কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
২০০৭-এর জানুয়ারি মাসে শুরু হয়েছিল এই আন্দোলন, আর গুলি চলেছিল ১৪ মার্চ। সেদিনই দুপুরে নন্দীগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন বাংলার ভাবী মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সন্ধ্যাবেলায় সিপিএম পথ অবরোধ করে তাঁকে আটকাল চণ্ডীপুরের মোড়ে। চণ্ডীপুরের মোড় থেকে নন্দীগ্রাম মাত্র ১২-১৫ কিমি দূরে। গালিগালাজের বন্যা বয়ে গেল। অকুতোভয় মমতাদি প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা ওই প্রবল গালিগালাজ ও অবরোধের মধ্যে গাড়িতে ঠায় বসে রইলেন। অবশেষে রাত্রিবেলা সেদিন কোনওরকমে তমলুকের এক সাধারণ হোটেলে রাত কাটালেন বাংলার ভাবী মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু অপ্রতিরোধ্য মমতাদি পরদিন সকাল ৮টা-সাড়ে ৮টা নাগাদ আবার রওনা দিলেন নন্দীগ্রামের দিকে। তাঁর গাড়ি আবার সিপিএম আটকাল নন্দীগ্রামের ২ নম্বর ব্লকে হাঁসচড়ায়। সেখানে সিপিএম তার মহিলা ব্রিগেডকে এগিয়ে দিল। আবার অবরোধ। সেই অবরোধ ভেঙে মমতাদি এগলেন। এবার রেয়াপাড়া। সেখানেও সেই একই অবরোধ, গাড়িতে কিল-চড়-ঘুষি ও অকথ্য গালিগালাজ। সঙ্গে রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে দেওয়া। কিন্তু মনোবল অটুট রেখে চোয়াল শক্ত করে দু’জায়গাতেই প্রায় তিন ঘণ্টা গাড়িতে বসেছিলেন মমতাদি। টেঙ্গুয়া মোড় পর্যন্ত মমতাদির গাড়ি সেই কুৎসিত অবরোধ ভেঙে প্রায় ফুঁড়ে বেরল। মমতাদি যেই নন্দীগ্রামের ১ নম্বর ব্লকে ঢুকলেন, সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার আর্ত, অত্যাচারিত, মার-খাওয়া অসহায় নারী-পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর কাছে সাহায্য পাওয়ার জন্য। প্রায় সকলেই হাউ হাউ করে কাঁদছেন। সেই অবস্থায় মমতাদি তাঁদের সান্ত্বনা দিলেন, অনেক মহিলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। তারপর সোজা নন্দীগ্রাম বাজার, নন্দীগ্রাম থানা, বিডিও অফিস পেরিয়ে ঢুকে গেলেন নন্দীগ্রাম হাসপাতালে। হাসপাতাল চত্বর তখন জনসমুদ্র। সেখানে প্রতিটি আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে তিনি কথা বললেন। গুলি-খাওয়া, মার-খাওয়া, ভোজালির কোপ-খাওয়া মানুষকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন জননেত্রী। প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। সেই অবস্থাতেও প্রতিটি জখম মানুষের পরিবারের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। আর সেইদিন থেকেই ঢুকে পড়লেন নন্দীগ্রামের লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। না, এই পুরো সময়টায় সেদিন মেদিনীপুরের কোনও ‘পরিবার’ বা ‘গড়’-এর কেউ তাঁর সঙ্গে ছিল না। সন্ধ্যায় যখন অসুস্থ মমতাদি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে নন্দীগ্রাম থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, তখনও না। অথচ সেদিন মমতাদির ওই একক অভিযান হার্মাদদের মনোবল পুরো ভেঙে দিয়েছিল।
