গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
আয়েশার বক্তব্য ছিল, কিছুদিন আগেও ওই দ্বীপে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ছিল শূন্য। কিন্তু এখন দিনে কমবেশি ১০০ জন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। কেন্দ্র এখানে এমন একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন যিনি ‘জৈব অস্ত্র’। টিভি চ্যানেলের বিতর্কসভায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এমন মন্তব্যের অভিযোগে আয়েশার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা দায়ের করে বিজেপির লাক্ষাদ্বীপ শাখা। আয়েশার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা ছাড়াও বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের অভিযোগ আনা হয়।
যদিও এই অভিযোগকে সম্পূর্ণ ‘মিথ্যে’ ও ‘অনৈতিক’ বলে দাবি করে বিজেপি ছেড়েছেন দলের একাধিক নেতা। সেই তালিকায় রয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ মুল্লিপুঝাও। লাক্ষাদ্বীপের বিজেপি সভাপতি আব্দুল খাদেরকে একটি চিঠি লিখে নিজেদের পদত্যাগের কথা জানিয়েছেন নেতারা। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্য প্যারাডাইস ইন ইন্ডিয়ায় হঠাৎ‘গেরুয়া অ্যাজেন্ডা’-র আতঙ্ক!
গ্রেপ্তারি, প্রতিবাদ, জমায়েত, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়। কিন্তু কী এমন হল যে মাত্র ৬০-৭০ হাজারের আবাস, আপাত শান্তিপ্রিয় এবং কখনওই সে অর্থে কোনও মেনস্ট্রিম রাজনৈতিক কারণে খবরের শিরোনামে উঠে না আসা লাক্ষাদ্বীপকে নিয়ে এত আলোচনা শুরু হয়েছে? কৃতিত্ব সেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। যাঁর ঘনিষ্ঠ গুজরাতের বিজেপি নেতা প্রশাসক নিযুক্ত হয়েই লাক্ষাদ্বীপকে ‘গেরুয়া অ্যাজেন্ডা’-র রসায়নাগার বানিয়ে তুলেছেন। লাক্ষাদ্বীপ এখন বিজেপির ক্ষমতা প্রদর্শনের নির্লজ্জ আস্ফালন। ফলে, মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছেন দ্বীপবাসী।
কেন্দ্রশাসিত লাক্ষাদ্বীপে কোনও বিধানসভা নেই। নিজস্ব কোনও মুখ্যমন্ত্রী নেই। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বলতে এখান থেকে নির্বাচিত একজন সাংসদ রয়েছেন। বর্তমানে এনসিপির মহম্মদ ফয়জল এখানকার নির্বাচিত সাংসদ। তাছাড়া এখানে স্থানীয় সরকার বলতে রয়েছে পঞ্চায়েত। এই পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের স্থানীয় বাসিন্দারাই নির্বাচিত করেন। আর আছেন একজন মনোনীত প্রশাসক। যাঁকে কেন্দ্রের তরফে নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। লাক্ষাদ্বীপবাসী কিন্তু চিরকালই নিজস্ব সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে খুব শক্তিশালী এবং অনন্য করে রেখেছে। ইউনিয়ন টেরিটোরি হওয়ার সুবাদে এখানকার প্রশাসক এতদিন বুরোক্রাসি থেকেই নিযুক্ত হতো। মোদি শাসনে সেই ধারায় ব্যতিক্রম ঘটিয়ে গুজরাতের এক বর্ষীয়ান বিজেপি নেতাকে এই পদটি দেওয়া হয়েছে। প্রফুল্ল খোড়া প্যাটেল। আপাদমস্তক আরএসএসের ঘরের লোক। গত ছ’মাস ধরে তিনি লাক্ষাদ্বীপের শাসনকর্তা।
