পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
তৃতীয় বর্ষে পদার্পণের প্রাক্কালে প্রাসঙ্গিক দু’টি প্রশ্ন রাখা দরকার: (এক) কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা আমরা পেলাম? (দুই) আর সেই শাসনব্যবস্থা আমাদের কী দিল?
২৬ কোটির এক বিপুল সংখ্যক পরিবার প্রতিদিন তাদের পাতে খাবার চায়। সেই সূত্রে আসে আরও কিছু চাহিদা। যেমন নিরাপত্তা, চাকরি, বেঁচে থাকার মতো মজুরি/বেতন/আয়, গৃহ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, সন্তানদের জন্য শিক্ষা এবং আরও কিছু প্রয়োজন।
অপুষ্টির ধাক্কা
ভারত হল প্রধান খাদ্যশস্যের একটি বড় উৎপাদক দেশ। এছাড়া এদেশে বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হয় নানা ধরনের ডাল, দুধ, সব্জি এবং ফলমূল। মাছ ও মাংসের উৎপাদন তো হয়ই। লক্ষ্য হল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের পাতে পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান দেওয়া। আমাদের বিকাশের ধারা অব্যাহত থাকলে এই জোগানের দিকটা প্রতি বছর উন্নততর হওয়া উচিত। শিশুরা পর্যাপ্ত খাদ্য থেকে বঞ্চিত হলে রক্তাল্পতার শিকার হয়ে পড়বে। তাদের ওজন কম হবে। উচ্চতায়ও খাটো হবে তারা। ২০১৫-১৬ সালের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে বা এনএফএইচএস-৪ (এটাই সর্বশেষ সম্পূর্ণ সমীক্ষা) থেকে জানা যায়, ৫৮.৬ শতাংশ শিশুর রক্তাল্পতা ছিল। ৩৮.৪ শতাংশ শিশু ছিল খর্বকায়। ২১ শতাংশের ছিল ভগ্নস্বাস্থ্য। এনএফএইচএস-৩-র উপর উল্লেখযোগ্য উন্নতিটা হয়েছিল একদশক আগে। এনএফএইচএস-৫ শুরু হয়েছিল ২০১৯-২০-তে। কিন্তু তাতেও মহামারীর ধাক্কা এসে লাগল, সমীক্ষাটি সম্পূর্ণ করা যায়নি। যাই হোক, ২২টি রাজ্যের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তা থেকে জানা গিয়েছে যে, ২২টির ভিতরে ১৮টি রাজ্যে রক্তাল্পতা বেড়ে গিয়েছে। শিশুদের খর্বাকৃতির সমস্যা বেড়ে গিয়েছে ১৩টি রাজ্যে। ভগ্নস্বাস্থ্যের সমস্যা বেড়েছে ১২টি রাজ্যে।
উপসংহারটি বড় বেদনাদায়ক: দেশে পাহাড়প্রমাণ খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য খাদ্যের উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ছেলেমেয়েরা পেট ভরে খাবার খেতে পায় না। গরিবরা সবচেয়ে কম খাবার পায়। বাকি সবই যুক্তি মেনে চলে। সাম্প্রতিক কিছু মাপকাঠির কথা বলব। এনডিএ-২ সরকারের সূচনা থেকেই মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি), জিডিপি বৃদ্ধির হার এবং মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ কমে গিয়েছে। বেকারত্ব বৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও কমে গিয়েছে লেবার পার্টিসিপেশন রেট (১৬-৬৪ বছর বয়ঃসীমার মানুষের মধ্যে যাঁরা কর্মরত অথবা কর্মপ্রার্থী তাঁদের নিয়ে এই হার নির্ধারণ করা হয়)। পাইকারি দামের সূচকের (ডব্লুপিআই) বৃদ্ধি এবং খাদ্যদ্রব্যের দামের বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বেড়ে গিয়েছে লিঙ্গবৈষম্যও।
অযোগ্যতার কারণে দুর্দশা
পরিস্থিতিকে ঘোরালো করে তুলেছে মহামারী। দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রথম ঘটনা চিহ্নিত হয় ২০২০-র ৩০ জানুয়ারি। পুনরাবৃত্তি হয়ে যাচ্ছে জেনেও বলছি যে, ভারতীয় অর্থনীতির পতনের সূচনা হয়েছে কিন্তু তার আগেই। অর্থনীতির পতন এবং মন্দাটা ঘটেছিল মানুষের দোষে (ম্যান-মেড)। মহামারীটা একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কিন্তু সেটাকে মানুষই ঘোরালো করেছে। মহামারী এবং অর্থনীতি—এই দু’টি ক্ষেত্রেই দায়ী ক্ষমতাসীন একজন পুরুষ এবং একজন নারী, যাঁরা তাঁদেরকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেন দায়ী তাঁরা নন।
২০২১-২২ অর্থবর্ষের সূচনায় দেখেশুনে বোঝা যাচ্ছিল যে অর্থনীতি আরও একটা বছর ভয়ঙ্কর বছরের ভিতর দিয়ে অতিবাহিত হবে। বহু মানুষের চাকরি চলে যাবে। চাকরি ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে মহিলাদের ক্ষতি হবে বেশি। শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি/বেতন এবং আয়ের উপর একটা ধাক্কা নেমে আসবে। অতি ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প-ব্যবসা (এমএসএমই) ক্ষেত্রের হাজার হাজার সংস্থা বন্ধ হয়ে যাবে। আবার যেগুলি অতি কষ্টে চালু থাকবে সেইসব সংস্থার ব্যবসার পরিধি, আয় এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়ে আসবে সীমিত। ফের ঘটতে চলেছে ‘রিভার্স মাইগ্রেশন’—অর্থাৎ শ্রমিকরা দলে দলে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হবেন। আরও বহু মানুষকে নিক্ষেপ করা হবে দারিদ্র এবং ঋণের ফাঁদে। প্রতিটা মানুষের আরও মন্দদশা হবে। আর সেটা হবে ২০১৯-২০, এমনকী ২০২০-২১ অর্থবর্ষের থেকেও বেশি!
