কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
চাপের সামনে হিমালয়ও হেলে, কিন্তু বাংলার নিকনো উঠোন ঘেরা ঘরের মেয়ে দশকের পর দশক উন্নতশির। দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। আপসহীন প্রতিবাদী। অপ্রতিদ্বন্দ্বী অগ্নিকন্যা। তাঁর নিজের কথায় আদ্যন্ত এক ‘স্ট্রিট ফাইটার’। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে দিতে পথ প্রান্তর পেরিয়ে আজ তিনি বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল যোদ্ধার আসনে। রাজ্যটাকে বাঁচানোর, পথ দেখানোর দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। বিভাজনের নোংরামি নয়, মেরুকরণের বিষ ছড়ানো নয়, বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইয়ে তাঁর অস্ত্র স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, যুবশ্রী থেকে শুরু করে একের পর এক জনহিতকর উন্নয়ন প্রকল্প। বাঙালি ঘরের মা-বোনেদের সম্ভ্রম রক্ষার ত্রাণকর্ত্রী তিনি। প্রমাণ হল, তাঁকে ভয় দেখানো কোনও চা ওয়ালার বেটার সাধ্য নয়। মোদি-অমিত শাহের পাঠানো বস্তা বস্তা টাকা আর অন্যায়ভাবে তাক করা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে বুক চিতিয়ে তিনি মাঠজুড়ে খেললেন বরাবরের মতো। এবং জিতলেন এক পায়েই। সার্থকভাবেই তিনি বাংলার নিজের মেয়ে।
রবিবার যত বেলা গড়িয়েছে ততই তাঁর অসামান্য হ্যাটট্রিকের ঐতিহাসিক দ্যুতি মনে করিয়ে দিচ্ছিল ছিয়াশির সেই সাড়া জাগানো মারাদোনাকে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মুখ থুবড়ে পড়া দেশ দেখল আত্মনির্ভর ভারতের ব্যর্থ ফেরিওয়ালা মোদিজির নৌকা বাংলায় নোঙর করতে চূড়ান্ত ব্যর্থ। এই সোনার গাঁয়ে সবাই যে নিজের ঘরের মেয়ের অপেক্ষায়। বর্গী, মেনন, যোগী, ভোগীরা এই মাটির গন্ধ পেতে তাই ব্যর্থ! বহিরাগত ও বেইমানরা ব্রাত্য। সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই থেকে উত্তরপাড়া কিংবা ডোমজুড়ের উচ্ছিষ্ট দলবদলুদের এখানে স্থান নেই। সেই জনসমর্থনের জোরেই অসামান্য এক জয়ের রেশ ছড়িয়ে দিলেন বাংলার রাজনৈতিক সম্রাজ্ঞী। গত চার দশকের সার্থক জননেত্রী, যার নজির নেই গোটা দেশে।
স্রেফ কেন্দ্রের শাসক বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে করোনার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ২৭ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল, আট দফার নজিরবিহীন নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। লক্ষাধিক কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মারণ ভাইরাস। এও বাংলাকে মারার আর এক চক্রান্ত। চলেছে পুরনো মামলার ফাইল ঘেঁটে সিবিআই ও ইডির চক্রান্ত সাজানোর যুগলবন্দি। কিন্তু কোনও চাপই তাঁকে তাঁর লক্ষ্য থেকে একচুল হেলাতে পারেনি। এবং ফল বেরতেই আবারও বিজয়ীর বেশে নেত্রী বুঝিয়ে দিলেন এই খেলাটা তাঁর কাছে কতটা চেনা। কতটা সহজাত। নিখুঁত পাস, ফ্রি কিক, ব্যাকভলি, একা বল নিয়ে প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে স্বপ্নের দৌড়, গোল মুখে টাইট ফিনিশিং, বাঙালির প্রিয় ফুটবল মাঠের সবক’টা গুণই একে একে চিনিয়ে দিল রাজনীতির ময়দানে তাঁর অসামান্য ক্লাস। পুরো খেলাটার নেতৃত্ব দিলেন হুইল চেয়ারে বসে। বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর মানুষের মন পড়ে ফেলার অদ্ভুত ক্ষমতাটার ধারে কাছে কেউ নেই। সেই প্রত্যয় থেকেই জখম পা নিয়েই চষে বেড়ালেন পাহাড় থেকে সমুদ্র। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে ফিরিয়ে দিলেন একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ। ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন কিছু দলবদলু বেইমানের অশ্লীল খেউড়। ওরা এবার ব্যর্থতার নিকষ অন্ধকারে হারিয়ে যাক, কারণ মীরজাফরও ওদের অবস্থা দেখে আজ অট্টহাসিতে মশগুল! বিশ্বাসঘাতকদের রাজনৈতিক কেরিয়ারে চূড়ান্ত যবনিকা। আর নেত্রী শুধু জিতলেন না, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সামান্য ডেলি প্যাসেঞ্জার বানিয়ে ছাড়লেন। এবং সব বাধা টপকে গোলও করলেন দুরন্ত ভঙ্গিমায়। একবার নয়, দু’বার নয়, পরপর তিনবার তাঁর এই অসামান্য গোল করা দেখেছে বাঙালি। তবে তাঁর এবারের সাফল্য নিঃসন্দেহে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত হ্যাটট্রিক!
