দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
মমতা আবার ক্ষমতার কেন্দ্র। ক্ষমতা গুড়ের মতো বিশিষ্ট। ক্ষমতালোভীদের সঙ্গে কিছু রাজনীতিককে পৃথক করার চেষ্টা আর ছায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা একই। দেখলেন তো—গীতা, কোরান, বাইবেল আউড়ে, এমনকী দলত্যাগ-বিরোধী আইনটাইন করে কিছু হয় না। লোক দেখানো বিতর্ক একটা জিইয়ে রাখা যায় মাত্র। পিপীলিকা দল গুড়ের চারপাশে ভিড় করবেই। যেহেতু নলেন ডেলাটা প্রত্যাশার থেকে বড়, তাই সৌরভ বেশি ছড়িয়েছে, ভিড়টা বাড়ছে দ্রুত এবং অবশ্যই বেশি হচ্ছে।
এটাই হওয়ার ছিল। দিলীপ ঘোষরাও জানতেন। অন্যদিকে দিলীপবাবুদের খোয়াব পূরণ হলে যা ঘটত, তা অনুমান করার জন্য কোনও পুরস্কার হয় না। কিন্তু দিলীপবাবুদের সর্বনাশের শুরুটা বড় তাড়াতাড়ি হল। এটাই বোধহয় ধাক্কা তাঁদের কাছে। বাড়তি ধাক্কা এই যে ত্রিপুরাতেও ভাঙছে বিজেপি। গড়ছে তৃণমূলের পাড়। স্রোতস্বিনী নদীর ব্লু প্রিন্ট যেমন হয়। বিজ্ঞানভিত্তিক ‘চর্বিতত্ত্ব’ আউড়ে দিলীপবাবু
নিজেকে শান্ত করতে পারেন, কিন্তু তাতে দলের শেষরক্ষা হবে কি?
মনে পড়ছে কি বিজেপির বাবুরা? —‘আমাদের সঙ্গে … জন তৃণমূল এমপি, এমএলএ যোগাযোগ রাখছেন! বিজেপিতে জয়েনের অপেক্ষা মাত্র।’ এখনও কি তাঁরা রাখছেন যোগাযোগ? প্রশ্নটা অবশ্যই বোকা বোকা শোনাচ্ছে। কিছুদিন মিডিয়ায় জোর প্রচার হল ‘বঙ্গ বিজেপি’ বলে একটা কথা। অল্পদিনেই প্রমাণ হয়ে গেল, ‘বঙ্গ বিজেপি’ বলে আসলে কিছু ছিল না। বিজেপির বাংলায় তৈরি প্রোডাক্ট কিছু নেই। সবটাই ট্রেডিং। এক্সপোর্টাররা হাত তুলে নিয়েছে, মার্কেটের অবস্থা ভালো নেই বুঝে। এখন ঝগড়াঝাঁটিই সার। আগামী দিনে চরমে উঠবে। কেঁচো খুঁড়তে বেরবে কেউটে। আগে লড়াই ছিল আদি-নব্যের। বিজেপির হাঁড়ির খবর হাতিয়ে কেটে পড়া লোকজনই কেউটে খুঁজতে জান লড়িয়ে দেবে এবার। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও হারাবে ঝগড়া মেটাবার আগ্রহ। বেনিয়াদের দ্বারা পরিচালিত পার্টি জানে, এই মার্কেটে ইনভেস্টমেন্ট করা মানে পুঁজি, উদ্যম—দু’টোই জলে দেওয়া।
চারজন এমপিকে বিধানসভায় টিকিট দিয়েছিল বিজেপি। কোচবিহারের নিশীথ প্রামাণিক ও রানাঘাটের জগন্নাথ সরকার কোনওক্রমে জিতেও ‘দিল্লি চলো’ ডুয়েট গাইলেন। রাজ্যসভার চেহারা আর উপনির্বাচনের বিপদ মাথায় রেখে তাতে দলেরও সায় রয়েছে। স্বপন দাশগুপ্ত মশায় প্রমাণ করলেন—তিনিও নিতে এসেছিলেন; বাংলাকে, এমনকী বাংলার বিজেপিকে কিছু দিতে আসেননি। বাবা তারকনাথের ক্ষেত্র বিমুখ করতেই তিনি ঝাঁকের কই! রাষ্ট্রপতি ভবনকে ব্যবহার করে পার্টি ফিরিয়ে দিয়েছে তাঁর রাজ্যসভার পদ। যেসব অভিনেতা, অভিনেত্রী এসেছিলেন ভোটের নিউ মার্কেট আলো করে, রেজাল্টের পরদিন থেকে তাঁরাও বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁরা শীত বর্ষার কেউ নন, সবাই আসলে বসন্তের কোকিল। বসন্ত আসবে বলেও কথা রাখেনি, তাহলে তাঁরা কথা রাখেন কী করে? ‘বঙ্গ বিজেপি’ অনন্ত শীত-বর্ষায় ডুবে গেলে তাদের কী আসে যায়! একটা জিনিস পরিষ্কার হচ্ছে যে, বাঙালির ক্যারেক্টারের সঙ্গে বিজেপি বস্তুটা মোটে যায় না, শ্যামাপ্রসাদের (মুখোপাধ্যায়) পার্টি হলেও না, তেলে-জলে মিশ খায় না যেমন।
