গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
কোনও দলই দায় এড়াতে পারে না। নানা ধরনের বাধা সত্ত্বেও কিছু দল ভীষণই চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ হোঁচট খেয়েছে। কিছু দল সত্য ধামাচাপা দিয়েছে এবং ভরসা রেখেছে ধাপ্পাবাজি আর তর্জন-গর্জনের উপর। আর এই বাস্তবের শিকার একজনই—মানুষ।
এই ভয়ানক বিপর্যের মূল দায়টা কার, বিতর্কে তার কোনও নিষ্পত্তি হবে না। কারণ এটা যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বিচারের যুগ নয়। বরং কিছু তর্কাতীত বিষয়কে নতুনভাবে উপস্থাপন করাতেই অধিক বিচক্ষণতার পরিচয় মেলে। তারপর প্রশ্নগুলোর উত্তরের জন্য প্রতিটি মানুষের সামনে রাখতে হবে। এই বিষয়ে আমার তালিকাটি এইরকম:
চাহিদা বনাম জোগান
১. বেসিক টেবল
শুরুর দিন টার্গেট গ্রুপ জনসংখ্যা (প্রায়)
১৬.০১.২১ হেলথকেয়ার ওয়ার্কারস ৭০ লক্ষ
ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কারস ২ কোটি
০১.০৩.২১ ৬০ ঊর্ধ্ব এবং কোমরবিড ৪৫-৫৯ বর্ষীয় ২৬ কোটি
০১.০৪.২১ ৪৫-৫৯ বর্ষীয় অন্যরা
০১.০৫.২১ ১৮-৪৪ বর্ষীয় ৭৩ কোটি
প্রতিটা টার্গেট গ্রুপের সাইজ বা জনসংখ্যা সরকারের জানা রয়েছে। সুতরাং দিনক্ষণ অনুযায়ী কত ডোজ ভ্যাকসিনের প্রয়োজন সেটা হিসেব করে নেওয়া সম্ভব। তবু সেটা করা হয়নি। হিসেবটা খুব সোজা, টিকাকরণের লক্ষ্য যতজন মানুষ তাকে
২ সংখ্যা দিয়ে গুণ করলেই প্রয়োজনীয় ডোজের সংখ্যা বেরিয়ে আসবে। এটাই হল চাহিদার দিক। প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে উঠেই ভ্যাকসিন ডোজের চাহিদার হিসেবটা করে নেওয়াই যেত। কিন্তু সেটা মোটেই করা হয়নি।
২. সিরাম ইনস্টিটিউট এবং ভারত বায়োটেক—এই দু’টো ভারতীয় সংস্থার ভ্যাকসিন তৈরির ‘রেটেড’ ক্যাপাসিটি (আদর্শ পরিস্থিতে যন্ত্র সর্বাধিক যত পরিমাণ উৎপাদনে সক্ষম) সরকারের জানা ছিল। এরপর নির্ণয় করে নিতে হতো প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা কত এবং সেটা বাড়িয়ে নেওয়া যায় কীভাবে। ফ্যাক্টরি ইনসপেকশন এবং নির্দিষ্ট সময়ে অডিটের মাধ্যমে এটা করা যেত। এটাও কখনও করা হয়নি।
টিকা ছাড়াই টিকাকরণ!
৩. ভ্যাকসিন সরবরাহের জন্য সিরাম ইনস্টিটিউট এবং ভারত বায়োটেক সংস্থাকে কেবলমাত্র ১১.০১.২১ তারিখে একবার ঠিকঠাক অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। নিজেরা ঝুঁকি নিয়ে সংস্থা দু’টো ভ্যাকসিন তৈরি করে যে স্টক বানিয়েছিল, প্রাথমিক সাপ্লাইটা পাওয়া গিয়েছিল সেটা থেকে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সংস্থা দু’টোকে উৎসাহিত করা হয়নি। অমূল্য সময় ও সুযোগ নষ্ট করা হয়েছে এইভাবেই।
৪. উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অন্তত একটা সংস্থার (সিরাম ইনস্টিটিউট) এবং সম্ভবত তাদের দু’টোরই, বাড়তি পুঁজির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা এখনও অবধি মঞ্জুর করা হয়নি। ১৯.০৪.২১ তারিখে কিছু ‘সাপ্লাই অ্যাডভান্স’-এর কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। এটা সরবরাহ বাবদ অগ্রিম প্রদানেরই সমান। এটাকে কোনওভাবেই, উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য, মূলধন মঞ্জুর বা ঋণ প্রদান বলা যাবে না।
৫. ভারতে প্রস্তুত ভ্যাকসিন রপ্তানির অনুমতি ছিল গত মার্চ পর্যন্ত। মাত্র ২৯.০৩.২১ তারিখে রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তার ভিতরেই ৫ কোটি ৮০ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন রপ্তানি করা হয়ে গিয়েছে।
৬. ফাইজার ভ্যাকসিনের ইমার্জেন্সি ইয়্যুজ অ্যাপ্রুভাল আটকে দেওয়া হয়েছিল। পরিণামে কী হল? ফাইজার কোম্পানিও তাদের আবেদনপত্রটা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তৃতীয় ভ্যাকসিন হিসেবে স্পুটনিক ভি’কে ইমার্জেন্সি ইয়্যুজ অ্যাপ্রুভাল দেওয়া হল এই ১২ এপ্রিলে। ফলে, তাদের প্রথম কনসাইনমেন্ট ভারতে পৌঁছতে লেগে গেল ১ মে পর্যন্ত। এ-পর্যন্ত আর কোনও ভ্যাকসিন ভারতে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি অথবা আমদানি করা হয়নি।
৭. স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গত বছর যতটা বাড়ানো হয়েছিল সেসব অক্টোবর, ২০২০-র পরই নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়। গত মার্চে সেকেন্ড ওয়েভের ধাক্কা লাগতেই হাসপাতালে বেড, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন ট্যাঙ্কার/ কনসেনট্রেটর প্রভৃতির উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। তারপরই সেসব নতুন করে খাড়া করতে হয়েছে।
৮. ফার্স্ট ওয়েভ একটু থিতিয়ে যেতেই করোনার টেস্ট লক্ষণীয়ভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়। যখন নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমে যাবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সংক্রামিতের সংখ্যাটাও লঘুভাবে চিহ্নিত হবে। টেস্টিংয়ে গতি আনা হয়নি। আকাশ যখন আলো ঝলমলে ছিল ছাদটাকে তখন মেরামত করা হয়নি। তাই বৃষ্টি নামতেই ঘরের ভিতরে জল পড়ছে।
৯. দৈনিক টিকাকরণের সংখ্যাটা বৃদ্ধি করার পরিবর্তে কমানো হয়েছে। ২ এপ্রিল ৪২ লক্ষ ৬৫ হাজার ১৫৭ ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল। সংখ্যাটা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ওই এপ্রিল মাসে টিকাকরণের দৈনিক গড় ছিল মাত্র ৩০ লক্ষ। এরপর মে মাসে এসে দৈনিক টিকাকরণের হারটা সাড়ে ১৮ লক্ষে নেমে গেল! মোদ্দা কথা হল, পর্যাপ্ত সাপ্লাইয়ের অভাবেই ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রামটার এখন শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
অস্বীকার, আরও অস্বীকার
১০. একটা জরুরি পরিস্থিতিতে সম্ভাবনাময় সম্পদের ব্যবহার বিষয়ে যে ধরনের পরিকল্পনা হওয়া দরকার তা ছিল না। যেমন—অক্সিজেন সোর্সের শক্তিবৃদ্ধি করা, নাইট্রোজেন/ আরগন ট্যাঙ্কারকে অক্সিজেন ট্যাঙ্কারে রূপান্তর, অক্সিজেনের জন্য পিএসএ প্ল্যান্ট আমদানি করা কিংবা বসানো, এবং অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও ভেন্টিলেটর আমদানি ও মজুত করার জন্য যে প্ল্যান দরকার ছিল সেসব করাই হয়নি। নার্স এবং প্যারামেডিক্যাল কর্মীদের সংখ্যা বৃদ্ধিরও কোনও পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।
১১. দ্বিতীয় ওয়েভের শুরুতে ভেবে নেওয়া হল যে, এটা ফার্স্ট ওয়েভের মতোই আচরণ করবে—ধীরে ধীরে বাড়বে, তারপর একটা সমতলে চলে আসবে এবং গ্রাফটা শেষমেশ নীচের দিকেই নেমে যাবে। বহু কৌণিক ছবিটার কথা কল্পনা করা হয়নি। চিন্তার মধ্যে ছিল না সবচেয়ে দুর্দিনের কথাটা। এই কারণে করোনার দ্রুত বৃদ্ধি এবং দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার বিষয়টি মোকাবিলা করার পরিকল্পনা অনুপস্থিত ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে এটাও ধরে নেওয়া যায় যে, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ ঢেউ রুখে দেওয়ার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়নি।
১২. জনস্বাস্থ্যমুখী কোনওরকম ‘আইইসি’ নেই— মানে ইনফরমেশন (তথ্য), এডুকেশন (শিক্ষা) এবং কমিউনিকেশন (যোগাযোগ) নেই। ফার্স্ট ওয়েভের সময় সরকারের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল প্রচার, ঠমক প্রদর্শন আর বিজয়োৎসব কেন্দ্রিক। অন্যদিকে, সেকেন্ড ওয়েভের সময় সরকার অস্বীকার করার নীতি নিয়েছে। যেমন বলছে, ‘অক্সিজেনের কোনও সঙ্কট নেই।’ আরও দাবি করছে, ‘রাজ্যগুলোর হাতে যথেষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিনের স্টক রয়েছে।’ সরকার আর যে নীতি নিয়েছে তা হল, সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া এবং যাবতীয় দোষ দায় রাজ্যগুলোর ঘাড়ে চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা। তার অনিবার্য ফল হল, বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাওয়া। অন্য যে-কোনও দেশে হলে শীর্ষ পদাধিকারীদের গদি টলে যেত।
রায় ঘোষণার স্বাধীনতা এখন পাঠকের উপর।