বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
একটি দেশে এক মারণরোগ এসেছে। সংক্রমণের ভয়ে মানুষ গৃহবন্দি। সেই দেশে এই চরম দুঃসময়ে পেট্রল ডিজেলের দাম ১০০ টাকা স্পর্শ করছে। কখনও নিত্যপণ্যের দাম এক লাফে ২০ টাকা, ৪০ টাকা, ৭০ টাকা করে বেড়ে যাচ্ছে কেউ জানতে পারছে না। কেন বেড়ে যাচ্ছে জানতে পারছে না। সেই দেশে কেন হঠাৎ একটি ওষুধ, একটি ইনজেকশন উধাও হয়ে যায় বাজার থেকে? কেন পাওয়া যায় চোরাপথে আকাশছোঁয়া দামে? সে পেঁয়াজই হোক অথবা অক্সিজেন সিলিন্ডার! কেনই বা সেই দাম আবার কমে আসে? এই মাঝখানের সময়টায় কারা বিপুল প্রফিট করে? কারা ভাগ পায়? এসব জানা যায় না। আমরা মেনে নিয়েছি।
যখন দিনে ৪ হাজার করে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এই মারণরোগে, মানুষের হাতে রোজগার নেই, জীবনের কোনও মূল্য নেই, তখন প্রত্যেকদিন কী আশ্চর্যভাবে শেয়ার বাজার লাফিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে! সোনার দাম ৫০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। কারা এই সময় মুনাফা করছে? হাসপাতাল আর ওষুধের দোকানে ছোটাছুটি করা মানুষ শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে দেখতে পায় এই মারণরোগ কীভাবে প্রফিটেবল বিজনেসে পরিণত হয়েছে একটি শ্রেণির কাছে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষেও হয়েছিল এরকমই।
আমাদের হাতে টাকা কমে আসছে, আমরা বেশি জিনিসপত্র কিনছি না, দোকান বাজার বন্ধ লকডাউনে, লোকাল ট্রেন ও পরিবহণ বন্ধ। ব্যাঙ্কের লেনদেন কমে গিয়েছে। তাহলে কোন জাদুবলে কর্পোরেট আর শেয়ার বাজারের ইনডেক্স আর প্রফিট বাড়ছে? আমরা বুঝতে পারি না।
সিএমআইই রিপোর্টে বলা হয়েছে, শুধু এপ্রিল মাসে ১১ লক্ষ নতুন করে কর্মহীন হয়েছে। মানুষ জানে না যে, কতদিন তার চাকরিটা আছে। কতদিন তার ব্যবসাটা চলবে। ট্রেনবাসের হকার থেকে শাক বিক্রেতা মাসির বাড়িতে হাহাকার রোজগারের অভাবে। মারণরোগের ওষুধের সঙ্গে, হঠাৎ করে প্রতিদিনের রুটিন ওষুধগুলোও পাওয়া যায় না। করোনার সঙ্গে প্রেশারের ওষুধের সম্পর্ক কী? করোনার সঙ্গে সরষের তেলের দামবৃদ্ধির সম্পর্ক কী? আমরা নিজেদের জিজ্ঞাসা করি। উত্তর পাই না। হাসপাতালের বেড পাই না। অক্সিজেন পাই না। ওষুধ পাই না।
এই সময় গণতান্ত্রিক দেশে সবথেকে বেশি কাকে পাশে পাওয়া উচিত ছিল? রাষ্ট্রকে। কিন্তু আমরা কী দেখতে পাই? দেখতে পাই সেই রাষ্ট্র টিভিতে খবরের কাগজে ট্যুইটারে মানুষকে বাণী দিচ্ছে, লেকচার দিচ্ছে ভ্যাকসিন নিতে। অথচ আমরা রাষ্ট্রের কথা শুনে যখন ভ্যাকসিন নিতে চাইছি, শুনি ভ্যাকসিন নেই। বিরাট কোহলি ভ্যাকসিন পায়। আমরা ছবি দেখি। নিজেরা পাই না। রাষ্ট্র বলছে, অ্যাপের মাধ্যমে ভ্যাকসিন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। অ্যাপ কোথায় থাকে? স্মার্ট ফোনে। ভারতে কতজনের স্মার্ট ফোন আছে? ৭৬ কোটি। ভারতের জনসংখ্যা কত? প্রায় ১৩৫ কোটি। বাকিরা কি তাহলে ভ্যাকসিন পাবে না? রাষ্ট্র বলবে কেন ওয়েবসাইটে গিয়ে করো! ওয়েবসাইট মানে ইন্টারনেট। ভারতে নন-মোবাইল ইন্টারনেট ইউজারের সংখ্যা কত? ৬২ কোটি। বাকিরা কী করবে? রাষ্ট্র জানায়নি।
