দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
এরপরই এভাবে সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তিনি হিংসা ছড়াচ্ছেন এই অভিযোগে বালগঙ্গাধর তিলককে পুলিস গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ দায়ের করা হয়। সেই শুরু দেশদ্রোহ আইনের চরম ব্যবহার। যেহেতু তিলককে এই আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে শুরু হয় আলোড়ন। সবথেকে বড় কথা, দুটি আইনকে একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়। দেশদ্রোহ এবং এপিডেমিক অ্যাক্ট। অর্থাৎ প্লেগ মোকাবিলায় তিনি বাধা সৃষ্টি করছেন এই আইনও চাপানো হয় মামলায়। সমস্যা হল, বম্বে হাইকোর্টে তিলকের হয়ে শুনানি করার জন্য একজনও আইনজীবী পাওয়া গেল না। কেউ রাজি নয় ব্রিটিশদের ভয়ে। তাহলে কী উপায়?
বম্বে থেকে অনেক দূরের এক শহর কলকাতার তিনজন বাঙালি তিলককে আইনি সহায়তা প্রদান করতে চাঁদা তোলা শুরু করলেন। ওই তিনজনের নাম জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কংগ্রেস নেতা উমেশচন্দ্র ব্যানার্জি এবং অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা মতি লাল ঘোষ। তাঁরা অবিশ্বাস্য প্রয়াসে বিপুল অর্থ জোগাড় করলেন। ২০ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে তাঁরা কলকাতা থেকেই দুজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টারকে পাঠালেন তিলকের হয়ে মামলা লড়তে। কিন্তু ব্রিটিশ বিচারক কোনও যুক্তি না মেনে তিলককে ১৮ মাসের কারাবাস দিয়েছিলেন।
এখানেই শেষ নয়। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের জেরে প্রবল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিল মহারাষ্ট্রও। সেখানেও সমর্থনে অগ্রগামী ছিলেন বালগঙ্গাধর তিলক। ১৯০৮ সালে বিহারের মুজফফপুরে ক্ষুদিরাম বোস এবং প্রফুল্ল চাকী নামে দুই তরুণের নিক্ষেপ করা বোমায় ভ্রান্তিবশত দুই ব্রিটিশ মহিলার মৃত্যু হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার চরম দমনপীড়ন শুরু করে। সেক্ষেত্রেও কেশরী পত্রিকায় তিলক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিলেন। পুনরায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। আবার দেশদ্রোহের আইনে। এবার ৬ বছরের জেল। সুদূর মান্দালয়ে। কিন্তু দেখা গেল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন কমে যাওয়ার বদলে আরও বেড়ে গেল। বাংলা, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, সংযুক্ত প্রদেশ সর্বত্র। যত বেশি ব্রিটিশ চেষ্টা করেছিল ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারায় বিরুদ্ধমত দেখলেই দেশদ্রোহের আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়ার, ততই নতুন নতুন বিপ্লবী আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। সুতরাং দমনপীড়নে সরকার বিরোধী অবস্থান কমে না। বরং বৃদ্ধি পায়।
অনতিঅতীত ইতিহাসের এই জানা প্রসঙ্গ পুনরায় উত্থাপনের কারণ কী? কারণ হল, বিস্ময়করভাবে দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিককালে হঠাৎ দেশদ্রোহী আইন যখন তখন ব্যবহার করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির অভিযোগ যে, কেন্দ্রের অঙ্গুলিহেলনেই তাদের দলের রাজ্যগুলিতে সরকারের বিরুদ্ধ মতকে দমন করার জন্য এই দেশদ্রোহ আইন বেশি করে প্রয়োগ করা হচ্ছে। সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকর্মী, রাজনৈতিক কর্মীরা বারংবার দেশদ্রোহ আইনের দ্বারা গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং জেলে থাকছেন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট এবং দিল্লি হাইকোর্টে একের পর এক মামলায় এই আইনের যথেচ্ছ ব্যবহারের চরম সমালোচনা করেছে। একের পর এক আদালতের রায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বিরুদ্ধ মত মানেই দেশদ্রোহ নয়। ১৯৬২ সালের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়কে (কেদারনাথ জাজমেন্ট) হাতিয়ার করে বলা হচ্ছে, নাগরিকদের সম্পূর্ণ অধিকার আছে সরকার সম্পর্কে যা ইচ্ছে সেভাবেই