গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
আমার এক প্রবাসী দাদা বাংলা নববর্ষে ফোন করে প্রশ্ন করছিল, এই যে যুদ্ধের দামামা বাজানো বিস্ফোরক ভোটটা চলছে তাতে রাজ্যের মানুষ কী পেল। ‘সুনার বাংলা’র স্বপ্ন ফেরি করা বহিরাগতরা রবীন্দ্রনাথ-নেতাজির বঙ্গভূমিকে কতটা আপ্লুত করতে সক্ষম হল। আমার উত্তরটা ছিল সহজ। অবিশ্বাসের বিষ আর পরতে পরতে বিভাজন ছাড়া আজ পর্যন্ত মেলেনি কিছুই। উল্টে এই বিষ স্রোত সবাইকে একে অপরের শত্রুতে পরিণত করেছে। সঙ্গে বিপন্ন হয়েছে গণতন্ত্রটাও। উন্নয়নের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে ন্যক্কারজনক ‘বেগম’ তাস খেলতেও পিছপা হয়নি বেইমানরা। অথচ এই নজিরবিহীন পাপাচারের বিরুদ্ধে তেমন কোনও কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দিলীপ ঘোষ বুক লক্ষ্য করে গুলি করার নিদান দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামুলি ব্যবস্থা নিয়েই দায় চুকিয়েছে কমিশন। নিশ্চয়ই এবারের ভোটে একই দোষে দু’রকম শাস্তির প্রাপ্তিটাও একেবারে হেলাফেলার নয়। ওই যে কথায় বলে একজন ভালো মানুষ অনেক সুখস্মৃতি উপহার দেন, আর খারাপ মানুষ দেন তিক্ত অভিজ্ঞতা!
সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার তালিকাটা কিন্তু বেশ বড়। এবারের নির্বাচন থেকে এখনও পর্যন্ত আমরা পেয়েছি একঝাঁক দলবদলু নেতা। সমাজটাকে পঙ্কিল নর্দমায় পরিণত করে জাতপাত আর ধর্মের নামে জেলা থেকে গ্রাম আড়াআড়ি হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের অভিশাপ, যা এই বাংলায় কখনও ছিল না। ভয়ঙ্কর কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও বেনজির আট দফা নির্বাচনকে রাজ্যের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো মস্ত প্রহসন। যার পিছনে সঙ্গত কোনও কারণ ছিল না। আর আজ যখন দ্বিতীয় ঢেউ মানুষকে নতুন করে বিপন্ন করেছে, তখন বলা হচ্ছে, দেড় হাজার কোম্পানি বাহিনী ছাড়া নাকি শেষ তিন দফার ভোট একসঙ্গে করা সম্ভব নয়। এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কিছু হতে পারে? যদি প্রচারের সময় কমানো যেতে পারে, যদি প্রার্থী মারা গেলে ভোট বন্ধ করা যেতে পারে, তাহলে জরুরি পরিস্থিতিতে শেষ তিন দফার নির্বাচন একসঙ্গে করা যাবে না কেন? কার স্বার্থে? মানুষ আগে না ভোট, ক্ষমতা দখল আগে? সর্বোচ্চ স্তরের এই উদাসীনতা বাঙালিকে আষ্টেপৃষ্ঠে মারণ ভাইরাস দিয়ে কাবু করারই নোংরা ষড়যন্ত্র বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। সেই দিক দিয়ে সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের সঙ্গে বাংলার মানুষের অধিকারও আজ ভূলুণ্ঠিত!