এই সমস্যা শুধু বাংলার থাকবে বলে মনে হয় না। হাতি হাবরে পড়লে ব্যাঙ প্রজাতিও নিজের পায়ের জোর পরখ করে নিতে ব্যগ্র হয়। ইতিমধ্যেই বার্তা দিতে শুরু করেছে জেডিইউ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় সম্ভাব্য রদবদল নিয়ে। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এরকম শরিকের সংখ্যা বাড়বে। অকালি দল, শিবসেনা, এলজেপি প্রভৃতির দিকে ফিরে দেখুন মনে পড়ে যাবে।
রবিবার দিলীপ ঘোষ বললেন, দলবদল এখন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিজেপি কোনও কামাবার জায়গা নয়। ত্যাগ স্বীকার না করলে বিজেপিতে জায়গা নেই। পুরনো কর্মীরাই নাকি দলের সম্পদ! কান পাতুন, শুনতে পাবেন—ঘোড়াদের বিকট হাস্য! চোর পালাবার পরই রাজনীতিকদের বুদ্ধির স্ফুরণ হয়। আর সেই বুদ্ধিতেই উত্তরবঙ্গ নিয়ে নতুন ব্লু প্রিন্ট রচনা করছে বিজেপি। উত্তরবঙ্গ থেকেও সাফ হয়ে যাওয়ার রাস্তা ক্লিয়ার করছে নাকি তারা? মোদি বাহিনী ভুলে যাচ্ছে, উত্তরবঙ্গবাসীও প্রথমে বাংলার মানুষ, পরে অন্যকিছু। মোদির ‘সোনার বাংলা’ ফেরির চটক দেখেই বহুজন ভোট দিয়েছিলেন। একটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পাওয়ার জন্য ভোটের লাইনে দাঁড়াননি।
মমতার সঙ্গে সম্মুখসমরে হেরে গিয়েছেন, সেটা নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের সমস্যা। বিজেপির এই চরম ব্যর্থতার যন্ত্রণা উত্তরবঙ্গের নিরীহ মানুষজনের উপর চাপানো হলে তাঁরা মানবেন কেন? কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ললিপপে খুশি হওয়ার পরিবর্তে কেন্দ্র-বিরোধী লড়াই এবার অন্যমাত্রা নেবে। ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালি কেন্দ্র-বিরোধী। সারা ভারতের রাজধানী যখন কলকাতা ছিল, তখনও রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত ছিল। স্বস্তি পেতে ইংরেজ শেষমেশ রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে দীর্ঘ ও আন্তরিক লড়াই যদি কারও থাকে সে এই বাঙালির, বাংলার মাটি থেকে, এবং দিল্লির বুকে দাঁড়িয়েও।
কংগ্রেস ও বাম আমলে অবহেলিত উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের জন্য মমতা গত দশবছরে যা করেছেন তার তুলনা নেই। এখনও অনেক কাজ নিশ্চয় বাকি। সেই অসম্পূর্ণ কাজ করার জন্য তাঁর আন্তরিক চেষ্টা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। এই ভোটে বিজেপির মুখরক্ষা করেছে উত্তরবঙ্গ। এবার সেই মুখটাই পোড়াবার বন্দোবস্ত পাকা হচ্ছে দেখছি!