২০১১। ২০১৬। ২০২১। তারও আগের আড়াই দশকের প্রতিনিয়ত সংগ্রামের ইতিহাসই বা কম কীসে! জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা তখন মধ্য গগনে, সিপিএমের নামে বাঘে-গোরুতে একঘাটে জল খায়। ঠিক সেই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়েও তাঁদের মোকাবিলা করেছেন রাস্তায় নেমে। সেই সংঘাত থেকেই ঘটে গিয়েছে ২১ জুলাই, নেতাই, নানুর, বানতলা, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের মতো রাজ্য উত্তাল করা একের পর এক ঘটনা। শেষ পর্যন্ত সাড়ে তিন দশকের জগদ্দল বাম শাসনকে একাহাতে উপড়ে ফেলেছিলেন তিনি। ঠিক দশ বছর আগে তাঁর সেই গোলই সিপিএমের হার্মাদ বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করেছিল রাজ্যটাকে। সেই পালাবদলের পাঁচবছর পর ২০১৬-য় আরও একবার তাঁরই পুনরাবৃত্তি দেখেছিল বাংলা। সেবারও ফের দু’শোর বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফেরে বাংলার মেয়ে। জোট করেও মুখ থুবড়ে পড়েছিল বাম -কংগ্রেস জোট।
আর এই একুশে বাংলার রাজনীতির কাঠামোটাকেই যখন সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপি ভেঙে ফেলতে মরিয়া ছিল। আইডেন্টিটি পলিটিক্সের নামে গোটা সমাজটাকে হিন্দু আর মুসলিম আড়াআড়ি দু’ভাগে ভাগ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলেছে সমানে। সেই সঙ্গে টাকার প্রলোভন আর দুর্নীতির ফাইলকে শিখণ্ডি করে তৃণমূলের ছোট বড় নেতাদের ব্ল্যাকমেল ও দল ভাঙানোর খেলা, সবই চলেছে পাল্লা দিয়ে। বাঙালির অস্তিত্বরক্ষার সেই সন্ধিক্ষণে গেরুয়া শিবিরের যাবতীয় চক্রান্ত ব্যর্থ করে এমন মধুর বদলা, এমন মধুর হ্যাটট্রিক বিশ্বফুটবলের ইতিহাস খুঁড়ে ফেললেও বড় একটা মিলবে না। সেই বিচারে বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতা উত্তর রাজনীতিতে কোনও নারীর এতটা বিরাট ক্যানভাস জুড়ে এমন সাফল্য আর দেখা গিয়েছে বলে জানা নেই। ইন্দিরা গান্ধীকেও আজ যেন মমতার এই সাফল্যের পাশে অনেকটাই খর্বকায় লাগছে। হাওড়া, হুগলি, নদীয়া, পূর্ব বর্ধমান, ঝাড়গ্রাম, দুই ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুর ও কলকাতা এদিন যত গণনা এগিয়েছে তত সবুজ রঙের আভায় চার দিক ঢেকে গিয়েছে। দুই দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদেও ঘাসফুলের দাপট দেখে বিরোধীরা চোখে সর্ষেফুল দেখেছে। এককথায় বাংলা আজ প্রকৃত অর্থেই মমতাময়। সবুজ আবেগের সঙ্গে কোথায় যেন মিশে গিয়েছে আমাদের সামগ্রিক অস্তিত্বটাই।
