কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
সময় বদলেছে... বদলায়নি ছবিটা।
মতু কাশ্যপ গিয়েছিলেন বাবা প্যায়ারে লালকে দাহ করতে। পারেননি। চাষের জমিতে সামান্য কাজ করেন মতু। এই ক’দিন আগেও পোড়ানোর কাঠ বিক্রি হচ্ছিল ৬০০ টাকা কুইন্টালে। মতু গিয়ে দেখলেন, ওটাই হাজার টাকা চাইছে। তিন কুইন্টাল অন্তত কাঠ লাগবে... মানে ৩ হাজার টাকা। ডোম আর পুরুত মেলালে আরও দেড় হাজার। সাড়ে চার হাজার টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ্য মতুর নেই। তাই গঙ্গার চরে নিয়ে এসেছেন বাবাকে। বালি খুঁড়ে সেখানেই কবর দেবেন। ক্ষমতা নেই নাপিত প্রদীপ কুমারেরও। করোনা তাঁদের সবকিছু নিংড়ে নিয়েছে। গত বছর গ্রামের দিকে অতটা হয়নি, কিন্তু এখন? ছারখার হয়ে যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশের গ্রামের পর গ্রাম। কাজকর্ম নেই বহুদিন... আধপেটা খেয়ে বা ভুখা পেটে থাকা মানুষগুলোর কাছে শবদেহ একটা বড় বোঝা। তা সে যতই নিকটাত্মীয়ের হোক না কেন!
এবারও যে ফিরে এসেছে সেই ক্ষমতা দখলের লালসা, দাঁত-নখ বের করে রাখা এক পশু—রাজনীতি... যা দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে উদাসীন করে রেখেছে। এ রাজ্য থেকে ও রাজ্য... তাঁরা সফর করেছেন দখলের লক্ষ্যে। সত্যিকারের সতর্ক হওয়ার সময় গেরুয়া শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাক পিটিয়েছেন, করোনা জয় হয়েই গিয়েছে। ভ্যাকসিন এসেছে। দু’বার ছুঁচ ফুটিয়ে নিলেই হল। আর তারই মাঝে শক্তি সঞ্চয় করে সুনামির মতো আছড়ে পড়েছে ভাইরাস। যার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামের শিকড়ে।
গ্রাম নিয়ে বড্ড বেশি চিন্তা নরেন্দ্র মোদির। আগে আমরা তাঁর মুখে শুনেছি, তিনি দেশের ছ’লক্ষ গ্রামকে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কে মুড়ে দেবেন। আর বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবেন সাড়ে ১৮ হাজার গ্রামে। এ না হয় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। মানতেই হবে, প্রতিশ্রুতি ডেলিভারির জন্য মারাত্মক হোম ওয়ার্ক করেন তিনি। কিন্তু খানিক স্বল্পমেয়াদি চিন্তাভাবনাও তো করতে হয়! করোনা ভাইরাস তার প্রথম ঢেউয়ে মূলত শহরগুলির দিকে নজর দিয়েছিল। মেট্রো শহর বা টাউন। দ্বিতীয় ঢেউ আর সেই ছোট পরিধিতে আটকে নেই। কোভিডের ব্যাপ্তি আজ বিরাট। বিশ্বের অন্য দেশে করোনার পরবর্তী ঢেউ আছড়ে পড়ার সময় ভারত সরকার কী করছিল? শুধু ঢাক না পিটিয়ে খানিকটা দূরদর্শী হওয়ার প্রয়োজন ছিল না কি? এখন গ্রামাঞ্চলে মূল সমস্যা কী? সংক্রমণ হলে পরীক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত কিট নেই। আর পজিটিভ হলে নেই চিকিৎসা ব্যবস্থা। শহরে এনে চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য আর যাই হোক, মতু