পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
আমাদের বঙ্গবাসীর কাছে সিপিএম এরকমই এক নন-সিরিয়াস পার্টিতে পরিণত করেছে নিজেদের। অত্যন্ত যত্নে সিপিএম নিজেদের এরকম একটি হাস্যকর রাজনৈতিক দলে পর্যবসিত করতে সক্ষম হয়েছে। কেন? সিপিএম দুটি জিনিস খুব ভালোবাসে। ভুল করতে আর রেকর্ড করতে। এ পর্যন্ত সিপিএম যত ভুল করেছে এবং কুশাসনের যত রেকর্ড করেছে, বহু চেষ্টা করেও তৃণমূল সেটা ভাঙতে পারছে না। সিপিএমের ভুলের ইতিহাস শুরু হয়েছে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পথ চলার পর থেকেই। ব্রিটিশকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জাপানের প্রধানমন্ত্রী হেদিকি তোজোর সহায়তা চাওয়ায়, সুভাষচন্দ্রকে ‘তোজোর কুকুর’ বলে অভিহিত করেছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৪২ সাল থেকে লাগাতার ‘পিপলস ওয়ার’পত্রিকায় সুভাষচন্দ্র বসুকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। শুধু প্রবন্ধ লিখে নয়, সুভাষচন্দ্র বসুর কার্টুন বানিয়েও প্রকাশ করা হয়েছিল। নেতাজির ১০৫ তম জন্মবার্ষিকীতে এসে অবশেষে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন, নেতাজি জার্মানি, ইতালি ও জাপানির সঙ্গে মিত্রতা করায় আজও আমরা তাঁর সেই পথের বিরোধিতা করি। কিন্তু একইসঙ্গে আমরা অবশ্যই ভুল করেছি তাঁকে দেশপ্রেমের প্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করতে। এজন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী!
১৯৫২ সালের মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার সেন্ট্রাল কমিটি একটি বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। সেখানে বাবাসাহেব আম্বেদকরের চরম সমালোচনা করা হয়। বাবাসাহেব ১৯৪২ সালে গঠন করেছিলেন, সিডিউলড কাস্টস ফেডারেশন। আম্বেদকরকে সেই কারণে কমিউনিস্ট পার্টি আখ্যা দিয়েছিল সংশোধনবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে দলিতদের পৃথক করে নিয়ে গিয়ে আম্বেদকর শ্রেণিসংগ্রামকে দুর্বল করেছেন বলে তীব্র ভাষায় তাঁকে আক্রমণ করা হয় ওই রেজোলিউশনে। অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির কাছে ক্লাস স্ট্রাগল ছিল কাস্ট স্ট্রাগলের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও উপযোগী। পরবর্তীকালে আমরা কী দেখেছি? সেই কমিউনিস্ট পার্টির অংশ সিপিএম পুরোদস্তুর নেমে পড়েছে জাতপাতের রাজনীতির সঙ্গে হাত মেলাতে। মায়াবতী থেকে লালুপ্রসাদ যাদব, সকলেই কাস্ট তথা আইডেন্টিটি পলিটিক্স করেন। এঁদের সঙ্গে প্রথম গাঁটছড়া বাঁধা দলটির নাম সিপিএম। পক্ষান্তরে, সিপিএমের শ্রেণিসংগ্রাম কোথায় গেল?
১৯৪৮ সালে ‘মার্কসবাদী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘রবীন্দ্র-সাহিত্যের সঙ্গে মার্কসবাদের বিরোধ এত প্রচণ্ড যে, প্রগতির শিবিরে তাঁর স্থান হতে পারে না। রবীন্দ্র-সাহিত্য হল প্রগতির শিবির থেকে মানুষ ভুলিয়ে বের করে নিয়ে যাবার মোহিনী মায়া’। ১৯৪১ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় এক কমিউনিস্ট সমালোচক রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি বুর্জোয়া, ধনতন্ত্রের প্রতিভূদের পক্ষে হিসেবেই অভিহিত করেন। এহেন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী সিপিএম পরবর্তীকালে সরকারে এসে খণ্ডে খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশ করেছে। এবং স্বীকার করেছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন ভুল ছিল।
সত্তর ও আশির দশকে ব্যাঙ্কিং ও ইনসিওরেন্স সেক্টরে কম্পিউটার নিয়ে আসার একটি আলোচনা শুরু হয়। চরম বিরোধিতা শুরু করে কর্মী সংগঠনগুলি। সর্বাগ্রে সেই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে ঝাঁপিয়েছিল সিপিএম। কর্মহীনতার জুজু দেখিয়ে কম্পিউটারকে আটকে দিয়েছিল। তার পরিণাম কী হয়েছে সেটা আমরা জানি। ২০০৪ সালে ‘ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’ নামক একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ওই সিদ্ধান্তকে চরম নির্বুদ্ধিতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু লাভ কী। ততদিনে তো অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে? বুদ্ধদেববাবু বলেছিলেন, আমাদের ওই সিদ্ধান্তটি ছিল চূড়ান্ত বুদ্ধিহীন। ফুলিশ! ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার ৬ বছর পর ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ইংরেজি পড়া বন্ধ করে দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। এই একটি ভুলের মাশুল কতগুলি প্রজন্ম দিচ্ছে বাংলায়?
