জ, নজিরবিহীন পদক্ষেপে দেশজুড়ে উঠেছিল সমালোচনার ঝড়। বিজেপি নেতৃত্ব মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিল ব্রিটিশ লেখক-নাট্যকার জন লিলির লেখা থেকে প্রবাদের রূপ নেওয়া কথাগুলি, ‘অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’। তারপরেও বিজেপিতে ভাঙন হয়েছে। নারদায় অভিযুক্ত মুকুল রায় তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
মুকুলবাবু যদি কেবল বিজেপির একজন বিধায়ক হতেন, তাহলে তাঁকে নিয়ে চর্চার তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি ছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি। তাছাড়া ভোটে না জেতার বিরোধীদের কটাক্ষের জবাব দেওয়ার যোগ্যতা এই প্রথম অর্জন করেছেন। বিধায়ক পদ খোয়ানোর আশঙ্কা সত্ত্বেও তিনি বিজেপি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রাজনীতিতে ‘ঠান্ডা মাথার’ লোক বলে পরিচিত মুকুল রায় ভালো করেই জানেন, তৃণমূলে তিনি আগের জায়গাটা কিছুতে ফিরে পাবেন না। তাছাড়া বারবার দল বদলালে নেতার প্রতি মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতায় চিড় ধরে। তারপরেও দেশের সর্ব বৃহৎ পার্টি ছেড়ে তিনি মূলত একটি রাজ্যে সীমাবদ্ধ দলে যোগ দিলেন। আর গুরুত্বটা ঠিক এখানেই। অনেকে বলছেন, মুকুল রায় প্রায় বছর চারেক ভিতরে থেকে বিজেপির প্রকৃত অবস্থাটা বুঝে গিয়েছেন। তাই ‘জাহাজ’ ডোবার আগেই ‘নৌকায়’ চেপে বসেছেন। কারণ নৌকার হালটা মমতার হাতে। তুফানের মধ্যেও তীরে ‘নাও’ ভেড়ানোটাই তাঁর ইউএসপি।
বঙ্গ দখল করে বিজেপির দুই হেভিওয়েট দলের মধ্যে তাঁদের কর্তৃত্বকে আরও মজবুত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, বাংলার মানুষ নাকে ঝামা ঘষে দেওয়ায় দলে তাঁরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন। বিজেপিতে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। শুধু বঙ্গেই নয়, ক্রমশ তা অন্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। পাশের রাজ্য ত্রিপুরায় মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের বিরুদ্ধে বিজেপি বিধায়কদের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হুইপে তাঁরা এতদিন চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু, এখন আর তাঁরা আজ্ঞাবহ দাসের মতো সব নির্দেশ মানতে চাইছেন না। বেচাল দেখলেই ফোঁস করছেন। এটাই রাজনীতির নিয়ম।
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে টক্কর নিয়ে বিপুল জয় ছিনিয়ে আনতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে ত্রিপুরাতেও শুরু হয়েছে স্বপ্ন দেখা। বাজতে শুরু করেছে ‘খেলা হবে ত্রিপুরায়’ গানও। বিজেপির বিক্ষুব্ধরা ফণা তুলছেন। বিপদের গন্ধ পেয়েই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব তড়িঘড়ি দুই পর্যবেক্ষককে পাঠিয়ে দিয়েছে ত্রিপুরায়। কারণ প্রতিপক্ষ হিসেবে মমতা যে কত ভয়ঙ্কর, তা বিজেপির দিল্লির নেতারা বাংলার নির্বাচনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তাই তাঁরা ফাঁক রাখতে চাইছেন না। তবে, এসব করেও সামাল দেওয়া সম্ভব হবে, এমন গ্যারান্টি নেই। কারণ তৃণমূল বাংলায় বিজেপির ঘর ভাঙানোর খেলার ‘মধুর প্রতিশোধ’ নেওয়ার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করবে না।
রাজনীতি অনেকটা নাগরদোলার মতো। উপরে উঠলে নামতে হবেই। এটাই ভবিতব্য। অপেক্ষাটা শুধু সময়ের। বিজেপির দিল্লির নেতারা উপরে উঠে নামার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। বাংলার নির্বাচন বিজেপির সেই নামার দিকটাই নির্দেশ করে দিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে নির্ধারিত হবে বিজেপির ‘গ্রাউন্ড জিরো’তে নামার সময়।
তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর মুকুলবাবুর বিরুদ্ধে সিবিআই কোনও ব্যবস্থা নেবে কি না, সেটা সময় বলবে। তবে, এই ইস্যুতে সিবিআই যে পদক্ষেপই করুক না কেন, লাভ তৃণমূলের। তাঁকে গ্রেপ্তার করলে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’র তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার আরও একটা সুযোগ পেয়ে যাবে তৃণমূল। আর ব্যবস্থা না নিলে বিজেপিকে ভিতর থেকে ফোঁপরা করার তিনিই হবেন মূল হাতিয়ার। ফলে মুকুল-কাণ্ডে বিজেপির যথার্থই ‘শাঁখের করাতে’র অবস্থা।