এবারের নির্বাচনে গিয়েও মমতাদির প্রতি নন্দীগ্রামবাসীর সেই আবেগ স্পষ্ট অনুভব করছিলাম। সকলে মুখে মুখে বলছে, ‘আমাদের জীবনদাত্রী ঘরের মেয়ে মমতা’। ২০০৭ সালের ১৪ ও ১৫ মার্চ মমতাদির ওই আন্দোলনের গর্ভগৃহে পৌঁছে প্রতিটি অত্যাচারিত মানুষের পাশে সমবেদনা ও সহানুভূতি নিয়ে দাঁড়ানো, নন্দীগ্রামবাসী এখনও ভুলতে পারেনি। আমিরুল মণ্ডল নামে এক বয়স্ক কৃষক ২০০৯-এ আমাকে নন্দীগ্রামে বসে বুঝিয়েছিলেন, ২০০৭-এর মার্চ মাসে মমতাদির ওই টর্পেডোর মতো নন্দীগ্রাম অভিযান আসলে উত্তুঙ্গ হয়ে উঠে পরিণতি পেয়েছিল আঠারো মাস বাদে ২০০৮-এর ১১ মে মাসের পঞ্চায়েত ভোটে। গোটা এলাকা জুড়ে সেদিন তৃণমূলের একটা ফ্ল্যাগ, ব্যানার বা ফ্লেক্স ছিল না। তার আগে নন্দীগ্রামে বিরাট সমাবেশ করলেন জননেত্রী। ২০০৮-এর ৯ মে। সেদিন তিনি প্রথম গিয়েছিলেন, তাঁর সেদিনের আন্দোলনের সাথী, এবারের তাঁর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট শেখ সুফিয়ানের বাড়িতে। সেদিন কেউই বুঝতে পারেনি দু’দিন বাদে জনরোষ ব্যালটবক্সে ঢুকে সিপিএমকেই আগামী দিনে নন্দীগ্রাম থেকে হাওয়া করে দেবে। তথাকথিত যে প্রভাবশালী পরিবার এখন লম্বা-চওড়া কথা বলে, সেদিন তারা অর্থাৎ ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে একটা তৃণমূলের পতাকা পর্যন্ত লাগাতে পারেনি, বুথে একজন এজেন্ট পর্যন্ত বসাতে পারেনি, তারাও অবাক হয়ে সেদিন দেখল মমতা-ক্যারিশমা। তৃণমূল কংগ্রেস জেলাপরিষদ আর পঞ্চায়েত সমিতি তো দখল করলই, আর তুমুল শক্তিশালী, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী সিপিএমের মুখে ঝামা ঘষে ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৯৪টি আসনের মধ্যে জিতে নিল ১৪০টি আসন। মোট ১৬টি পঞ্চায়েতই পেল তৃণমূল। সিপিএম পেল মোটে একটি।
আমিরুল আমাকে বলেছিলেন, ভোটে জেতার জন্য এলাকায় পারিবারিক আধিপত্য, কেন্দ্রীয় বাহিনীর সন্ত্রাস, সাংগঠনিক শক্তি, অঢেল টাকা এগুলো কিছুই শেষপর্যন্ত কাজে আসে না। কাউকে শিক্ষা দেওয়ার দরকার হলে, নন্দীগ্রামবাসী সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিল শুধুমাত্র জেদ আর আবেগ সম্বল করে সেই শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। আমিরুল বললেন, নন্দীগ্রামবাসী সেদিনের মতো এবারও অর্থাৎ ২০২১-এর নির্বাচনেও বিজেপিকে সেই শিক্ষাই দেবে। কিন্তু কেন দেবে? ১০ বছর আসিনি নন্দীগ্রামে। ২০১১-র পর থেকে আমরা, যারা আন্দোলনে অল্পবিস্তর শামিল হয়েছিলাম, তাদের আর কোনওদিন ডাকা হয়নি। না, কাউকে নয়। শিল্পী শুভাপ্রসন্ন থেকে শুরু করে নাট্যব্যক্তিত্ব শাঁওলি মিত্র বা কবি জয় গোস্বামী আর নন্দীগ্রামে পা রাখতে পারেননি। গোটা এলাকা জুড়ে মিথ্যার বেসাতি ছড়ানো হয়েছিল, আন্দোলনটি ছিল নাকি একটি নির্দিষ্ট পরিবারের। অথচ ১৪ এবং ১৫ মার্চ, ২০০৯, গুলি খেয়ে যখন কলাগাছের মতো একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছেন, তখন ঠিক কোন কুঞ্জে শান্তিতে ছিলেন যেন ওঁরা? আমিরুল মণ্ডলের সঙ্গে এবার দেখা হল না। দেখা হলে জিজ্ঞেস করতাম নিশ্চয়ই।