সুতরাং সিপিএমে আজীবন ভুল করেছে অজস্র। এবং করেছে রেকর্ড। কেমন রেকর্ড? নবান্ন অভিযানে যাওয়া এক যুবকের পুলিসের লাঠির আঘাতেই মূত্যু হয়েছে বলে সিপিএম অভিযোগ করেছে, এমনকী বন্ধ ডেকেছে বাংলায়। রাজনৈতিকভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতেই পারে বিরোধী দল হিসেবে। কিন্তু সমস্যা হল, পাল্টা তৃণমূল বলার সুযোগ পাচ্ছে যে, ১৯৯৩ সালে মহাকরণ অভিযানে যাওয়া যুবকদের উপর গুলি চালিয়ে ১৩ জনকে মেরে ফেলেছিল সিপিএম সরকারের পুলিস। সিপিএম একটা কথা খুব বলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তো বিজেপিকে হাত ধরে এনেছেন বাংলায়। সমস্যা হল, এক্ষেত্রেও তারা আগেই রেকর্ড করে রেখেছে। ১৯৮৯ সালে সিপিএম রাজীব গান্ধীকে চোর আখ্যা দিয়ে বিজেপির সঙ্গে জোটে গিয়েছিল। বহু চেষ্টা করলেও ভুলের ক্ষেত্রে মমতা টেক্কা দিতে পারবেন না সিপিএমকে। ভুলের রেকর্ড সৃষ্টিতে বরাবর এগিয়ে সিপিএম। তৃণমূলকে সিন্ডিকেটের দল হিসেবে ব্যঙ্গ করে সিপিএম। অত্যন্ত জোরালো এক আক্রমণাত্মক রাজনীতি হতে পারতো এই ইস্যু। অথচ অনেক আগেই সিপিএম সম্পর্কে স্বয়ং সিপিএম নেতা ও মন্ত্রী বিনয় চৌধুরী প্রকাশ্যে বলে গিয়েছিলেন যে, এটা হল একটা ঠিকাদারদের সরকার! দুর্নীতিগ্রস্ত।
পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে হাত মেলানো ঠিক হল কি না, সেটা নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছে। উত্তর সময়ই দেবে। সমস্যাটি হল, সিপিএমের ভুল করার ট্র্যাক রেকর্ড। অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে জোটের তাল কাটার দরকার ছিল কোনও? এই সিদ্ধান্তটিও যদি ভুল প্রমাণিত হয় একদিন? রণকৌশল নির্মাণে পার্টির অন্দরে কারা চালিত করছে সিপিএমকে? বহুদিন পর, বাম-কংগ্রেস জোটের প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিজেপি এবং তৃণমূল বিরোধী মানুষের মনে একটা অন্তত ভাবনা দেখা দিচ্ছে যে, বিকল্প প্ল্যাটফর্ম পাওয়া যাচ্ছে। প্রবল ভিড় হয়েছে ব্রিগেডে। ওই ভিড় কী শুনতে এসেছিল? আর কী দেখেশুনে ফিরল তারা? সবথেকে বড় আশার কথা কং-সিপিএমের পক্ষে যেটা হয়েছে, আরবান এলিট এডুকেটেড যুবসম্প্রদায় এবং গ্রামগঞ্জের খেটে খাওয়া মানুষের একাংশ আবার বামপন্থায় আগ্রহ প্রকাশ করছে। কিন্তু ভুল করতে জুড়ি নেই সিপিএমের। এবার নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে সিপিএম বামপন্থার অনুষঙ্গ সেই শিহরণ জাগানো স্লোগান, পোস্টার, সংস্কৃতিকেই বিসর্জন দিয়ে দিল। ব্রিগেডের মঞ্চ অথবা মিছিলে পাওয়া গেল না শ্রেণিসংগ্রামের কোনও স্লোগান, নেই কৃষক শ্রমিকের জন্য কোনও বার্তা। কেন? কারণ আজ আর সিপিএমর প্রথম সারির কৃষক নেতা নেই। প্রথম সারিতে শ্রমিক নেতা নেই। আরবান মিডল ক্লাস দখল করে নিয়েছে সিপিএমকে। আর তারই সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এবার ব্রিগেডে সিপিএমকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিল টুম্পা-সঙ্গীত। এটি কি খারাপ সংস্কৃতি? মোটেই না। পপুলার কালচারকে ভালো মন্দ দাঁড়িপাল্লায় ওভাবে মাপা যায় না। উচিতও নয়। কিন্তু এই সিপিএমই কয়েক বছর আগে ব্যঙ্গ করেছিল তৃণমূলের পাগলু ডান্স সংস্কৃতিকে। একদা উষা উত্থুপ অথবা হোপ এইট্টি সিক্সের নিন্দা করেছিলেন কট্টরবাদী বাম নেতারা। বেদনার বিষয় হল, সিপিএম নিজেদের বড্ড লঘু করে দিচ্ছে!
সরকার, ভোটব্যাঙ্ক, বিশ্বাসযোগ্যতা, নেতৃত্বপ্রদানের নৈপূণ্য, সবই হারিয়ে ফেলেছে সিপিএম। শেষ নিশান হিসেবে অন্তত বেঁচেছিল পার্টির ঐতিহ্যময় স্লোগান আর ঘোষিত সংস্কৃতি চেতনা। এবার সেই ঐতিহ্যের পিছুটান থেকে নিজেকে মুক্তি দিল সিপিএম। শ্রেণিসংগ্রাম, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র এসব যে নিছক কথার কথা, সেকথা সিপিএম বুঝিয়ে দিল। কোনও দলের সঙ্গে তাদের ফারাক নেই। এক ও একমাত্র লক্ষ্য ভোটে জেতা। অধ্যাপক রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত তাঁর ‘অলীক সংলাপ’ নামক গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টির নামের পর ব্র্যাকেটে যদি মার্কসের নাম না থাকিয়া ভীম নাগের নাম থাকিত, তাহা হইলেও পার্টির প্রতিষ্ঠার কোনও হেরফের হইত না’।
সিপিএমের এবার ব্র্যাকেট-বদলের সময় এসেছে!