২০১০ সালে অমিত শাহকে যখন সিবিআই অ্যারেস্ট করে, সেই সময় ওই বিজেপি নেতা গুজরাতের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মন্ত্রী হন। প্রফুল্ল প্যাটেল এতদিন ধরে খবরে চর্চিত হয়ে আসছেন বিভিন্ন কু-কারণে। মোদি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রফুল্ল প্যাটেলকে কেন্দ্র শাসিত দমন ও দিউয়ের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এখানেও আইএস, আইপিএসের ট্র্যাডিশন ভেঙে প্রথম কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে দাদরা ও নগর হাভেলির প্রশাসক হিসেবেও নিয়োগ করা হয়। সর্বত্রই এই প্যাটেল নাকি স্থানীয়দের সর্বনাশ করে নিজের পেটোয়াদের মুনাফার ব্যাপারটি অতি যত্নসহকারে দেখভাল করেন। একসময় দাদরা ও নগর হাভেলির দীর্ঘকালীন সাংসদ মোহন দেলকারের আত্মহত্যার তদন্তেও তাঁর নাম উঠে এসেছিল। অভিযোগ, প্যাটেল ছিলেন দেলকারের আত্মহত্যায় প্ররোচক। কিন্তু এই আত্মহত্যা সেই সময় সংবাদমাধ্যমে কোনও প্রচারই পায়নি, যেখানে সুশান্ত সিংয়ের আত্মহত্যার খবর সংবাদমাধ্যম বিরতিহীনভাবে প্রচার করে গিয়েছে। দেলকারের আত্মহত্যার তদন্তের জন্য কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থাও মুম্বইতে উড়ে আসেনি।
ছ’মাস আগে সেই তাঁকেই দেওয়া হয় লাক্ষাদ্বীপের দায়িত্বও। ক্ষমতায় বসেই জারি করেছেন কুখ্যাত নিয়মাবলি। যেমন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (৯৭ শতাংশ) দ্বীপে গোমাংস নিষিদ্ধ হবে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে বন্ধ হবে আমিষ। এত কালের নিষেধাজ্ঞা তুলে গোটা দ্বীপপুঞ্জে মদ বিক্রি শুরু হবে পর্যটনের যুক্তিতে। প্রতিটি ব্যাপারেই সেখানকার ‘জাতীয়তাবাদী’ হিন্দুত্ববাদ বনাম আঞ্চলিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বন্দ্ব তৈরি করা হয়েছে। এমনই একগুচ্ছ খসড়া আইন এনে তুমুল চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছেন লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসক প্রফুল্ল খোড়া প্যাটেল।
লাক্ষাদ্বীপে এখন সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক প্রফুল্ল প্যাটেলের প্রস্তাবিত ভূমিসংস্কারের পরিকল্পনা নিয়ে। এতে শাসকের হাতে জমি অধিগ্রহণের এবং ইচ্ছেমতো স্থানীয়দের পুনর্বাসন দেওয়ার বিপুল ক্ষমতা তুলে দেওয়ার কথা বলা আছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বীপপুঞ্জের সমস্ত খনি এবং খনিজ পদার্থ নিয়ে যথেচ্ছাচার করা যাবে। প্যাটেলের তৈরি নিয়ম মোতাবেক যাঁদের দু’টির বেশি সন্তান আছে, তাঁদের পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়ার অধিকার থাকবে না। মজার কথা, এই নীতিতে চললে বিজেপির ৩০৩ জন সাংসদের মধ্যে ৯৬ জনই কিন্তু আর ভোটে লড়াই করতে পারবেন না। কিন্তু এই নিয়মের ফাঁসে শুধু ভুগতে হবে লাক্ষাদ্বীপের মানুষকেই। ১৫টি স্কুল বন্ধ করে দেওয়া, সরকারের বিভিন্ন স্তরের অস্থায়ী কর্মীদের ছাঁটাই, দ্বীপে বহিরাগতদের বাধ্যতামূলক কোভিড টেস্ট বন্ধ করা সহ একাধিক জনবিরোধী কেরামতির অভিযোগ উঠেছে প্রফুল্ল প্যাটেলের বিরুদ্ধে।
এই দ্বীপপুঞ্জের সমস্ত দ্বীপগুলি মিলিয়ে মোট স্থলভাগের পরিমাণ মাত্র ৩২ বর্গ কিলোমিটারের মতো। যেখানে গাড়ি খুব কম চলাচল করে। অধিকাংশই টু-হুইলার। অথচ, জাতীয় সড়কের মতো সড়ক গড়ার জন্য এখানে উদ্যোগ নিয়েছেন প্রফুল্ল প্যাটেল। প্রশ্ন উঠছে, সেখানে হাইওয়ে গড়ার জন্য হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলে জৈব বৈচিত্র ধ্বংস করার যৌক্তিকতা কী? বুলডোজার দিয়ে এখানকার গরিব মানুষের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার কী যৌক্তিকতা আছে? বাণিজ্যিকীকরণের লক্ষ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দ্বীপের প্রাণী সম্পদ বিকাশ দপ্তর। