দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
হ্যাঁ, এটাই এই মুহূর্তে মোদির সামনে সবথেকে বড় সত্য। বাংলার ভোটে পরাজয়ের টিকা কপালে লাগিয়ে বিজেপি এখন থেকেই নেমে পড়েছে উত্তরপ্রদেশের ভোট নিয়ে। কিন্তু সেখানেও সিঁদুরে মেঘ, শিরে সংক্রান্তি। পথের কাঁটা সেখানে কিন্তু বিরোধীরা নয়। সেখানে মোদির পথের কাঁটা যোগী আদিত্যনাথ। গত চারমাস দু’জনে মুখোমুখি হননি। যোগীকে ডেকে পাঠালেও তিনি মোদিকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। চলছে দু’পক্ষের নার্ভের লড়াই।
লড়াইটা অবশ্য অনেক আগেই শুরু হয়েছে। যেদিন থেকে আরএসএস সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মোদির পরবর্তী প্রজন্ম যোগী, সেদিন থেকে দ্বন্দ্ব শুরু। তারপর থেকেই ঘুঁটি সাজিয়েছেন মোদি এবং অমিত শাহ মিলে। সেই লক্ষ্যে উত্তরপ্রদেশে গত বছর রাজ্যপাল করে পাঠানো হয় মোদির নিজের লোক গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আশি বছরের আনন্দীবেন প্যাটেলকে। সেই একই লক্ষ্যে এ বছরের জানুয়ারি মাসে গুজরাত ক্যাডারের আইএএস অরবিন্দ শর্মাকে অবসর করিয়ে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি পার্টিতে যোগদান করানো হয়। পিছন থেকে মোদির এই অঙ্গুলিহেলনের কারণ সম্পর্কে ভালোই জানতেন যোগী। তিনি জানতেন ২০২২ সালের নির্বাচনে অরবিন্দ শর্মাকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্যই এই উদ্যোগ। কিন্তু এরপরে উত্তরপ্রদেশে রাজনীতির চাকা আরও ঘুরে যায়।
উত্তরপ্রদেশে এখন ভোটের আগেই যোগীকে সরানোর সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা করে ফেলেছেন ত্রিমূর্তি, মোদি-শাহ-নাড্ডা। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ফেরার কোনও চান্স নেই। তাই যোগীকে সরানোর উদ্যোগ শুরু হয়েছে। যোগীকে সরিয়ে তাঁর গত চার বছরের ব্যর্থতা কোনওভাবে ঢাকা না গেলে উত্তরপ্রদেশেও লজ্জার হার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে বিজেপিকে। গত নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে মোদি জিতেছিলেন নিজের ক্যারিশমায়। এবারও তিনি নিজের মুখ দেখিয়ে জিততে চাইছেন। কিন্তু মোদি বুঝতে চাইছেন না, ২০১৭ সালে তাঁর যে মুখ ছিল, আজ আর তা নেই। তাঁর নিজের ক্যারিশমাই এখন নিভন্ত প্রদীপের মতো।
এরমধ্যে মোদি দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারি বি এল সন্তোষকে পাঠিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশে। উদ্দেশ্য যোগীকে সরানোর জমি প্রস্তত করা। মোদি-অমিতের টিপস পেয়ে সন্তোষ রাজ্যের মন্ত্রী ও বিজেপি বিধায়কদের নিয়ে একটি ছক কষেছেন, যাতে তাঁরা যোগীর বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করে অভ্যুত্থান করেন। সেটা কতটা সফল হবে, তা এখনও জানা যাচ্ছে না। তবে সন্তোষ দিল্লি ফিরে মোদিকে যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, যোগীর নেতৃত্বে নির্বাচন হলে বিজেপি একশো আসনও পাবে না।
উত্তরপ্রদেশ নিয়ে মোদির এই আগ্রহের কারণ আছে। প্রধানমন্ত্রী জানেন, উত্তরপ্রদেশে বিজেপির জয়ের স্বপ্ন যদি গঙ্গায় লাশের মতো ভেসে চলে যায়, তবে ২০২৪-এ দেশের নির্বাচনে তাঁর নিজেরই ভাণ্ডাফোঁড় হয়ে যাবে। তাই এই মুহূর্তে যে কোনও প্রকারে উত্তরপ্রদেশের দুর্গ বাঁচাতে মরিয়া মোদি। তিনি জানেন, উত্তরপ্রদেশে হারলে তাঁর দেশসেবার এই চাকরি কেউ বাঁচাতে পারবেন না। পশ্চিমবঙ্গের মতোই বিজেপির অবস্থা হবে সারা দেশে। এ রাজ্যে বিজেপির এখন না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থা। রাজ্যে বিজেপির পার্টি অফিসগুলোতে রাখা শ্রীরামচন্দ্রের ছবিতে ধূপধুনো দেখানোরও লোক নেই। জেলায় জেলায় পার্টি অফিসের তালা খুলতে গিয়ে কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন দিলীপ ঘোষ। তাঁরা এখন সরাসরি তাঁর দিকে আঙুল তুলে বলছেন, ভোটের আগে আপনি যেভাবে উস্কানিমূলক হিংসার কথা বলেছেন, তার ফলভোগ আমাদের করতে হচ্ছে। প্রত্যেক ক্রিয়ারই তো সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। এর মধ্যে আবার আর এক ধিক্কৃত গেরুয়া নেতা বাঙালির পিঠে ছুরি মারার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন রাজ্যে কাজকর্মে জড়িয়ে থাকা ‘বাঙালিরা সেই সব রাজ্যে চাকরি করতে পারবেন তো’ বলে প্রকারান্তরে তাঁদের উপর আক্রমণে অন্য প্রদেশের বাসিন্দাদের উস্কানি দিচ্ছেন। হায় রে কালিদাস! উক্ত ভাষ্যের আলোকে তাঁর স্বরূপ আর একবার ভালো করে চিনে নিক প্রতিটি বাঙালি।
সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মোদি সাম্রাজ্যের এই ভেঙে পড়ার গল্পের পাশাপাশি রয়েছে আর এক গড়ে ওঠার গল্প। নদীর যেমন একদিক ভাঙে, অন্যদিক গড়ে ওঠে। তেমনই মোদির জনপ্রিয়তার পাড় ভাঙছে। অন্য পাড়ে ক্রমেই জেগে উঠছে মমতা নামের এক নতুন সবুজ, স্বপ্নের ভূমি। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে চোখে চোখ রেখে পাঙ্গা লড়ার শক্তি তিনি আপন ক্ষমতাবলে অর্জন করেছেন। কী আশ্চর্য! ইতিহাস এবং পুরাণের মতো এখানেও তৈরি হয়েছে দাম্ভিক, আপন অহঙ্কারে মত্ত, প্রতিহিংসাপরায়ণ এক শক্তির বিরুদ্ধে এক নারীর জেগে ওঠার গল্প। এভাবেই বোধহয় পুরাণ, ইতিহাস যুগে যুগে সত্য হয়ে ওঠে। শক্তির দম্ভকে ভেঙে চুরমার করে বারবার জয়ী হয় নারীশক্তি। আগামী দিনগুলিতে মমতা সারা দেশের বিরোধী শক্তিগুলির থেকে তিল তিল করে আয়ুধ সংগ্রহ করে পাল্টা আঘাত ফিরিয়ে দিতে অগ্রসর হবেন। তবে ছেড়ে দেবে না বিজেপিও। তাদের কিছু না থাক, টাকার গরম আছে। ছোট ছোট আঞ্চলিক বিরোধী শক্তিকে কিনে নিতে ঢেলে দেবে টাকা। ভয় দেখাবে সিবিআই, ইডির। পাশাপাশি যে কোনও জনমুখী প্রকল্পকে কেন্দ্র আটকে দেওয়ার চেষ্টা করবে। যেভাবে দিল্লিতে বাড়ি বাড়ি রেশন পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি আটকে দেওয়া হয়েছে, সেভাবেই চেষ্টা করা হবে। চেষ্টা করা হবে বাংলার প্রকল্প আটকানোর কিংবা নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে রাজ্যের উপনির্বাচন আটকে মমতাকে বিপাকে ফেলার। এত কৌশল নিয়ে যিনি মাথা ঘামান, তিনি দেশের কাজ করার সময় পাবেন কখন?
মমতাকে অপদস্ত করার সেই কৌশলের অংশীদার ধনকারবাবুও। মোদির সুপারি নিয়ে এরাজ্যে এসেছেন তিনি। সেইমতো কাজ করছেন। মোদির হাতে রাজ্য তুলে দিয়ে বড় পুরস্কারের আশা করেছিলেন। সেটা সফল হয়নি। তাই নিজের উদ্দেশ্য সফল করতে আরও বেশি তৎপর হয়েছেন। কেননা মোদিকে তুষ্ট করতে পারলে সফল হতে পারে তাঁর স্বপ্ন? ভারতের উপ রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্নে তিনি এখন মশগুল। কেননা হাতে আর বেশি সময় নেই। আগামী বছরেই শেষ হচ্ছে উপ রাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডুর মেয়াদ।
পরিস্থিতির বিপাকে মোদিজি বারবার নিজের অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে ফেলছেন। কোনও সমালোচনাই তিনি সহ্য করতে পারছেন না। ভারতের মতো একটি বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশে তিনি সকলের মুখই চাপা দিতে চান। সব বিরোধী নেতাকে বশ্যতা স্বীকার করাতে চান। দেশের মানুষ অন্য সুরে কথা বললেই তাঁরা হয়ে ওঠেন দেশদ্রোহী। সাংবাদিকদের কলমে বেড়ি পড়ানোর জঘন্য ফন্দিও আমরা দেখেছি। জুডিসিয়ারি ব্যবস্থাকে অনেকদিন ধরেই নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে চাইছেন তিনি। কিন্তু জাগ্রত বিবেকের মতো এখনও আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা রয়েছে বলেই আমরা গণতন্ত্রের স্বাদটুকু থেকে বঞ্চিত হইনি। আদালত দেশের শীর্ষ শাসককে মনে করিয়ে দিয়েছে সাংবাদিকদের স্বাধীনতার কথা। আসলে মোদি নিজেই হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন ভারতের প্রতীক। তাই মোদির বিরুদ্ধে কথা বলাটাকেই দেশবিরোধী বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, যেদিন থেকে প্রাক্তন এক প্রধানমন্ত্রী ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’ হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন, সেদিন থেকেই তাঁর পতনের সূচনা। মোদিজিও সেই একই পথের পথিক হয়ে উঠেছেন। পতনের কাউন্ট ডাউন শুরু।