কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
আর এক বালক... ছেলেবেলায় ভাদনগর স্টেশনে বাবার চায়ের দোকানে উদয়াস্ত খাটত সে। আর তার মা আশপাশের বাড়িতে কাজ করতেন। ছেলেকে বড় করতে হবে... মানুষ করতে হবে। এটাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য বাবা আর মায়ের। সেই বালককে কেউ সেদিন প্রশ্ন করেনি, খোকা, তুমি কি বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী হবে? কটাক্ষ করেও না।
দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দু’জনই। প্রথমজন মনমোহন সিং। ভারতীয় অর্থনীতিকে এক নতুন ভিতে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। তার উপরই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে উন্নতির অট্টালিকা। তৃতীয় বিশ্বের তকমা ঝেড়ে ফেলে ভারত এখন দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষক বাজার। আর দ্বিতীয় জন? নরেন্দ্র মোদি।
মনমোহন সিং দশ বছর টানা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নরেন্দ্র মোদিও সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের লক্ষ্যে ছুটছেন। কিন্তু দু’জনের ফারাক কোথায়? প্রথমজন একের পর এক মাইলস্টোন ছুঁয়েছেন। সামাজিক এবং আর্থিক সংস্কার তাঁর ‘শাসনকালের’ ছত্রে ছত্রে। তা সত্ত্বেও ব্যক্তি মনমোহন ছাপ ফেলতে পারেননি জনমানসে। তাঁর প্রচার এবং প্যাকেজ, দুয়েরই অভাব ছিল। বরং গুছিয়ে বলতে গেলে, এই দু’টি ক্ষেত্রেই মনমোহন সিং ছিলেন চূড়ান্ত উদাসীন। আর নরেন্দ্র মোদি? সাত বছরে কী সংস্কার তিনি করেছেন এবং তা আম জনতার কোন কাজে লেগেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু প্রচারে বা প্যাকেজে এতটুকু ঘাটতি নেই। নরেন্দ্র মোদি জমানায় আর একটা শব্দ আমাদের প্রত্যেকের গা সওয়া—প্রোপাগান্ডা। নরেন্দ্র মোদি ভাষণ দিচ্ছেন, মন কি বাত শোনাচ্ছেন, আচমকা ঢুকে পড়ছেন সিবিএসসি বৈঠকে... আর তারপর নিজেই ঘোষণা করছেন, এবার পরীক্ষা হবে না। জানান দিচ্ছেন, তিনি আছেন। সর্বত্র। সিনেমার পর্দায় এক সময় ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, এখন সলমন খান... আর পর্দার বাইরে নরেন্দ্র মোদি। লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ যাঁদের জনপ্রিয়তার হাতিয়ার। ওয়ান ম্যান আর্মি গোছের ব্যাপার। একাই জনা বিশেক শত্রুকে শুইয়ে দিচ্ছেন। চোখা চোখা ডায়লগ ছুড়ছেন। কিন্তু মোদিজি, ব্যাপারটা সিনেমার পর্দায় ভালো লাগে। রোজকার জীবনে নয়। এখানে আমাদের খেতে বসে ভাবতে হয়, রাতের বেলা দু’মুঠো ভাতের সংস্থান আছে তো? গ্যালারি শোতে পেট ভরে না যে! এই তো ক’দিন আগে জাতীর উদ্দেশে ভাষণ দিতে এসে বললেন, ‘করোনা বাড়ছে। কিন্তু যা করার রাজ্যগুলিকে করতে হবে। আর সাধারণ মানুষকে। লকডাউন শেষ অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করবেন।’ তাহলে হুজুর, আপনি কী করলেন? সবটাই যে রাজ্য সরকার আর সাধারণ মানুষ করল! আপনি যেটা করতে পারতেন, ভ্যাকসিনের পর্যাপ্ত জোগান। সে নিয়েও তো রাজ্যগুলির হা পিত্যেশ এই সেদিনও ছিল! আর আজ? করোনা একটু সামাল দিতে না দিতেই ঢাকঢোল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল আপনার সরকার? আপনার ছায়াসঙ্গী অমিত শাহ তো দাবি করছেন, করোনার প্রকোপ কমছে। কেন? আপনি যে মাথার উপর আছেন! আপনার নেতৃত্বেই করোনাকে হারিয়ে দিচ্ছে ভারত। ব্যস! আর কী! বাকিদেরও নির্দেশ দিন নেমে পড়তে। ঠিক যেমন এর্নাকুলাম ও বেঙ্গালুরুতে নির্দেশ গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের বারো ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের বলা হয়েছে, ভিডিও বার্তা ট্যুইট করো। তাতে তোমরা কী বলবে?—‘নরেন্দ্র মোদিজি ধন্যবাদ। আপনি যে পরীক্ষা বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। এই করোনা মহামারীতে আমাদের প্রাণে বাঁচালেন আপনি।’
হোক প্রোপাগান্ডা! মন্ত্র লিখতে হবে, কৃষকের জন্য এক। শ্রমিকের জন্য এক। শিক্ষকের জন্য আর এক। কমোন মন্ত্র অবশ্য একটাই—আচ্ছে দিন। ভ্যাকসিন নীতির ঠিকঠিকানা নেই, রাজ্য সরকার প্রাপ্য টাকা পাচ্ছে না, হাসপাতালে বেড নেই, পেট্রল-ডিজেল রোজ ঊর্ধ্বমুখী, জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া... আচ্ছে দিনের ভালো নমুনা বটে। তাও ঢাক পেটানো চলছে। আমরা তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি। বিশ্বাসও করছি। হয়তো ভবিষ্যতেও করব। এ কি আমাদের দৈন্য? না অসহায়তা? ভারতীয়রা আসলে বড্ড সহনশীল। আরও একটু সুযোগ দিয়েই না হয় দেখি! কিন্তু করোনাকালে এই ভয়াবহ পরিস্থিতির পরও? সংবাদপত্রে একের পর এক চরিত্র গত কয়েক মাসে উঠে এসেছে। আলিপুরদুয়ারের সরকারি হাসপাতালের সেই চিকিৎসক... রাতের ডিউটিতে ছিলেন। একসঙ্গে পাঁচজন করোনা রোগী এসে পৌঁছলেন। প্রত্যেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। কিংবা উত্তরপ্রদেশের জুনিয়র ডাক্তার। টানা প্রায় তিন মাস বিনা ছুটিতে রোগী দেখে চলেছেন তিনি। রোজ সাত-আট ঘণ্টা টানা পিপিই কিট পরে... ভিতরের জামাকাপড় ভিজে সপসপ করে। পিপিইর হাতা, পা চুঁইয়ে পড়ে ঘাম। যেতে পারেন না বাথরুমেও। তারপর যখন সব ছেড়ে হাসপাতালের বাইরে এসে দাঁড়ান... দেখেন, এক বাস ভর্তি রোগী ঢুকছে। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়সই ষাটের উপর। এঁরা সবাই গ্রামীণ ভারত। যেখানে মোদিজির আচ্ছে দিনের প্রোপাগান্ডাটুকুও ভালো করে পৌঁছয়নি। যাঁরা করোনার মোকাবিলা করতে জানেন না। পরীক্ষা করাতে চান না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনওমতে গেলেও রোগীর ভিড়ে প্রাথমিক সুবিধাটুকুও পান না। এরপরও দাবি করেন, আপনারাই সামাল দিয়েছেন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ? যেমন দাবি জাতির উদ্দেশে ভাষণেও করলেন মোদিজি। ভাব দেখালেন, রাজ্যগুলোকে সুযোগ দিয়ে দেখেছিলেন। অনেক হয়েছে, এবার ভারত সরকারই টিকার দায়িত্ব নেবে। কিন্তু এর নেপথ্যে সুপ্রিম কোর্ট এবং বাংলার মতো রাজ্যের চাপ কতটা কাজ করল, সেটা প্রকাশ হল কি?
