পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
২০২০ সালে আপনাদের সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করতে পারেনি। হাজার হাজার মানুষ হেঁটে গিয়েছে হাজার কিলোমিটার। ২০২১ সালে আপনারা গোটা দেশকে চিকিৎসাই দিতে পারছেন না। মানুষ শুধু রোগাক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে না, দুর্ভাগ্য হল বহু মৃত্যু হচ্ছে চিকিৎসা না পেয়েও। অথচ আপনারা গোটা এক বছর সময় হাতে পেলেন। এই এক বছরে আমরা দেখলাম লাইভ টেলিকাস্ট অযোধ্যা থেকে রামমন্দিরের শিলান্যাসের। কই একটিও হাসপাতাল উদ্বোধন, অক্সিজেন প্লান্ট চালু হওয়া, ওষুধের উৎপাদন কারখানার সূত্রপাত অনুষ্ঠানের লাইভ টেলিকাস্ট তো দেখা গেল না! বিদেশি মুদ্রা উপচে পড়ছে রাজকোষে। ভারত জগৎসভায় একটি সম্মানজনক স্থানে উপনীত। জিডিপি যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক একটি অবস্থানে।
মানুষের কাছে জীবিকা আসছে। বাড়ছে আর্থিক লেনদেন। ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া শীর্ষ স্পর্শ করছে। ঠিক এরকম একটি উজ্জ্বল ভারতকে প্লেটে করে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল আপনাদের জন্য। যারা দিয়েছিল আচ্ছে দিনের জয়ধ্বনি, তারা আশা করেছিল নয়া দিল্লিশ্বর ভারতকে এক স্বপ্নজগতে নিয়ে যাবেন। আমেরিকা আর চীনকে টপকে বিশ্বগুরু হওয়া বোধহয় কয়েকমাসের ব্যাপার। দিল্লিশ্বরই পারবেন। সেই আশায় কোটি কোটি ভারতবাসী অপেক্ষা করল ৭ বছর।
আজ সেই ভারতবাসীকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছেন দিল্লিশ্বর? যারা আজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে ইনকাম ট্যাক্স দিয়ে এল, আজ তারা সামান্য অক্সিজেন না পেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। যারা আজীবন বাধ্য ছাত্রের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়ে গেল, আজ তারা হাসপাতালের একটা বেডও পাচ্ছে না। যারা দিনের পর দিন বছরের পর বছর বিনা প্রশ্নে রাষ্ট্রের সব নির্দেশ মেনে চলল, আজ সেই সাধারণ নিরীহ মানুষের কাছে সেই দেশ অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ৫০ হাজার টাকা চাইছে, অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য ৪৫ হাজার টাকা চাইছে, রেমডিসিভির ইনজেকশনের জন্য ১ লক্ষ টাকা চাইছে, হাসপাতালের গেটে কথা বলতে গেলে লাঠিচার্জ করা হচ্ছে!
দিল্লি আর অমৃতসরে দুটি হাসপাতালে ভর্তি থাকা ৩৩ জন রোগী অকস্মাৎ বুঝতে পারলো তাদের অক্সিজেন মাস্কের অক্সিজেন আস্তে আস্তে কমে আসছে, তারপর অক্সিজেন বন্ধই হয়ে গেল। তাদের সামনে অথবা আড়ালে হাসপাতালের নার্স ও ডাক্তাররা কাঁদছেন। কারণ আর অক্সিজেন নেই একফোঁটাও। এই নার্স ও ডাক্তারদের চোখের সামনে শ্বাস নিতে না পেরে প্রতিটি রোগীর মৃত্যু হল। এই ৩৩ জন কোন দলের সমর্থক ছিল? কী আসে যায়। সোজা কথা হল, অক্সিজেন কেউ পেল না। অথচ তারা ছিল বৈধ নাগরিক। ট্যাক্স দিয়েছে, ভোট দিয়েছে। আধার কার্ড আছে। এনআরসি হলে তারা নিশ্চিতভাবে এদেশের নাগরিক হিসেবে প্রমাণিত হতো। এমনকী গত বছর আপনাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তারাই হয়তো বারান্দায় থালাবাসন বাজিয়েছে, মোমবাতি জ্বালিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র তাদের জন্য কী করল? বুকে অক্সিজেন পৌঁছে দিতে পারল না।