রাজনীতির কঠিন আবর্তে গত প্রায় চার দশক তাঁকে বরাবরই বিজয়ীর মুকুট পরিয়েছে বাঙালি। এবারের লড়াই ছিল নিঃসন্দেহে আরও অনেক বেশি কঠিন। কারণ প্রতিপক্ষ নরেন্দ্র মোদির দখলবাজ কেন্দ্রীয় সরকার। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে না চেনা, বাংলাকে পদে পদে অপমান করা একটা চরম সাম্প্রদায়িক দলের হাত থেকে রাজ্যটাকে শুধু নয়, তার শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচানোর জীবন বাজি রাখা সংগ্রাম। যুযুধান এই লড়াই সংগ্রামের মোকাবিলা করার যোগ্য আর কে আছেন তিনি ছাড়া। এবং জীবনের এই কঠিনতম ভোটযুদ্ধেও জিতে অসামান্য গৌরবমুকুট তুলে নিলেন তিনি। হাসলেন শেষ হাসি। অতিশয়োক্তি হলেও আবারও বলব, স্বশাসিত নির্বাচন কমিশন, সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, আয়কর দপ্তর আর বাকি আধপোয়া বেইমান দলবদলু সবাইকে হাজার যোজন পিছনে ফেলে তুলে নিলেন বিজয়ীর মুকুট। মানচিত্রে দূরবীন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আব্বাস বন্ধু সিপিএম কিংবা অধীরের কংগ্রেসকে। মুসলিম ভোট ভাঙার বামপন্থী ষড়যন্ত্রও চূড়ান্ত ধরাশায়ী।
আজ খুব মনে পড়ছে ১৯৮৪ সালের কথা। সেই ১৯৮৪ সালে আমাদের ‘বর্তমান’ এর আত্মপ্রকাশের প্রায় একইসঙ্গে সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে যাদবপুরে হারিয়ে নেত্রীর জয়যাত্রারও শুরু। সেই সাফল্যই এক অসামান্য বৃত্ত সম্পূর্ণ করল এই একুশ সালের ২ মে। ৩৭ বছর পর। গোটা কেন্দ্রীয় সরকার ও তার প্রধান দুই কাণ্ডারী নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ গত একবছর ধরে বাংলা দখলের যে ষড়যন্ত্র রচনা করেছিলেন। গোটা রাষ্ট্রশক্তিকে বেপরোয়াভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু ফাইটারের কাছে চক্রান্তটা পরাস্ত হল। মুখোমুখি লড়াই করে তিনি সিপিএমের রক্তচক্ষু উপড়ে ফেলে বাংলাকে নতুন ভোর উপহার দিয়েছিলেন ২০১১-তে। খানাকুল, গোঘাট, আরামবাগে বামেদের একদা মুক্তাঞ্চলে ফুটিয়েছিলেন ঘাসফুল। তারও আগে এআইসিসিকে তোপ দেগে গড়ে তুলেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস। সেটা ছিল ১৯৯৮ সাল। আজ সেই রাজনৈতিক সংগঠনই মহীরুহে পরিণত। এই একুশ সালে তিনি হারালেন বিজেপিকে। রুখে দিলেন নরেন্দ্র মোদির রথ। এই কাজটা একমাত্র তিনিই করতে পারেন এতটা অবলীলায়। একে একে যখন আঞ্চলিক দলগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে তখন গেরুয়া আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশে তিনিই একমাত্র রুখে দাঁড়িয়েছেন সর্বশক্তি দিয়ে। নরেন্দ্র মোদির আজকের এই পরাজয় তাই শুধু বাংলাতে পা রাখতে না পারার লজ্জা নয়, এক ৬৫ বছরের মহিলাকে ক্রমাগত ‘দিদি ও দিদি’ ও ‘জয় শ্রীরাম’ গালাগালি নিক্ষেপ করারও মধুর বদলা। বাংলা ও বাঙালি আজ মমতাময়।