ঠিক দশ বছর আগের কথা... ৪ জুন, ২০১১। লখনউয়ে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে একটি প্রস্তাবনা এনেছিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। ইউপিএ সরকারকে ‘দেশের ফেডারেল কাঠামোর জন্য সিঁদুরে মেঘ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন তিনি। কী কী অভিযোগ ছিল তাঁর? ১) রাজ্যগুলির আইন প্রণয়নের ক্ষমতায় দখলদারি চালাচ্ছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। ২) কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির অপব্যবহার চলছে। ৩) সাংবিধানিক সংস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যগুলির অধিকার হরণ করা হচ্ছে এবং ৪) রাজ্যপালদের রাজনৈতিক এজেন্ট হিসেবে রাজ্যগুলির মাথায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘অ-কংগ্রেসি রাজ্যগুলি তাদের অধিকারের জন্য আর্তি জানাচ্ছে। কিন্তু সেই কান্না ফিরে আসছে কিছু বধিরের কানে ধাক্কা খেয়ে।’ কে ছিলেন সেই মুখ্যমন্ত্রী?—নরেন্দ্র মোদি। আজ, তাঁর সাত বছরের শাসনকালের পর এই প্রত্যেকটি অভিযোগে অভিযুক্ত তাঁর সরকার। সিবিআইয়ের অবাঞ্ছিত অতি সক্রিয়তা হোক, কিংবা ভ্যাকসিন—সর্বত্র এক নজির দেখছে দেশ। মোদিজির শাসনতন্ত্রে তো আবার নতুন প্রতিপক্ষও তৈরি হয়েছে—আমলা মহল। আলাপন বন্দ্যোধ্যায়কে অবসরের লগ্নে নাস্তানাবুদ করার প্রবল চেষ্টা চলেছে দিল্লির দরবার থেকে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, তাঁকে দিল্লি টেনে নিয়ে গিয়ে একবার হলেও মাথা নিচু করানো... ক্ষমা চাওয়ানো। সেই অভিপ্রায়ে জল পড়ে গিয়েছে। আর কীভাবে তাঁকে অপদস্থ করা যায়, আপাতত সেই ছক কাটা চলছে রাজনীতির অন্দরমহলে। কিন্তু আঁতে ঘা যে বড্ড জোর লেগেছে! একজন ‘সামান্য’ আমলার কি না এত বড় সাহস! এক আলাপন মাথা তুলেছে মানে তো বাকিরাও তুলতে পারে! সবার ডানা ছেঁটে দাও। নির্দেশ জারি করল মোদি সরকার... অবসরের পর মুখ খোলা, বই লেখা যাবে না। তার জন্য ছাড়পত্র নিতে হবে কেন্দ্রীয় ভিজিলেন্স কমিশনের। অর্থাৎ, চাকরি শেষেও টিকিটি বাঁধা থাকবে শাসনতন্ত্রের ছড়িতে। শুধুই কি তাই, বই লিখতে গেলেও লাগবে সরকারি অনুমোদন। অর্থাৎ, অপছন্দের আইএএস, আইপিএস অফিসারদের তালাবন্দি করে দেওয়া গেল। তাহলে ছাড় কারা পাবে? অবশ্যই যাঁরা সরকারের প্রোপাগান্ডা করবেন তাঁরা! নরেন্দ্র মোদি জমানায় ভারত ‘উন্নতির কোন শিখরে’ পৌঁছলেন, তা লিখবেন অবসরপ্রাপ্তরা। পুনর্বাসন পাবেন সেই অফিসাররা, যাঁরা সরকারের তাঁবেদারি করেছেন। এর ব্যতিক্রম হলেই যে বিপদ! সরকার চালাতে হবে! সংসদের অন্দরে বিরোধীরা কিস্যু করতে পারবে না। কারণ, বিজেপি সেখানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ। গেরুয়াধারী নেতারা আসবেন, আর জয় রাজার জয় বলে স্লোগান দেবেন। বেসুরো যে হবে, তার নিস্তার নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার টুঁটি চেপে ধরা হবে। বদলে দেওয়া হবে সমাজটাই।
মনমোহন সিং একটা কথা বলতেন... ‘আমি পাকেচক্রে প্রধানমন্ত্রী হয়ে গিয়েছি।’ সেই পাকেচক্রে প্রধানমন্ত্রী তথ্য জানার অধিকার আইন চালু করেছিলেন। তাঁর জমানায় এসেছিল খাদ্য সুরক্ষা, ১০০ দিনের কাজের ব্যাপ্তি। আর নরেন্দ্র মোদি? নোট বাতিল, অপরিকল্পিত জিএসটি-লকডাউন, পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, উত্তরপ্রদেশের গঙ্গার ধারে লাশের মিছিল। আর বিরোধী ‘নিকেশের’ নামে রাজদণ্ডের অপপ্রয়োগ তো ছিলই। তাঁর লক্ষ্যই যে ছিল ‘শিখর’। তিনি মনমোহন সিং হতে চান না। কারণ, মনমোহন সিংয়ের সরকারের উপর... দেশের উপর কমান্ড ছিল না। নরেন্দ্র মোদির আছে। সত্যিটা কিন্তু একটু আলাদা... নরেন্দ্র মোদি চাইলেও মনমোহন সিং হতে পারবেন না। কারণ, মনমোহনের চরিত্রের একটি দিক যে কখনওই মোদির ভাগ্যে জুটবে না... সর্বশক্তির ধারক-বাহক হওয়া সত্ত্বেও না। মানবিকতা।