এখন গোটা দেশে একমাত্র আতঙ্ক কি করোনা? না। আর করোনার ভয় তো স্বাভাবিক। মারণরোগ। কিন্তু তার থেকে বেশি আতঙ্ক এই রোগ হলে চিকিৎসার সুযোগ পাবো না। হাসপাতালে বেড পাবো না। অক্সিজেন পাবো না। জীবনদায়ী ওষুধ নেই। এবং দিল্লি থেকে গুজরাতে দেখা গেল অবর্ণনীয় দৃশ্য। শ্মশানেও জায়গা নেই। নেই যথেষ্ট চিতাকাঠ। ফুটপাতে জ্বলছে শব। স্বজনের মৃতদেহের পাশাপাশি চিতাকাঠ খুঁজে আনতে হচ্ছে। এটাই কি পাওনা ছিল সুনাগরিক হওয়া আমাদের? আমরা নিজেদের যোগ্যতায় যে যতটা পারছি জীবিকা অর্জন করছি, ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছি, নিজেদের জীবনকে কেন্দ্র করে আছি। কোনও অন্যায় করিনি রাষ্ট্রের সঙ্গে।
আজ সেই রাষ্ট্রের চোখের সামনে আমরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি।
রাষ্ট্র যখন বলেছে, লকডাউন, আমরা সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিয়ে পালন করেছি লকডাউন। ঘরে বসে থেকেছি। তারপর একদিন ক্যালেন্ডার থেকে যে কোনও একটি তারিখকে লটারির মতো বেছে নিয়ে রাষ্ট্র বলেছে, এইদিন থেকে লকডাউন শেষ। এর নাম দিলাম আনলক। আমরা সেই নির্দেশও নতমস্তকে মেনে নিয়েছি। আপনারা বলেছেন, লোকাল ট্রেন বন্ধ। বাস বন্ধ। আমরা কোনও প্রতিবাদ করিনি। আমাদের জীবিকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই মধ্যবিত্ত থেকে গত এক বছরে নিম্নবিত্তের ক্যাটাগরিতে চলে এসেছি সকলের অলক্ষ্যে। তাও আমরা আপনাদের উপর বিশ্বাস রেখেছি।
আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাওয়া ঠেকাতে সামান্য মাস্ক নাক থেকে নীচে নামালেই ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা রাজ্যভেদে জরিমানা হয়েছে। পুলিস অপমান করেছে। আমরা বাইরে কেন বেরিয়েছি তা জানার প্রয়োজন মনে করেনি পুলিস ও প্রশাসন। তারা আমাদের পোকামাকড় মনে করে। তাই লাঠি তুলে মেরেছে। তাড়িয়েছে গোরুছাগলের মতো। আমরা কোনও আপত্তি করিনি। যদিও দেখেছি নেতারা মাস্ক ছাড়াই প্রচার করছেন, ফোটো সেশন করছেন।
রাষ্ট্র আমাদের বলেছে, ৩৭০ ধারা খুব খারাপ। বন্ধ করে দিলাম। তোমরা জয়ধ্বনি দাও। আমরা জয়ধ্বনি দিয়েছি। রাষ্ট্র বলেছে এনআরসি খুব ভালো। তোমরা আমাদের সমর্থন করো। আমরা বলেছি জয়তু এনআরসি। রাষ্ট্র আমাদের বলেছে রামমন্দির হবে। আমরা বলেছি জয় শ্রীরাম। এসবের বিনিময়ে আমরা ভেবেছি আমরা আরও উন্নত এক জীবনে প্রবেশ করব। কিন্তু কই! এই একটিও ইস্যু আমাদের অক্সিজেন দিচ্ছে না, আমাদের হাসপাতালে জায়গা দিচ্ছে না, আমাদের ওষুধ দিচ্ছে না।
স্বাধীন গণতান্ত্রিক উজ্জ্বল রাষ্ট্রে সবথেকে শক্তিশালী শব্দ হল সোর্স। যার সোর্স আছে সে সময়মতো গ্যাস পেয়ে যায়, হাসপাতালে বেড পায়, অক্সিজেন পায়, খেলার টিকিট পায়। আর আমরা যারা ভেবেছিলাম আমাদের ভোটটা মনে হয় বিরাট শক্তিশালী এক অস্ত্র তারা এখন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এক তেপান্তরের মাঠে। আজ পর্যন্ত কখনও শোনা গেল না কোনও নেতা অথবা মন্ত্রী বেড পাচ্ছেন না। ভ্যাকসিন পাচ্ছেন না, চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
পেনশন নিতে ব্যাঙ্কে আমরা লাইনে দাঁড়াই। নোটবাতিলের পর আমরা এটিএমে লাইন দিয়েছি। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট লিঙ্ক করাতে গ্যাসের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়েছি। এতকাল ধরে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছি। লাইনে দাঁড়ানো আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজ, হঠাৎ আমাদের মনে ভয় ঢুকেছে এই মহামারীতে। বেঁচে থাকার? আমরা ঠিক কোন লাইনে দাঁড়িয়ে আছি এখন? মৃত্যুর? এই কি স্বাধীনতা ৭৫!