মনের ভাব প্রকাশ করার এবং লেখার। শুধু একটাই শর্ত, সেটি যেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অথবা হিংসায় প্ররোচনা না দেয়। শুধুই মতপ্রকাশ কখনও দেশদ্রোহিতা হতে পারে না। ২০১৪ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে ভারতে দেশদ্রোহের মামলা ক্রমবর্ধমান। ২০১৪ সালে দেশদ্রোহের মোট মামলা রুজু হয়েছিল ৭০। সেখানে ২০১৯ সালে ১২০। একই দোষে দুষ্ট ইউপিএ সরকারও। গত এক দশকে দেশদ্রোহ আইন প্রয়োগের শীর্ষস্থানে ছিল ২০১১ সাল। অর্থাৎ ইউপিএ আমল। ১৩০টি মামলা রুজু হয়েছিল। দেশদ্রোহের মামলা কংগ্রেস আমলে ১৯৭৪ সালেই শাস্তিযোগ্য হিসেবে আইনে পরিণত হয়েছিল। বারংবার দাবি উঠেছে যে, এই আইনের পরিমার্জন করা হোক। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবশ্যই লড়াই জরুরি। কিন্তু সেই আইন যেন স্রেফ বিরুদ্ধমত দমনের হাতিয়ার না হয়।
১২৪এ ধারাটি প্রথমে অন্তর্ভুক্ত ছিল না লর্ড মেকলে দ্বারা গঠিত ভারতীয় দণ্ডবিধির খসড়া আইনে। ১৮৭০ সালে ওয়াহাবি আন্দোলনকে মোকাবিলা করতে স্যার জেমস ফিটজেমস স্টিফেস এই আইনটি অন্তর্ভুক্ত করেন প্রথমবার। বিল পেশ করার সময় তিনি বলেছিলেন, ওয়াহাবি আন্দোলনকারীরা গ্রাম থেকে গ্রামে গিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে মানুষকে প্ররোচিত করছে। এভাবে একদিন সরাসরি যুদ্ধে নামবে এই আন্দোলনকারীরা। তাই এখন থেকেই এদের মোকাবিলা করতে হবে। সেই শুরু। ১৯২২ সালে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকেও এই আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। জওহরলাল নেহরুও গ্রেপ্তার হয়েছেন এই আইনে। আজও চলছে ওই একই আইন। ব্রিটিশ চলে গেলেও সেই বিদেশি শাসকের মনোভাব কিন্তু রয়ে গিয়েছে। তাই আজ ২০২১ সালেও সরকারের সিদ্ধান্ত অথবা অবস্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে, আন্দোলনজীবী! অথচ সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা বাবাসাহেব আম্বেদকরের বিখ্যাত বক্তৃতাই ছিল, এডুকেট, অ্যাজিটেট অ্যান্ড অর্গানাইজ! অর্থাৎ শিক্ষাদান করো, আন্দোলন করো এবং সংগঠিত করো।
ক্রমেই যেন বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা, নীতির বিরুদ্ধাচারণ মানেই হল দেশের বিরুদ্ধাচারণ। সরকার যা করবে, যা বলবে সেটাই মেনে নিতে হবে বিনা প্রশ্নে। এটা স্বাস্থ্যকর গণতন্ত্র নয়। একটি শাসক দলের কাছে সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ হল, বিরুদ্ধ মতের থেকেও সমর্থন আদায় করে নেওয়া। বিরুদ্ধ মতকে সম্মান দিয়ে একটি আলোচনা ও চর্চার স্পেস দেওয়া। বিরুদ্ধ মতকে দূরে সরিয়ে দিলে, ভয় দেখালে সেটি কিন্তু স্তিমিত হয় না। বরং আরও ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়। ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসই সাক্ষী। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার অমিত শক্তিশালী। আশা করা যায়, তারা নীতির পরিবর্তন করে এই আগ্রাসী প্রবণতা থেকে সরে আসবে।
এই প্রবণতা প্রতিবেশী একটি দেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। চীন। ওই দেশটি চলছে ‘ওয়ান নেশন ওয়ান পার্টি’ সিস্টেমে। তাদের দেশকে সকলে হয়তো সমীহ করে, কিন্তু বিশ্বাস করে না। আমাদের দেশে আজকাল এই ধরনের স্লোগান সরকারের কাছে খুব প্রিয়। মাঝেমধ্যেই শোনা যায় ওইসব প্রকল্প। ‘ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন’, ‘ওয়ান নেশন ওয়ান রেশন কার্ড’, ‘ওয়ান নেশন ওয়ান হেলথ কার্ড’ ইত্যাদি। আমরা এভাবে ওই প্রতিবেশী দেশটিকেই আমাদের গোপন আদর্শ মডেল হিসেবে পরিণত করছি না তো? গোটা পৃথিবী কিন্তু আমাদের শত দারিদ্র্য, বহু সঙ্কট, জনসংখ্যার চাপ সত্ত্বেও এক ও একমাত্র একটি কারণে শ্রদ্ধা করে, সমীহ করে এবং সম্মান দেয়। যেটা আমাদের পাশের ওই দেশে নেই। আমাদের ৭৫ বছর ধরে আছে। আজকের দুনিয়ায় যা সবথেকে মূল্যবান! ডেমোক্রেসি! বাক স্বাধীনতা! ১৯৭৫ সালে একবারই এই ব্যবস্থাকে রুদ্ধ করা হয়েছিল। পরিণতি কী হয়েছিল? ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়াই বুদ্ধিমানের লক্ষণ!