যে প্রশ্ন এবার দেখা না-হওয়ায় আমিরুলকে করতে পারিনি, তার উত্তর দিলেন ভেকুটিয়া পঞ্চায়েতে এক বক্তৃতায় স্থানীয় নেত্রী যশোদা গিরি। সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন মহিলা। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বললেন, গত ১০ বছরে যেভাবে সুন্দর হয়ে গিয়ে বদলেছে মহিষাদল বা এগরা, স্থানীয় বিধায়কের চেষ্টায় দৃশ্যগতভাবে বদলে গিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের অনেক বিধানসভা অঞ্চল, সেখানে নন্দীগ্রামের সেই কেন্দামারি, গড়চক্রবেড়িয়া, সোনাচূড়া, অধিকারীপাড়া, ভাঙাবেড়া বা কালীচরণপুর, সেই এক মজা খাল, গ্রামের ভেতরে সরু ভাঙাচোরা রাস্তা, ঘাসঝোপ আর গজালওয়ালা দেয়াল। মূল রাস্তাগুলো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় ঝাঁ-চকচকে, কিন্তু গ্রামের ভেতরের রাস্তাগুলোর এমন বেহাল দশা কেন? যশোদা বলছিলেন, গত পাঁচ বছরে নিষ্কর্মা বিধায়কের কোন কাজ না করা, নাম-কা-ওয়াস্তে দু’-একবার এসে হয় মিঠে কথা নয় ধমকানি-চমকানি ছাড়া আর কোন কাজ না করার কথা। যশোদা গিরি-ই তাঁর বক্তৃতায় বলছিলেন, মেদিনীপুরের মাটি বিশ্বাসঘাতকতা পছন্দ করে না। এই বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে গোটা নন্দীগ্রাম গরম হয়ে আছে। বিশ্বাসঘাতককে সবক নাকি তারা শেখাবেই। বক্তৃতার শেষে কর্মীদের মাঝে বসে চা খেতে খেতে পুরনো বিশ্বাসঘাতকতার আর এক গল্প মনে করালেন বয়াল থেকে আসা এক স্থানীয় বাসিন্দা সুনির্মল মুখোপাধ্যায়। সুনির্মল বলেছিলেন, ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর নন্দীগ্রাম বাসস্ট্যান্ডে প্রথম জমি অধিগ্রহণের কথা মিটিং করে বলেছিলেন তৎকালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ। পরদিন সিপিএমের মুখপত্রে তা ফলাও করে বেরয়। অথচ ২০০৯-এর জুলাই মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সিপিএমের স্থানীয় কৃষক ও সিটু নেতারা বলেছিলেন, নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ হবে না, বিরোধীরা ভুল বোঝাচ্ছে। কিন্তু লক্ষ্মণ শেঠের সেই বক্তৃতা সব জল্পনার অবসান ঘটাল। তিনদিন বাদে শুরু হল স্থানীয় মানুষের নেতৃত্বে সেই ঐতিহাসিক আন্দোলন। বিশ্বাসঘাতকদের কাউকে ছাড় দিল না নন্দীগ্রাম। লক্ষ্মণ শেঠ নির্বাচনে হেরে ভূত হয়ে গেলেন। ১৪ মার্চের সন্ধ্যাবেলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই একক অভিযান, নন্দীগ্রামবাসীদের মনে যে নতুন অক্সিজেন সঞ্চার করল, তাই-ই আবার নতুন বৃক্ষ রোপণ করছে নন্দীগ্রামে। যশোদা তাঁর বক্তৃতায় আশা প্রকাশ করছিলেন যে, নন্দীগ্রামের এই মজা, মলিন, মান্ধাতার চেহারাটাও আস্তে আস্তে তমলুক, মহিষাদল বা দীঘার মতো হয়ে উঠবে, যদি বাংলার আগামী মহিলা মুখ্যমন্ত্রী এখানকার বিধায়ক হন। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি এক লহমায় ম্যাজিকের মতো বদলে দেবে নন্দীগ্রামকে।
মিটিংয়ের পর চা খেতে খেতে সুনির্মল নিচু গলায় পুরনো দিনগুলোর কথা কিছু কিছু বলছিলেন। তাঁর ভয় হচ্ছে, কারণ আবার সিপিএমের মতোই নন্দীগ্রামের এবারের বিজেপি প্রার্থীর গলায় সেই ১০-১২ বছর আগের মতো কর্মসংস্থানের মেকি কথাগুলো শোনা যাচ্ছে। তার মানে কি গুজরাতি ব্যবসায়ীদের হয়ে আবার সেই জমিদখল? আবার সেই হাজার হাজার একর জমি জোর করে, পুলিসের বন্দুক উঁচিয়ে কাড়তে আসা? আবার সেই রাস্তা কাটা, পুলিসের জিপ পোড়ানো আর গাছের গুঁড়ি উল্টে রাস্তা বন্ধ করে মুক্তাঞ্চল তৈরি করার সেইসব দমবন্ধ করা দিনগুলি ফেরত আনা? সুনির্মল তারপর জোর গলায় বললেন, গুজরাতি বানিয়াদের সেইসব এজেন্টের জামানত জব্দ করবে নন্দীগ্রাম। ইতিহাস সবসময় মানুষের পক্ষে থেকেছে, মানুষ-বিরোধী, আত্মস্বার্থ-বোঝা বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে নয়।