এতে দলবদলের খেলা থামবে? মোটেই না। এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কটি বরং রাজনীতিহীনতার। ভারতীয় রাজনীতি যতদিন থাকবে ‘আয়ারাম গয়ারাম’ গল্পের নটেগাছ মুড়োবে না। যাঁকে নিয়ে এই নয়া ঈশপের গল্প রচিত হয়েছে তাঁর আসল নাম গয়ালাল। ১৯৬৭-র বিধানসভা ভোটে হরিয়ানার হাসানপুর থেকে ‘নির্দল’ প্রার্থী হিসেবে জেতেন। অতঃপর যোগ দেন কংগ্রেসে। সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যে তিনবার দল বদল করেন: যথাক্রমে কংগ্রেসকে টাটা করে ইউনাইটেড ফ্রন্ট, আবার কংগ্রেস, তার ন’ঘণ্টার ভিতরে ফের ইউনাইটেড ফ্রন্ট!
গয়ালাল যখন কংগ্রেসে ফিরলেন মাঝখানে, কংগ্রেসের রসিক নেতা রাও বীরেন্দ্র সিং তাঁকে সামনে রেখে প্রেস কনফারেন্সে বললেন, ‘গয়ারাম এখন আয়ারাম।’ অমনি প্রবাদবাক্য হয়ে গেল!
দলবদলের এই পালা যখন মঞ্চস্থ হচ্ছে তখন মুখ্যমন্ত্রী ভগবৎ দয়াল শর্মা। ভদ্রলোকের সেন্স অফ হিউমার ছিল লা জবাব। এমএলএ হস্টেলের দিকে যাওয়ার সময় পার্ষদদের বলছেন, ‘দেখো, বুঝিয়ে সুঝিয়ে কয়েকজনকে আবার দলে ফেরানো যায় কি না।‘ ঠিক তখনই এক অনুচর এসে শোনালেন, ‘স্যার, পণ্ডিত তুহিরামও দল ছেড়েছেন!’ মুখ্যমন্ত্রী হুকুম দেন, ‘ফোন করো তুহিরামকে’। সভয়ে অনুচর বললেন, ‘কোনও লাভ নেই। খবরটা রেডিয়োতেও বেজে গিয়েছে!’ তুরন্ত মন্তব্য বেরিয়ে এল ভগবতের মুখ থেকে, ‘দেখো, পণ্ডিতাইনও (তুহিরামের স্ত্রী) হয়তো অন্যদিকে!’ শেষমেশ রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয় হরিয়ানায়।
হাল ছাড়েননি গয়ালাল। ১৯৭২। গয়ালাল প্রবেশ করলেন আর্যসভায়। তার দু’বছর বাদে চরণ সিংয়ের লোকদলে। ১৯৭৭। লড়লেন জনতা পার্টির টিকিটে। জিতলেনও। ১৯৮২। নির্দল হিসেবে লড়লেন। হারলেন। এটাই তাঁর শেষ ভোটসফর। সম্পূর্ণ হল একটি রঙিন বৃত্ত। ২০০৯ সালে মারা যান গয়ালাল।
দেহ সরে গেলেই যবনিকা পড়ে না এই ভারতে। দেহাতীত কিছু একটা রয়েই যায়। তাই বলতেই হচ্ছে, ভারতীয় রাজনীতির দোসর হয়েই থাকবে ‘আয়ারাম গয়ারাম’ কালচার। দল বা রাজনীতিকে বাঁচাতে হলে বঙ্গভঙ্গের নতুন ধুয়ো তুলে কোনও লাভ নেই। রাজনীতির কেন্দ্র বা প্রাণ যে মানুষ তাদের প্রকৃত কল্যাণের জন্য পরিকল্পনা করুন বিজেপির রক্ষাকর্তারা। একুশের বিচ্ছিরি পরাজয়ের ভিতরেই রয়েছে পরিকল্পনা রচনার বিপুল রসদ। পরাজয়ের কারণ ব্যবচ্ছেদ করা দরকার এখনই—আন্তরিকতার সঙ্গে ও নিরপেক্ষভাবে। ৫ মে ‘রাজধর্ম পালনের শপথ’ শিরোনামের বিশেষ নিবন্ধে লিখেছিলাম: ‘কিছু মাননীয় সদস্যের দলবদল শুধু সময়ের অপেক্ষা। তাঁদের দেখাদেখি সরু চ্যানেল খুঁজবেন আরও অনেকে। অর্থাৎ রিভার্স ফ্লো আসন্ন। বিজেপির সাইজ আরও ছোট হবে বলেই আশঙ্কা হচ্ছে।’ ২০২৪-এর আগে এই ছবি সর্বভারতীয় রূপ পাবে বলেই আশঙ্কা করছি আজ।