কাশ্যপ বা প্রদীপ কুমারের থাকে না। সেই সংস্থানের ব্যবস্থা আপনারা করেননি। নোট বাতিল এবং অপরিকল্পিতভাবে জিএসটি কার্যকরের পর কত লোকের কাজ গিয়েছিল? সরকারি হিসেবের খাতায় খুঁজতে যাবেন না। অর্ধেক তথ্যও তাতে নেই। ছোট ছোট কাজের মধ্যে দিয়ে দিন গুজরান করা লাখো মানুষ তখন থেকেই আতান্তরে। গত বছর কোভিডের লকডাউন তাঁদের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতেছে। বলেছিলেন, চেন ভাঙার জন্য এই লকডাউন প্রয়োজন। সেই চেন ভাঙা যায়নি। নিজের নিয়মে সংক্রমণের গ্রাফ শিখরে উঠেছে, তারপর তার পতনও হয়েছে। আর আপনারা ভেবেছেন, মহামারী বিদেয় হল। শতবর্ষ আগের স্প্যানিশ ফ্লু, প্লেগ বা কলেরার মড়ক... এত সহজে তো কোনওটাই দূর হয়নি! হতে পারে আমাদের কারও কাছে করোনা মহামারী সংক্রান্ত কোনও তথ্য ছিল না, কোনও ফর্মুলাও ছিল না। কিন্তু শিক্ষাটুকু তো ছিল! ইতিহাস রয়েছে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই। নিম্নমুখী গ্রাফ দেখে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসাটা আর যাই হোক, দূরদর্শী সরকারের চরিত্র নয়। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে চিকিৎসা পরিকাঠামো উন্নত করা, বা করোনার জন্য প্রত্যন্ত এলাকাগুলিকে তৈরি করার জন্য ওই সময়টাকে কাজে লাগানোই যেত! নাঃ, সে সব আপনাদের ধাতে সয় না। আপনারা বরং অ-বিজেপি নেতানেত্রীদের সঙ্গে ইগোর লড়াইয়ে বেশি আগ্রহী। বাংলায় হিন্দু-মুসলিম ভোটের ভাগাভাগি, উম-পুনের মতো বিপর্যয়ে পর্যাপ্ত সাহায্য পৌঁছে না দেওয়া... এ আপনাদের প্রিয় খেলা। আজ গ্রাম নিয়ে উদ্বেগে ‘কুমিরের কান্না’ কেঁদে কি আর সংক্রমণ কমবে?
করোনা গোটা বিশ্বের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে। এর নেপথ্যে কতটা প্রকৃতি রয়েছে, আর কতটা বিশ্ব-রাজনীতি, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে, চলবে। মোদ্দা কথাটা হল, ১৩৫ কোটির ভারতও তো এই দুর্ভাগ্যের কবলে! এটা এড়ানো যায়নি। কিন্তু ভয়াবহতা এড়ানো যেত... প্রয়োজন ছিল সঠিক পদক্ষেপের, সুবিচারের। এই সুবিচার কোনও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হয় না। গণতন্ত্রের আদালতে নির্বাচিত সরকারকে করতে হয় এর জবাবদিহি। যে কোটি কোটি ভোটার আপনাদের ভোট দিয়ে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সোনায় মুড়ে ক্ষমতায় নিয়ে এল, তাঁদের জন্য আপনারা আজ শ্বাসবায়ুর ব্যবস্থাটুকু করতে পারছেন না! অক্সিজেনের অভাবে পিঁপড়ের মতো মরতে হচ্ছে মানুষকে। এটা দুর্ভাগ্য নয়, এটা অবিচার। যা ভারতবাসীর প্রাপ্য নয়। আজ আপনাদের মনে হচ্ছে, গ্রামের দিকে একটু নজর দেওয়া দরকার। রাজ্যগুলিকে বলছেন, ঘরে ঘরে করোনা কিট পৌঁছে দাও। অক্সিমিটারের ব্যবস্থা করো। প্রয়োজন হলে হাসপাতালে পাঠাও। এই উদ্যোগ এতদিন কোথায় ছিল? প্রথম