তবে এখানেই শেষ নয়। এবারের নির্বাচনে বাঙালির ‘প্রাপ্তি’র তালিকাটা নজিরবিহীনভাবে দীর্ঘ। কোনও সমস্যার সমাধান নয়, রান্নার গ্যাসের দাম কমানো নয়, কোনও উন্নয়ন প্রকল্প ঘোষণা নয়, দেশের হাজারো সঙ্কটকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিকটু ডেলি প্যাসেঞ্জারি দেখেছে বাংলা। উদ্দেশ্য শুধুই ক্ষমতা দখল। এ কাজে সঙ্গী হয়েছে যাবতীয় কেন্দ্রীয় এজেন্সি। সিবিআই, ইডি, আয়কর দপ্তর। এভাবেই বাংলা দখলের লড়াইকে পদে পদে কার্যত বাংলা ও বাঙালি বিরোধী যুদ্ধে পরিণত করেছে অমিত শাহরা। সেই সঙ্গে আছড়ে পড়ছে জলের মতো কালো টাকার স্রোত। নিমেষে যা ছড়িয়ে পড়েছে জেলায় জেলায়। অথচ যাঁদের বিষয়টা দেখার কথা তাঁরা দেখেও দেখছেন না কিছুই। তাহলে অবজার্ভার, পর্যবেক্ষকদের কাজটা কী, উত্তর মেলে না। অনেক গরিব মানুষ আক্ষেপ করে বলেছেন, লকডাউনের সময় এরা কোথায় ছিল। এদের টিকিটা কেন একবছর আগের সেই দুর্দিনের সময় দেখতে পায়নি বাংলার মানুষ? তাহলে শত শত পরিযায়ী শ্রমিকের দুর্দশা অন্তত একটু হলেও কমত। উম-পুনের ক্ষতটাও এত গভীর হতো না।
একজন দায়িত্বশীল প্রধানমন্ত্রীর ভাষা কখনও নিম্নরুচির হতে পারে কি, এ প্রশ্নও করার জন্যও আজ ফুঁসছে বাঙালি। ৬৫ বছরের এক বাঙালি জননেত্রীকে হারাতে প্রতিটি সভায় দেশের প্রধানমন্ত্রী বিষ মাখানো ’দিদি, ও দিদি’ তীরটা ছুড়ে দেওয়ার অসৌজন্যটাই দেখাচ্ছেন বুক ফুলিয়ে। ঠিক যেন বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে এক অকুতভয় জখম পা নিয়ে লড়াই করা নেত্রীর দিকে। দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি এটাই কি ভারত সরকারের একনম্বর পদাধিকারীর গণতান্ত্রিক আচরণ হতে পারে! শুধু একবার নয়, বারে বারে, জনসভা পিছু কখনও শতবার, কখনও তারও বেশিবার ‘দিদি, ও দিদি’ ডাকের নারকীয় অসভ্যতা চলছে। এভাবে গোটা রাষ্ট্রশক্তিকে নামিয়ে বাঙালিকে পর্যুদস্ত করার এমন নজির আগে আর কোনও নির্বাচনে বাঙালি দেখেছে, মনে করতে পারছেন না প্রবীণরাও। গত চার দশকের বারবার ভোটে জিতে আসা জননেত্রীকে অসম্মান করার এমন নজির ভূভারতে আর ক’টা আছে জানা নেই। তোতাপাখি সিবিআইয়ের টাস্ক ছিল ভোটের আগে কিংবা নির্বাচন চলাকালীন নেত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বড় কোনও নেতাকে জেলে পোরা। অনেক চেষ্টা করেও তাতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। ভোট মিটলে তার চড়া খেসারত দিতে হতে পারে তদন্তকারী সংস্থার কেষ্টবিষ্টুদের। কিন্তু অমিত শাহের কেন্দ্রীয় বাহিনী যে নিরপেক্ষতা রক্ষার বদলে ভোটারদেরই রক্ত ঝরাচ্ছে তার দায় কে নেবে? এর জবাব ভোট মিটলে দিতেই হবে।
