বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
প্রার্থী করার সপ্তাহ দু’য়েকের মাথায় বিজেপির জেলা নেতৃত্ব নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ‘অভিমানী’ তপনবাবু সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, ‘এই অবস্থায় দল তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিলে তিনি আত্মহত্যা করবেন।’
তাঁর হুঁশিয়ারিতে কান দেননি নেতারা। জেলাশাসকের অফিসে মনোনয়ন জমা দেওয়ার মুহূর্তে তাঁকে নেতৃত্ব জানিয়ে দেন, ‘বিজেপি তাঁকে প্রতীক দেবে না।’ সে কথা শুনে গেরুয়া বসনধারী ছিপছিপে কৃষ্ণবর্ণ মানুষটার মুখ আরও কালো হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, তাঁর মুখে কে যেন এক দোয়াত কালি ঢেলে দিয়েছে। তারপর বেশিরভাগ সময়ই মোবাইল বন্ধ। কখনও কখনও রিং বাজলেও কথা বলছেন না। হয়তো আত্মগ্লানি আর লজ্জা কেড়ে নিয়েছে মুখের ভাষা।
তবে বিজেপির ভিতরের খবর, তপনবাবুর ‘লজ্জা নিবারণে’ দলীয় নেতৃত্ব কোনও খামতি রাখছে না। বস্ত্রহরণের সময় প্রভু শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে যেভাবে অনর্গল কাপড় জুগিয়েছিলেন, তপনবাবুর লজ্জা নিবারণের জন্য নাকি তেমনই ব্যবস্থা হচ্ছে।
কোচবিহার জেলার দিনহাটায় বিজেপির শহর মণ্ডল সভাপতি অমিত সরকারের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার ঘিরে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছিল। তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাঁকে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ঘিরে উত্তাল হয়েছিল দিনহাটা। কিন্তু তদন্তে জানা গেল, প্রার্থী হতে না পারা ও এক দলীয় মহিলা কর্মীর আচরণে হতাশ হয়েই অমিতবাবুর এই সিদ্ধান্ত। না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিসি তদন্তে নয়, নির্বাচন কমিশনের এক কর্তার রিপোর্টে সেকথাই রয়েছে।
এই দু’টি ঘটনা প্রার্থীপদকে ঘিরে বিজেপির বিক্ষোভের সমুদ্রে ডুবে থাকা পাহাড়ের চূড়ামাত্র। যেটুকু দেখা যাচ্ছে তার অনেক বেশি চাক্ষুষ হচ্ছে না। দলবদলুদের ‘জামাই আদর’ করে প্রার্থী করায় বিজেপিতে ক্ষোভ প্রায় সর্বত্র। পাহাড়ের গভীরতা বোঝা যাবে ২ মে।
বিজেপির বিক্ষুব্ধরা কোথাও নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন, কোথাও আবার তলে তলে তৃণমূলের সঙ্গে ‘সেটিং’ করছেন। অনেকে বলছেন, লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিরিয়ানি খেয়ে অনেকেই পদ্মফুলে ছাপ মেরেছিলেন। এবার বহু জায়গায় ঘটতে চলেছে ঠিক তার উল্টো। বিজেপির আদিরা দলকে সংশোধন করতে চাইছেন। তাঁরা বলছেন, বিজেপি ক্ষমতা পেলে দলবদলুরা পার্টিটা হাইজ্যাক করে নেবে। তাই শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা। এসব দেখে অনেকে ‘গীতা’র সেই বাণী স্মরণ করছেন, ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’
কথায় আছে, ভদ্রলোকের এককথা। সেদিক দিয়ে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিতজি খাঁটি ভদ্রলোক। তিনি নির্বাচন ঘোষণার আগে যে কথা বলেছিলেন, এখনও তাই বলছেন, বঙ্গে বিজেপি ২০০-র বেশি আসন পাবে। প্রার্থী তালিকা নিয়ে যত কোন্দলই থাক, দলের আদি-নব্যের লড়াই যতই তুঙ্গে উঠুক, তিনি তাঁর কথায় অবিচল। কেন না বাস্তব পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করে সংখ্যা বলার সময় এটা নয়। সত্যি বললেই কর্মীদের মনোবলে চিড় ধরবে। তাই প্রতিটি পর্বে এমনভাবে আসন দাবি করে যাবেন যাতে অনায়াসেই হাঁকানো যায় ডবল সেঞ্চুরি। তাই প্রথম দফায় ৩০টির মধ্যে ২৬টি, দ্বিতীয় দফায় ৩০টির মধ্যে ২৮টি। বিজেপি নেতারা যেভাবে ঘোড়া ছোটাচ্ছেন, তাতে পঞ্চম দফাতেই হয়তো দাবি করে বসবেন, সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় সংখ্যা তাঁদের হাতে মুঠোয়। বাকি তিন দফায় যেটা হবে সেটা অতিরিক্ত। ২০১৬ সালে কংগ্রেস-সিপিএম নেতৃত্ব এমনটাই দাবি করেছিল। শোনা যায়, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট নাকি মন্ত্রিসভা পর্যন্ত ছকে ফেলেছিল।
প্রায় ১০০ টাকা লিটার পেট্রল, ৯০ টাকা লিটার ডিজেল, ৮৩৫ টাকা গ্যাস সিলিন্ডারের দাম। তা সত্ত্বেও ভোটের হাওয়া বিজেপির অনুকূলে? রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে, পাড়ার মোড়ে ১০জন পুরুষের মধ্যে ছ’জন ‘বিজেপির পালে হাওয়া’ বলে দাবি করেছেন। জেতা নিয়ে সংশয় থাকলেও বিজেপিকে নিয়ে যে জোর চর্চা হচ্ছে, তা তাঁরা সাফ জানিয়েছেন। তখনই প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে স্বাস্থ্যসাথী, সবুজসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, কৃষকবন্ধু, বিনা পয়সায় রেশন, বিনা পয়সায় চিকিৎসার কোনও প্রভাব নেই? ভোটে পরিষেবা কি মূল্যহীন?
এই প্রশ্নটা আরও প্রকট হয়েছে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশের পর। তৃণমূল যে সমস্ত পরিষেবা এতদিন রাজ্যবাসীকে দিয়ে এসেছে, বিজেপির ইস্তাহারে সেগুলিই আরও বেশি বেশি করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ থেকেই স্পষ্ট কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজসাথী, স্বাস্থ্যসাথী, কৃষকবন্ধু জনমানসে প্রবল প্রভাব ফেলেছে। তা না হলে ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূলবৃদ্ধি ও ব্যাঙ্কের সুদ কমিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস তুলতে সিদ্ধহস্ত বিজেপি কিছুতেই এই রাস্তায় হাঁটত না।
প্রায় সাড়ে তিন দশক সাংবাদিকতা করার সুবাদে অর্জিত অভিজ্ঞতা বলছে, এবারের ভোটে আসল লড়াইটা হচ্ছে বিজেপির তৈরি ‘হাওয়া’র সঙ্গে মানুষের ‘বাস্তব অভিজ্ঞতার’। জেলায় জেলায় ঘোরার সময় বিজেপির এই ‘হাওয়া’ তোলার কার্যকারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। তবে, সেটা করতে গিয়ে যে কেঁচো খুঁড়তে কেউটের দেখা পাওয়ার অবস্থা হবে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি।
কোনও ভনিতা নয়, একেবারে সরাসরি বলছি, বঙ্গে গেরুয়া ‘হাওয়া’ তোলার পিছনে রয়েছে বিজেপির ‘কর্পোরেট স্টাইলে’র প্রচার। মঞ্চ তৈরি থেকে লোকজন নিয়ে আসা, ‘স্বাগতম’ লেখা গেঞ্জি, পাঞ্জাবি থেকে শাড়ি সমস্ত কিছুর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে কোনও না কোনও ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ সংস্থাকে। এমনকী, মিছিলকে বর্ণময় ও আকর্ষণীয় করার জন্য অংশগ্রহণকারী লোকজনকে নানান রংয়ের পাগড়ি পরানো হচ্ছে। তা পরানোর জন্য বাইরে থেকে লোক আনা হচ্ছে। সবটাই ভাড়ায়।
প্রতিটি পর্যায়ের দায়িত্বই কর্পোরেটের উপর। তাই কিছুতেই খামতি থাকছে না। মিছিল, মিটিং নিয়ে নেতাদেরও নেই কোনও মাথাব্যথা। কর্মীদের কোনও দায়িত্ব নেই। তাঁদের একটাই কাজ, ক্যামেরার সামনে মিছিলে বেলুন আর পতাকা নিয়ে নাচানাচি করা। স্বতঃস্ফূর্ততাকে ফুটিয়ে তোলা।
‘বন্ধুর পথ’কে কুসুমাস্তীর্ণ করতে প্রতিটি রোডশোয়ে থাকছে ১০ থেকে ২০ কুইন্টাল পর্যন্ত গোলাপের পাপড়ি। রঙিন পাপড়িতে ঢেকে যাচ্ছে রাস্তার পিচের কালো আস্তরণ। বড় সভাগুলিতে থাকছে হাজার দশেক কাটআউট, ৫০ হাজার বেলুন, ১৫ হাজার গেঞ্জি, ২৫ হাজার শাড়ি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে লোক আনার দায়িত্বও ভারপ্রাপ্ত সংস্থাকেই নিতে হচ্ছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার এক কর্ণধারের কাছ থেকে পাওয়া এই তথ্য যাচাই করা কঠিন নয়। কারণ সবটাই প্রকাশ্যে ঘটছে।
তবে চমকে যাওয়ার মতো তথ্যটি হল, মোদিজি, অমিতজি বা নাড্ডাজির মতো নেতার পদযাত্রায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা ফুটিয়ে তোলারও বিশেষ আয়োজন। বাড়ির ছাদ থেকে ফুল ছোড়া দেখলে যে কেউ ভাববেন, বিজেপিকে এলাকার মানুষ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন। সেই কারণেই এমন পুষ্পবৃষ্টি। কিন্তু আসল সত্যিটা হল, সেটাও করছেন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ‘ভাড়াটে’ লোকজন।
রোড শোয়ের আয়তন অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৪০০ লোককে বাড়ির ছাদে ফুলের ঝুড়ি দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নেতার গাড়ি এলেই তাঁরা ফুল ছুড়ছেন। তারজন্য পাচ্ছেন পারিশ্রমিক। ‘কৃত্রিম আবেগ’ তৈরির এমন প্রয়াস সত্যিই অভিনব। বিজেপি বঙ্গ দখলে আগ্রাসী না হলে বাঙালির কত কিছুই অজানা থেকে যেত!
‘রুদালি’ সিনেমাটা মনে আছে? রাজস্থানের প্রেক্ষাপটে মহাশ্বেতা দেবীর লেখা নিয়ে তৈরি হয়েছিল রুদালি। বাবা, মা, কিংবা নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুতে কাঁদার জন্য লোকজন ভাড়া করা হতো। রাজস্থানের এক শ্রেণির মানুষের এটাই পেশা। তাঁরা টাকার বিনিময়ে বুক চাপড়ে কাঁদেন। চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে ঝরে জল। তারপর?
টাকা দিয়ে হাসি, উচ্ছ্বাস, এমনকী চোখের জলও কেনা যায়। কিন্তু আন্তরিকতা কেনা যায় না। ভাবনায় ও চেতনায়, রুদালির ‘কান্না’ আর বিজেপির ‘হাওয়া’ কেমন করে যেন একবিন্দুতে লীন হয়ে যাচ্ছে।