‘শেষ পাতের চাটনি’ থেকে বিজেপির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি হয়েছিলেন মুকুলবাবু। তার জন্য নিশ্চয়ই তাঁকেও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়েছিল। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বলেই বিজেপি তাঁকে এই পদ দিয়েছিল। অনেকে বলেন, এরাজ্যের গ্রামের দিকে বিজেপির সংগঠন তৈরির অনেকটা মুকুলবাবুর কৃতিত্ব। তাই মুকুলের তৃণমূলে যোগদানে শাসক দলের কোনও লাভ না হলেও বিজেপির যে ক্ষতি হবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত।
নির্বাচনে ভরাডুবির পর থেকেই দলবদলু নেতাদের একটা বড় অংশ তৃণমূলে ফেরার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সোনালি গুহ খোলা চিঠি লিখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁচলের নীচে আশ্রয় চেয়েছেন। একেবারে সরাসরি আত্মসমর্পণ। এটা ‘সোজাসাপ্টা’ পলিসি। অনেকে আবার ঘুরপথে তৃণমূলে ফেরার রাস্তা তৈরি করতে চাইছেন। তাঁরা বিজেপিকে আক্রমণ করছেন। নির্বাচিত রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিজেপির ৩৫৬ ধারা জারির চেষ্টার বিরোধিতা করছেন। এটা ‘পেটে খিদে মুখে লাজ’ পলিসি। উদাহরণ রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল মণ্ডল। কেউ কেউ আবার রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মাতৃবিয়োগের ঘটনাকেও দলে ফেরার ‘সুযোগ’ হিসেবে কাজে লাগাতে চাইছেন। এটা ‘সৌজন্য’ পলিসি। এই পলিসির ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার’ শোভন-বৈশাখী।
পলিসি ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকলের উদ্দেশ্য এক। তৃণমূলে যোগদান। কারণ তাঁরা বুঝেছেন, মমতার ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা তৃণমূলের শিকড় বাংলার মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। ঝড়ঝাপ্টায় তার দু’একটা ডাল ভাঙতে পারে, কিন্তু গাছ উপড়ে ফেলা যাবে না। এবারের নির্বাচনে তার প্রমাণও মিলেছে। মুকুল রায়কে তৃণমূলে ফিরিয়ে নেওয়ায় দলবদলুদের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে।
মুকুল রায়ের কপালে শিকে ছিঁড়লেও বাকি দলবদলুরা এই মুহূর্তে কতটা সুবিধা করতে পারবেন, তা বলা কঠিন। কারণ তাঁরা তৃণমূলে ফিরতে চাওয়ার বাসনা প্রকাশ করতেই বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে প্রতিবাদ। কোথাও দলবদলু নেতাদের বিরুদ্ধে পড়ছে পোস্টার, কোথাও আবার হচ্ছে রাস্তা অবরোধ। তার কারণ একটাই, এই দলবদলুরাই নির্বাচনের আগে তাঁদের প্রিয় নেত্রীকে কুৎসিত আক্রমণ করেছিলেন। তাই তাঁদের দলে ফেরালে মানুষ বিরূপ হবে। দলে বাড়বে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব।
শোনা যাচ্ছে, তৃণমূলে ফেরার ও যোগদানের আবেদনের একটা লম্বা তালিকা শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে জমা পড়েছে। তার মধ্যে কিছু বিধায়কও রয়েছেন। আবেদনকারীরা ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে বাকি জীবনটা তৃণমূলে থেকে কাজ করতে চেয়েছেন। কিন্তু, তৃণমূল সুপ্রিমো এব্যাপারে নির্লিপ্ত। সম্ভবত তিনি ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েছেন।
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ক্লোজড চ্যাপ্টার’। নারদা কাণ্ডে দুই মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেও তেমন সুবিধে হয়নি। বিজেপিতে ‘বেসুরো’দের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। একের পর এক পঞ্চায়েত বিজেপির হাতছাড়া হচ্ছে। পার্টি অফিসগুলির অবস্থা করোনা আবহে মিষ্টির দোকানের চেয়েও খারাপ। মাছি তাড়ানোর লোক নেই। এমন সঙ্কটকালে বিজেপির ভাঙন ও গেরুয়া শিবিরকে অক্সিজেন জোগানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন ‘ট্যুইটারবাবু’। হিল্লি দিল্লি করছেন। হুঙ্কারও ছাড়ছেন। এসব দেখে লোকজন একটা কথাই বলছে, ‘ফোঁপরা ঢেঁকির শব্দ বেশি।’