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বড় ডেয়ারি ফার্মগুলিকেও বন্ধ করার। সেই নির্দেশের জেরে সেখানকার অস্থায়ী কর্মীদেরও বরখাস্ত করা হয়েছে এবং নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে দপ্তরের প্রাণিসম্পদ। এর পাশাপাশি সেখানে গুজরাতকেন্দ্রিক সংস্থাকে দুধ এবং দুধজাত সামগ্রী বিক্রির জন্য একতরফা অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ, গুজরাতের স্বার্থ দেখতেই তাঁর এই পদক্ষেপ। ফলে দ্বীপবাসীদের ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়েছে।
শুনলে অবাক হবেন, লাক্ষাদ্বীপে এখন গুন্ডা অ্যাক্ট বা প্রিভেনশন অব অ্যান্টি-সোশাল অ্যাকটিভিটিজ (পাসা) রেগুলেশন অনুযায়ী, যে কাউকে এক বছরের জন্য জেলবন্দি করে রাখা যাবে। কাকপক্ষীও জানতে পারবে না। অথচ, লাক্ষাদ্বীপে অপরাধের হার দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। আপাতদৃষ্টিতে এই সমস্ত নিয়মাবলি নাকি চালু করা হবে দ্বীপমালার অর্থনৈতিক অবস্থাকে উন্নত করার জন্য এবং মালদ্বীপের মতো ট্যুরিস্ট স্পট গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু এই উন্নয়নের ঢাকের বাদ্যিতে চাপা পড়ছে না প্যাটেল কোম্পানির অন্য খেলা। স্থানীয় মানুষের মালিকানাধীন জমি হস্তান্তরের ফিকিরে কর্পোরেটের কাছে বিকিয়ে যাবে ছবির মতো সুন্দর সমুদ্রতীর। কারণ, জমি কেড়ে নেওয়ার আইনে স্পষ্ট করে বলা আছে জমির মালিকের রাজি হওয়া বা না হওয়ায় কিছুই যায় আসবে না। এমনকী যৎসামান্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে কি না তা নির্ভর করবে প্রশাসনের মর্জির উপর।
এর মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। সৈকত থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে জেলে সম্প্রদায়কে। এমনকী তাদের নৌকো রাখবার লেগুনগুলিও বেহাত হয়ে গিয়েছে রিসর্ট তৈরির পরিকল্পনায়। তারা এখন কর্মহীন। প্রতিবাদ করলেই জেলে চালান হওয়ার ভয়। অনেকেই বলছেন, এই রিসর্টগুলির মালিকরা বেশিরভাগই নাকি গুজরাতি বড় ব্যবসায়ী। সমুদ্রতীরই যদি বানিয়াদের কাছে বেহাত হয়ে যায়, তাহলে কী হবে এই প্রবাল প্রাচীরের? কী হবে যুগ যুগ ধরে বহমান ভুমি সংরক্ষণ, সমুদ্র ব্যবহারের পরম্পরা নির্দেশিত যাপনের? এখানকার বাস্তুতন্ত্রনির্ভর অর্থনীতি, সামুদ্রিক মৎস্যশিকার, নারকেল চাষ, শুটকি মাছের কেনাবেচা। তাকে তছনছ করে, পারস্পরিক সহযোগিতা, সহিষ্ণুতা এবং নির্ভরতার সামাজিক বাতাবরণকে ধ্বংস করে বিজেপি লাক্ষাদ্বীপকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে চাইছে। যেমন চেয়েছিল এই বাংলাকে ধ্বংস করতে।
শশী থারুর বলেছিলেন, ‘‘বিজেপি প্রথমে নির্বাচনে নিজেদের জেতা জায়গাগুলোকে ধ্বংস করে। তারপরে যেখানে তাদের কোনও অস্তিত্ব নেই, সেগুলোকে নিয়ে পড়ে। তাদের নীতিই হল—‘বাগে যদি না-আসে, তা হলে ভাঙো’।’’ মানুষও বুঝতে পারছে, মোদি জমানা মানে—দেশবাসীর সঙ্গে সম্পর্ক শুধু মালিক আর চাকরের। শাসিত এবং শোষিতের! আসলে গোটা দেশজুড়ে এখন এক কর্তৃত্বপরায়ণ ‘বিগ বস’ জাতীয় নেতৃত্বব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি, যা ভিন্নমত বা কোনও বিকল্প শক্তি কাঠামো সহ্য করতে পারে না। বাংলার মানুষকে কুর্নিশ, তাঁরা লাক্ষাদ্বীপের মতো এ রাজ্যে ধ্বংসলীলা চালানোর আগেই থমকে দিয়েছেন মোদির অঙ্গুলিহেলন!