দফার জয়গান গাওয়া থেকেই যে আপনাদের এতদিন ফুরসৎ ছিল না! ফল যা হওয়ার, তাই হয়েছে... গঙ্গার চরে হাজারে হাজারে পড়ে আছে লাশ। ভেসে যাচ্ছে নদীর জলে। শুধুই তো আর অর্থাভাব নয়, কাজ করছে তীব্র আতঙ্ক... মহামারীর। করোনা রোগীকে কেউ ছুঁতে চাইছে না। মোদিজি, এটা ব্যর্থতা। আর এই ব্যর্থতা আপনারও। রাজ্যের উপর দায় চাপিয়ে দিলেই জামায় লেগে থাকা দাগটা পরিষ্কার হয়ে যায় না। দু’টাকা কেজি চাল দিলে তার কৃতিত্ব আপনার, গ্রামে রাস্তা হলেও সেটা প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার জন্য, আর মৃত্যুমিছিলের দায় রাজ্য সরকারের? আসল কথাটা হল, দেশের মানুষকে আপনি সচেতন করে তুলতে পারেননি। বারবার রাত ৮টায় টিভির সামনে বসলে, বা রেডিওতে আপনার ‘মন কি বাত’ শোনালেই দেশবাসী সচেতন হয় না, শিক্ষিতও হয় না। আপনি আসলে দেশের ‘মন কি বাত’ কখনও শোনেনইনি। শুনলে বহু আগেই আপনার সরকারের কর্মীদের, দপ্তরগুলিকে নির্দেশ দিতেন... গ্রামে যাও। সচেতন করো মানুষকে। বোঝাও...। জ্বর হলে পাড়াগাঁয়ের মানুষ ভাবছেন, সাধারণ ভাইরাল ফিভার। পরীক্ষা করানোটাই যেন তাঁদের কাছে আতঙ্ক। বহু বাড়াবাড়ির পর যখন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। আর সেই শবদেহের পরিজনরা? গত পাঁচ বছরে তারা ভাতে মারা গিয়েছে। না আছে চিকিৎসার খরচ, না আছে সৎকারের। এ সবে আপনার মাথাব্যথা নেই। আপনার সরকারও এসবের অনেক ঊর্ধ্বে। আপনার প্রশাসন বরং সেই সব ‘দুষ্কৃতী’দের গ্রেপ্তারে বেশি আগ্রহী, যাঁরা আপনার বিরুদ্ধে পোস্টার সাঁটে। আর তাঁরা কারা? কেউ দিনমজুর, কেউ প্রিন্টার, আবার কেউ অটোচালক। কী এমন লিখেছিলেন তাঁরা পোস্টারে? আর্তি ছিল একটাই, ‘মোদিজি, আমাদের বাচ্চাদের ভ্যাকসিন কেন বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন?’ এ যে ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রদ্রোহ! আপনার মতো বিশ্বনেতাকে কি ভারতের ছোট্ট পরিধিতে আটকে রাখা যায়? রাষ্ট্রসঙ্ঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে গর্বের সঙ্গে আপনার প্রতিনিধি বলেন, দেশে যা ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে, তার থেকে বেশি পরিমাণ ডোজ ভারত সরকার বিদেশে ‘সাহায্যার্থে’ পাঠিয়েছে। দেশের লোক মরে মরুক, বিশ্বের দরবারে নম্বর বাড়ানোর যে আত্মশ্লাঘা, তা কি আর ১৩০ কোটি ভুখা-নাঙ্গা মানুষকে স্বস্তি দিয়ে মিলবে? ওদের জন্য বাণীই কাফি। প্রতিশ্রুতির আকাশ-কুসুম জলে গুলে ওরা ঘুমোতে যাবে। কারও ঘুম ভাঙবে, কারও নয়।
আমতলাতেই পড়ে থাকবে ‘মতি মুচিনী’দের দেহ। কত লোক দেখতে আসবে। দূর থেকে দেখবে। তারপর চলে যাবে। মনে একরাশ আতঙ্ক নিয়ে... এই দশা কাল আমাদেরও হতে পারে। গঙ্গার চরে লাশের সংখ্যা বাড়বে... প্রতিদিন। যার হিসেব তোলা হবে না রোজকার বুলেটিনে।
আচ্ছে দিন বোধহয় এসেই গেল!