ভগবান না করুন, তবু যেন মনে হচ্ছে লকডাউন অনিবার্য হতে যাচ্ছে। ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, ‘‘২০২০-র কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমরা জিতেছি।’’ আমি অবাকই হচ্ছি, তাহলে আবার একটা লকডাউন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে কেন! এসময় দায়টা ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ঘাড়ে। যদিও, একদিন সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ধাপে ধাপে বন্ধ করা ছাড়া, তাঁদের সামনে বিকল্প কোনও পথ খোলা থাকছে না। আর এসবের মধ্যেই ভ্যাকসিন না-পেয়ে লাখো লাখো মানুষ করোনা সংক্রমণের শিকার হবেন। অক্সিজেন সিলিন্ডার, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ বেড এবং অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধের থেকে বঞ্চিত শ’য়ে শ’য়ে রোগী মারাও যাবেন।
ধাপ্পাবাজি, তর্জন-গর্জন এবং ট্রোল
আর্থিক সঙ্কট এবং মহামারীর মোকাবিলা বলতে সরকার যা করেছে তা ধাপ্পাবাজি আর তর্জন-গর্জন মাত্র। এজন্য বিরোধীদের অসম্মান করা হয়েছে এবং লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে পোষা ট্রোল আর্মিকে। আপনি কল্পনা করতে পারেন:
একজন প্রধানমন্ত্রী একদিন ছাড়া ছাড়া নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিতে উড়ে যাচ্ছেন। বিপন্ন বোধ করছেন যেসব মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ফোন ধরার সময় নেই প্রধানমন্ত্রীর।
একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারবার বিরক্তিপ্রকাশ করে দাবি করছেন যে, ভ্যাকসিন, অক্সিজেন সিলিন্ডার, রেমডিসিভির অথবা হাসপাতালে বেডের কোনও সঙ্কট নেই। তারপরই মন্ত্রী মশায় জনসমক্ষ থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। এক মন্ত্রী মশকরামূলক পরামর্শ দিচ্ছেন যে অনুমোদিত বিদেশি ভ্যাকসিন আমদানি করার অনুমতি দেওয়া উচিত (‘‘তিনি বিদেশি ওষুধ কোম্পানির হয়ে লবি করছেন’’)। কিন্তু সরকার যখন এটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন তিনি অমার্জিত মন্তব্য করে বসেন। আজ তার জন্য দুঃখপ্রকাশ করছেন না মন্ত্রী মশায়।
সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন উৎপাদনে গতি আনার জন্য যখন তিন হাজার কোটি টাকার মূলধনী বিনিয়োগ চাইল তখন একজন অর্থমন্ত্রী মৌনী সেজে রইলেন!
ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার ক্যাপাসিটির বিচারে সারা পৃথিবীর মধ্যে ভারতই শীর্ষস্থানে। অথচ, এমনই একটি দেশের সরকার কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাকসিন মাল্টিপল ফেসিলিটিতে তৈরি করার বাধা দূর
করছে না। ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য কমপালসারি লাইসেন্সিংয়ের মধ্যে
যে ব্যবস্থা রয়েছে সরকার সেটা ব্যবহার করলেই
কিন্তু সমাধান হয়ে যায়।
হাসপাতালগুলির সামনে অ্যাম্বুলেন্সে অ্যাম্বুলেন্সে রোগীদের দীর্ঘ লাইন। শ্মশানে শ্মশানে মৃতদেহ ভরা শববাহী শকটের মিছিল। আর এই নির্মম সত্যেরই বিপরীতে কিছু রাজ্য সরকার সংক্রমণ এবং মৃতের সংখ্যা নিয়ে মিথ্যাচার করছে। এই প্রসঙ্গে গুজরাত ও দিল্লির কথা উল্লেখ করা যায়।
প্রস্তুতকারকদের নানাবিধ দামে ভ্যাকসিন বিক্রি করার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এছাড়া সরকারি খরচে টিকাকরণ কর্মসূচির বাইরে রাখা হয়েছে
১৮-৪৪ বছর বয়সি নাগরিকদের।
দেশের উপর যখন একটা ভয়ংকর বিপর্যয় নেমে আসে তখন শাসক দলের সাংসদরা নীরব দর্শক হয়ে পড়েন এবং কথা বলতেও ভয় পান।
ফোরকাস্টিং, সিনারিও-বিল্ডিং, প্ল্যানিং, অ্যাক্টিভিটি-ম্যাপিং, রিসোর্স অ্যালোকেশন, প্রভিশনিং, কোঅর্ডিনেটিং এবং ইমপ্লিমেন্টিং মিলিয়ে যে গভর্ন্যান্স বা শাসনব্যবস্থা—সেটা চক-ব্ল্যাকবোর্ড, টাইপরাইটার ও আইটিআইয়ে তৈরি কালো টেলিফোনের দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছে। গভর্ন্যান্স জিনিসটার মান রসাতলে চলে গিয়েছে। এর পরিণাম হয়েছে বঞ্চনা, ধারদেনা, রোগভোগ এবং মৃত্যু—যেটা আজ আমাদের চতুর্দিকে চোখে পড়ছে। যেসব মানুষ ২০১৯ সালে ভোট দিয়ে এই সরকারটাকে ক্ষমতায় এনেছিলেন—এসব কি তাঁদের প্রাপ্য? আমি বলব মোটেই না।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত