পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
আর সেটা ভুল নয়। প্রত্যাশিত। কারণ, প্যাটেলের অবদান অবশ্যই অপরিসীম।
প্রশ্ন হল, যখন স্ট্যাচু অফ ইউনিটি নামক একটি দেশের সর্বোচ্চ মূর্তি নির্মাণের কথা বিজেপি ভেবেছে, তখন তাদের সর্বাগ্রে কার কথা মনে পড়েছে? প্যাটেলের কথা। নেতাজির কথা কিন্তু মনে পড়েনি। স্বামীজির কথাও নয়। এখানেও অস্বাভাবিক কিছু নেই। হতেই পারে যে গুজরাতে যখন মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তখন একজন গুজরাতের ভূমিপুত্রকেই সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান দেওয়া হবে। সেই অধিকার তাঁদের আছে। এখানে কেউ বাইরে থেকে গিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না যে, কী করা উচিত ছিল, কী করা উচিত নয়। একটি রাজ্যের সংস্কৃতি, ইতিহাস আর গৌরবের ঐতিহ্য সেই রাজ্যবাসীই বহন করে চলে। তাঁরাই তো স্থির করবেন সংস্কৃতির গতিপথ। সুতরাং গুজরাতবাসীর পূর্ণ অধিকার আছে যে, নর্মদাতটে কার মূর্তিকে দেশের সর্বোচ্চ মূর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার। বাকি দেশবাসী ভিনরাজ্যের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে সম্মান করবে, সমীহ করবে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বহুত্ববাদী সংস্কৃতিতে এটাই তো স্বাভাবিক।
ঠিক এখানেই আমাদের বিনীত নিবেদন যে, কখনও উত্তরপ্রদেশ,কখনও মধ্যপ্রদেশ, কখনও গুজরাত, কখনও কর্ণাটক, কখনও বিহার থেকে নানাবিধ রাজনৈতিক নেতানেত্রী, মন্ত্রী, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা হঠাৎ বাংলায় ভোটপ্রচারে এসে বাঙালিকে সাংস্কৃতিক লেকচার কেন দিচ্ছেন? বাঙালির ধর্ম, সংস্কার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় কী করা উচিত সেই জ্ঞানগর্ভ বাণী কেন দেওয়া হচ্ছে? একটি রাজ্যের ভোটে আঞ্চলিক এবং সর্বভারতীয় সব দলই অংশ নেবে। সকলেই ভোট চাইবে মানুষের কাছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল বলবে তারা বিগত ১০ বছরে প্রচুর কাজ করেছে। পাল্টা তার বিরোধীরা বলবে কোনও কাজই হয়নি। পরিবর্তন দরকার। বিজেপি নেতামন্ত্রীরা অন্য রাজ্য থেকে এসে অবশ্যই প্রচারে বলুন, তাঁরা বাংলায় ক্ষমতায় এসে কী কী করবেন। শিল্প গঠন,কর্মসংস্থান অথবা গ্রামোন্নয়নে তাঁদের চিন্তাধারাটি ঠিক কী। এসব শুনে বাংলার মানুষ মনে করতে পারেন খুব ভালো কথা, তাহলে তাঁরা বিজেপিকে ভোট দেবেন। আর যদি মনে করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১০ বছরে যা যা করেছেন অথবা করছেন, সেটাই ভালো,তাহলে তাঁরা মমতাকেই ভোট দেবেন। এটা তো একেবারে সোজা অঙ্ক। অথচ প্রয়োজনীয় কথার পরিবর্তে ভিনরাজ্যের নেতানেত্রীরা ভোটের প্রচারে এসে বলে চলেছেন, বাংলার সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এই সরকারের আমলে বাংলা উচ্ছন্নে গিয়েছে। বাংলার আর কোনও সম্মানই অবশিষ্ট নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি। নতুন দল ক্ষমতায় এসে সোনার বাংলা আবার হবে। বাংলার সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এই প্রচার করে আমাদের লাগাতার বাঙালি মনীষীদের কথা স্মরণ করানো হচ্ছে। ছবি দেখানো হচ্ছে। তাঁদের দেখিয়ে ভোট চাওয়া হচ্ছে।
এই যে বাইরে থেকে আসা নেতানেত্রীর দল বাঙালিকে মুখের উপর বলছে, তোমাদের কালচার বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই, সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, আমরা ক্ষমতায় এলে আবার ফিরিয়ে দেব সংস্কৃতির ঐতিহ্য, এই ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে কীভাবে? এটা কি শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ? এটা তো সরাসরি গোটা বঙ্গবাসীকেই অপমান করা! সংস্কৃতিচেতনা তো আর সরকার কিংবা পার্টির পেটেন্ট নেওয়া নয়? এটা তো দলমতনির্বিশেষে আমবাঙালির যাপন চর্চা। তাহলে বাঙালির চেতনাকেই অসম্মান করা হচ্ছে না কি? সারা বছর ধরে নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও চর্চার সঙ্গে যুক্ত হতে সরকার কিংবা রাজনীতির কী সম্পর্ক? বাংলায় কোন সংস্কৃতিটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে? মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করতে গিয়ে তো গোটা বাঙালি জাতির সংস্কৃতি চেতনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে! কেন?
স্বামীজি অথবা নেতাজি জয়ন্তীতে প্রভাত ফেরি অথবা সারাদিন ধরে রাজ্যজুড়ে অভাবনীয় এক উৎসাহে নেতাজিকে সম্মান জানানো হয় না? বরং যত দিন যাচ্ছে, ততই তো এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই তো স্বামীজি ও নেতাজির প্রতি আগ্রহ ও সম্মান ক্রমবর্ধমান! নতুন প্রজন্ম কি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? সেরকম চিত্র তো দেখা যায় না বাংলায়! বরং মহা উৎসাহে নব প্রজন্মও সংস্কৃতি পালন আয়োজন করছে নিজেদের মতো করে। পাশাপাশি লুম্পেন কালচার কি নেই? কেন থাকবে না? সেটা তো সব রাজ্যেই আছে। তাই বলে অশালীন, অপরিশীলিত, লুম্পেন কালচারই কি বাঙালির পরিচয়? সেরকমই তো প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস করা হচ্ছে এইসব বক্তৃতায়। কিন্তু আজও ওটা ব্যতিক্রম। রবীন্দ্রজয়ন্তীর ঐতিহ্য
কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে? সরকারি বড় অনুষ্ঠানের কথা
বাদ দিন। সাধারণ সংস্থা, পাড়ার সংগঠন, ছোটখাটো গান ও নাচের স্কুল, পাড়ার ক্লাবে আজও তো সমান আগ্রহ, উদ্দীপনা আর আনন্দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা হয় তাঁরই সৃষ্টিগুলিকে পরিবেশন করে। আজও নিয়ম করে বাংলা থিয়েটার অথবা সিনেমা সর্বভারতীয় স্তরে সম্মান ও পুরস্কার পেয়ে চলেছে। গ্রামীণ সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে আয়োজিত হয় সারা বছর ধরে নানাবিধ মেলা ও উৎসব।
অন্য রাজ্য থেকে আসা নেতানেত্রীরা প্রকাশ্যে জানাবেন তাঁদের রাজ্যের কোন কোন শহরে সারা বছর ধরেই ছোটবড় বইমেলা হয় কি না? বইমেলা হচ্ছে না বলে হা হুতাশ হয় কি না? বাংলায় কালচার শেখাতে আসা ক’টা রাজ্যের নেতানেত্রী জানেন লিটল ম্যাগাজিন ব্যাপারটা ঠিক কী? পুজো উপলক্ষে ধর্মানুষ্ঠান হতে পারে। ভিড় করে ঠাকুর দেখাও চলবে। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ছোটবড় মিলিয়ে কয়েকশ পুজোসংখ্যা কেন প্রকাশিত হয় দুর্গাপুজো অথবা শরৎকে কেন্দ্র করে? কোনও সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াই আমরা তো প্রতি বছর কল্পতরু উপলক্ষে নিজেরাই যাই দক্ষিণেশ্বর, কাশীপুর উদ্যানবাটি অথবা বেলুড়মঠ! বাঙালি বই পড়ে না শুধুই মোবাইলে ডুবে আছে এই প্রচারকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে কেন বছর বছর হাজার হাজার বই প্রকাশ হয়ে চলেছে? কারা কিনছে? কারা পড়ছে? চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজন উৎসব বন্ধ হয়ে গিয়েছে? সুতরাং বাংলার সাধারণ মানুষ, সাব অলটার্ন, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি চর্চা ধ্বংস
হয়ে গিয়েছে এটা কে বলল আপনাদের? বাঙালি কোন ধর্ম, কোন সংস্কৃতি, কোন পুজোকে কীভাবে পালন করবে, সেটা কে ঠিক করে দেবে? ভিনরাজ্য থেকে আসা মরশুমি সংস্কৃতিমনস্ক মন্ত্রীরা? আপনারা বাঙালির দিনযাপন, সংস্কৃতি যাপন, সম্পর্কযাপন সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
তাই অবশ্যই ভোট প্রার্থনা করুন। পছন্দ হলে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে মানুষ ভোট দেবে আপনাদের। অথবা মন্দ লাগলে দেবে না। সেটা ভোটের অঙ্ক। কিন্তু একটি জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে লেকচার দেবেন না। বাংলার সংস্কৃতি রক্ষা করতে আপনাদের আন্তরিকতা যদি সত্যিই থাকে, তাহলে সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে ঠিক বেছে বেছে ২ মে, তাঁর জন্মদিনেই কেন নির্বাচন কমিশন এই চরম হাই ভোল্টেজ ভোটের গণনা ও ফলপ্রকাশের নির্ঘণ্ট রাখল? আপনারা সর্বভারতীয় পার্টি, কেন্দ্রেও ক্ষমতায়। সব দলকে সঙ্গে নিয়ে কমিশনে আবেদন করলেন না কেন দিনটা যাতে বদল করা হয়? অন্তত বাঙালির জন্য! সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষ জন্মদিন তো আর ফিরে আসবে না!