সবচেয়ে দুঃখের কথা, গত ১০ এপ্রিলের নির্বাচনে শীতলকুচিতে ঠিক কী ঘটেছে, আজ এক সপ্তাহ কেটে গেলেও আমরা পরিষ্কার করে জানি না। ঘটনা নিয়ে নানা মহল নানা কথা বললেও কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রামাণ্য তথ্য, নথি আজ এক সপ্তাহ পরও নির্বাচন কমিশন দিতে পারল না কেন, এই প্রশ্ন ওঠা কি খুব অস্বাভাবিক। এত অবজার্ভার, মাইক্রো অবজার্ভার, পুলিস কর্তা, কেন্দ্রীয় বাহিনীর অফিসার সবাই মজুদ থাকা সত্ত্বেও সরকার কেন এতদিন পরও কোনও ফুটেজ দিতে পারল না। বলতে পারল না, দেখুন ঠিক এটাই ঘটেছে সেদিন। উল্টে ৭২ ঘণ্টা জেলায় নেতানেত্রীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে নানা জল্পনার জন্ম দিল! অভিযোগ উঠল এটা কি গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ নয়। ভোট পরিচালনায় নির্বাচন কমিশন সবার উপরে। তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতাকে পূর্ণ সম্মান দিয়েই বলি, যার হাতে ক্ষমতা তার উপরই যাবতীয় দায়ও বর্তায়! মানুষের মন থেকে সন্দেহ নিরসনের দায়িত্বও কিন্তু কমিশনের উপরই বর্তায়। কেন ওয়েবকাস্টিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও শীতলকুচির ১২৬ নম্বর বুথে সেদিন তা কার্যকর হয়নি। এই প্রশ্নের জবাব কিন্তু বাংলার মানুষ চায়। কোনও সাংবিধানিক সংস্থাকে অসম্মান না করেই চায়। এ ব্যাপারে গাফিলতি কার, তা চিহ্নিত করে কমিশনকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেই হবে। কেন ওই ঘটনার বিভিন্ন বেসরকারি ভিডিও বাজারে বেরলেও সর্বজনগ্রাহ্য কোনও সরকারি ফুটেজ এখনও দেওয়া গেল না, তা কর্তব্যরত ডিএম ও এসপিকে জানাতে হবে। ভোট মিটলেও বাংলার মানুষ কিন্তু উত্তর না নিয়ে এত সহজে ছাড়বে না।
এবারের ভোটযুদ্ধকে এক বাঙালি মহিলার সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির লড়াই বললেই সব শেষ হয়ে যায় না। যেটা ঘটছে তার প্রেক্ষিতটা কিন্তু আরও বড়। বলা ভালো, বাংলার পবিত্র নারী সত্ত্বার সঙ্গে বহিরাগত এক সর্বগ্রাসী শত্রুর যুদ্ধ দেখছে গোটা দেশ। উপলক্ষ্য একটা সামান্য নির্বাচন। কিন্তু এই একটা উপলক্ষ্যই সব হিসেব বদলে দিয়েছে। এই প্রশ্ন আগেও রেখেছি, ভোট মিটলে, ফল প্রকাশ হলে নতুন সরকার গড়ার পরও আমাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার ক্ষমতাটা অটুট থাকবে তো? আমরা যেন এমন কিছু করে না ফেলি যাতে এই রাজ্যটার চিরস্থায়ী ক্ষতি হয়ে যায়। সবাই সবার শত্রুতে পরিণত হয়ে না যাই। বিগত দশ বছরে প্রায় সব বিরোধীদলের কোমর ভেঙে গিয়েছে। অধিকাংশ আঞ্চলিক শক্তিই নিজের নিজের এলাকায় দুর্বল হয়েছে কিংবা মুছে গিয়েছে। বেঁচে আছেন শুধু দিল্লির কেজরিওয়াল। মহারাষ্ট্রের উদ্ধব থ্যাকারে আর অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানার কিছু আঞ্চলিক দল। তাই যে কোনওমূল্যে আগামী ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে মমতার বাংলায় পা রাখতে পারলে গণতন্ত্র হত্যার মহোৎসব সাফল্যমণ্ডিত হবে, এটাই মোদিজির লক্ষ্য। তাই বিজেপি মরিয়া। কিন্তু ওই ‘আসল পরিবর্তন’এর আড়ালে কোন বিষ অপেক্ষা করছে তা অসম ও ত্রিপুরার মানুষ আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। আমরাও নিশ্চিত, বাঙালি সেই ভুল করবে না। উল্টে বাংলাকে বাঁচিয়ে সবার উপর মানুষই সত্য, গণতন্ত্রের এই জয়ডঙ্কাকে আর একবার সূর্যের আলোয় প্রতিষ্ঠা করবে আগামী ২ মের ফলাফল!