রাষ্ট্র এই সময় একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দিল্লিকে সাজানোর প্রকল্প। নাম সেন্ট্রাল ভিস্তা। ২০ হাজার কোটি টাকায়। নতুন পার্লামেন্ট হবে। ইন্ডিয়া গেট থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনের রাজপথকে বদলে ফেলা হবে। প্রধানমন্ত্রীর নতুন বাসভবন হবে। এই ২০ হাজার কোটি টাকায় কী হতে পারত? বিরোধী দলগুলি বলছে, ৬২ কোটি ভ্যাকসিন তৈরি হতে পারত। ২২ কোটি রেমডিসিভির ভায়াল ইনজেকশন হতে পারত। ৩ কোটি অক্সিজেন সিলিন্ডার হতে পারত। ১২ হাজার বেডের ১৩টা এইমসের মতো হাসপাতাল হতে পারত। কিন্তু রাষ্ট্র ঠিক করেছে এই প্রকল্প সম্পন্ন করতেই হবে। কেন? নতুন এক আধুনিক নিউ দিল্লি তৈরি করবে বর্তমান শাসক। ইতিহাসে নিজেদের ছাপ রাখতে।
দিল্লির ইতিহাসে হাত দিলে কী হয়? বিস্ময়কর এক প্রবণতা রয়েছে। মহাকাব্য থেকে শুরু। পাণ্ডবরা এই খাণ্ডবপ্রস্থ জনপদকে বদলে দিয়ে এক নতুন রাজ্য ও রাজসভা প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইন্দ্রপ্রস্থ। সেই প্রতিষ্ঠার পরই রাজসূয় যজ্ঞ। আর ঠিক তারপরই শুরু তাদের দুর্ভাগ্যের যুগ।
পৃথ্বীরাজ চৌহান ঘেকে তুঘলক রাজবংশ। সঈদি পরিবার থেকে সিকান্দর শাহ লোদির বংশ। তাঁরা প্রত্যেকেই দিল্লি দখল করেছেন। এই শহরের মধ্যেই প্রাসাদ, কেল্লা, রাজধানী নির্মাণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। নিজেদের ছাপ রেখে যাওয়ার বাসনায়। বেশিদিন কেউই ক্ষমতায় থাকেনি। দিল্লিকে বদলাতে গিয়ে ক্ষমতাচ্যুত অথবা যুদ্ধে পরাস্ত হতে হয়েছে প্রতিপক্ষের কাছে। নিজামুদ্দিনের ঘিয়াসপুর, গ্রিন পার্কের সিরি। ফিরোজ শাহ কোটলা। তুঘলকাবাদ। আলাউদ্দিন খিলজি থেকে মহম্মদ বিন তুঘলক। প্রতিটি শাসক যুগে যুগে নিজেদের মতো করে দিল্লিকে বদলে দিয়ে নিজের স্বপ্নের রাজধানী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ইতিহাসের পৃষ্ঠা বলছে, আচমকা সেই শাসনকালগুলি থেমে গিয়েছিল। সেই কেল্লা, সেই প্রাচীর, সেই প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ অথবা ভগ্নাবশেষ দিল্লির বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। মোগল সম্রাট হুমায়ুন তাঁর নতুন শহর নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। দীনপনাহ। তারপরই শের শাহের কাছে পরাস্ত হয়ে তাঁকে পালিয়ে যেতে হল। শের শাহের পুত্র সিকন্দর দিল্লিতেই নিজস্ব সেলিমগড় ফোর্ট তৈরি করলেন। নতুন ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে। তারপরই হুমায়ুনের হাতে তাঁকে পরাজিত হতে হল।
১৯১১ সালে হঠাৎ কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী সরিয়ে নতুন শহর পত্তনে মন দিল ব্রিটিশ সরকার। ১৯৩১ সালে সমাপ্ত হল নিউ দিল্লি। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই যেন শেষের শুরু। ১৯৩৫ সালে গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট চালু হল। যা কার্যত নিজেদের হাত থেকে বেশ কিছু ক্ষমতা ধীরে ধীরে চলে যাওয়ার পূর্বাভাস। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক প্রস্তুতি। ইতিহাসে দিল্লিকে যারা বদলে দিতে চেয়েছে, ক্ষমতা প্রদর্শন করে অধিকার কায়েম করতে চেয়েছে, তাঁদের ভাগ্যাকাশে দিল্লি নিরাসক্তভাবে বিদায়বার্তা লিখেছে বারংবার।
মারণরোগের এই মহাদুঃসময়ে দিল্লিকে ফের বদলে দিতে চাইছে আজকের শাসক নতুন প্রকল্প নিয়ে। আশা করি তাঁরা জানেন এই ইতিহাস প্রবণতা। চ্যালেঞ্জ ওটাই। পারবেন তো ২০২৪ সালে জয়ী হতে? নাকি দিল্লি আর যমুনা উদাসীনভাবে আবার বদলে দেবে শাসক?