কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত স্বাক্ষর হয়েছিল ১৭৭৬-এর ৪ জুলাই। এই কথাটি মাথায় রাখলে বলা যায় যে, যাদের ‘অধিকার’ নেই সেই বিদেশিরা ভারতকে শাসন করেছে অথবা দেরিতে আসা স্বাধীনতা থেকে ভারতীয়দের তারা বঞ্চিত করেছে।
তার শতাধিক বছর বাদে একটি সার্বভৌম ভারত রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ধারণাটি ভারতের মাটিতে অঙ্কুরিত হয়। ১৯০৬ সালে কলকাতা কংগ্রেসে দাদাভাই নৌরজি ‘স্বরাজ’-এর দাবি উত্থাপন করেন, কিন্তু সেটি ছিল সীমিত পরিসরে স্বশাসনের (লিমিটেড সেলফ-গভর্নমেন্ট) চাহিদা। ১৯১৬ সালে বাল গঙ্গাধর তিলক এবং অ্যানি বেসান্ত ‘হোম রুল’-এর দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন এবং ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অধীনে ভারতবাসীর জন্য ‘ডোমিনিয়ান’ স্টেটাস চাইলেন। একমাত্র ১৯২৯-এ অনুষ্ঠিত লাহোর কংগ্রেসে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ বা সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলেছিল কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি।
স্বাধীনতা অর্জনের পথে ভারত বিশেষভাবে গ্রহণ করেছে ফ্রান্স এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ধারণাকে। ফরাসি বিপ্লবের রণধ্বনি—‘স্বাধীনতা, সাম্য এবং সৌভ্রাত্র’ আমাদের ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। ভারতীয় মনকে আরও নাড়িয়ে দিয়েছিল আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ক বিবৃতিটি—‘সব মানুষকে সমান করে সৃষ্টি করা হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে একান্ত কিছু অধিকারেও সমৃদ্ধ করেছে, সেগুলির মধ্যে রয়েছে—জীবন, স্বাধীনতা (লিবার্টি) এবং সুখের সাধনা।’ এর মধ্যে সবচেয়ে প্রার্থিত শব্দটি হল ‘স্বাধীনতা’ (লিবার্টি)।
স্বাধীনতার উপর আক্রমণ
ভিন্নমত অথবা প্রতিবাদ কিংবা অমান্য করার প্রতিটি কণ্ঠ রুদ্ধ করার জন্য স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে অতীতে কখনও এতটা নির্দয়ভাবে ব্যবহার করা হয়নি। জরুরি অবস্থার সময় (১৯৭৫-৭৭) ‘রাজনৈতিক’ বিরোধীরাই শুধু টার্গেট বা লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এখন টার্গেট তো সমস্তরকম ভিন্নমতের কণ্ঠ—সে হতে পরে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক অথবা শিক্ষা সংক্রান্ত ভিন্নমত। সিংঘু এবং টিকরির কৃষকরা জনবিরোধী কৃষি আইনগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের প্রতিবাদটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজেপির বিরুদ্ধে কিন্তু নয়। তবু সরকারি তদন্তকারী এজেন্সিগুলির মাধ্যমে কৃষকদেরকে টার্গেট করা হয়েছে। দলিতদের উপর সংঘটিত অপরাধ, বৈষম্য সৃষ্টি, জিনিসের দাম বৃদ্ধি, তথ্য দিতে অস্বীকার, দূষণসৃষ্টিকারী, পুলিসের বাড়াবাড়ি, একচেটিয়া কারবার, স্বজনপোষণ (ক্রোনিইজম), শ্রমিকদের অধিকার নস্যাৎ, সর্বনাশা অর্থনীতি এবং এই ধরনের অন্য অন্যায়গুলির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী কণ্ঠ জাগ্রত রয়েছে। প্রতিটি ভিন্নমত অথবা প্রতিবাদী কণ্ঠকে বিজেপি সরকারের বিরোধী বলে গণ্য করা হয় এবং সেগুলি দমন করার চেষ্টা হয়।
কৃষকদের প্রতিবাদ আন্দোলনকে সমর্থন করছিলেন দিশা রবি। কিন্তু তিনি কোনও রাজনীতির গোঁড়া সমর্থক নন। তবু তাঁকে রাষ্ট্রের শত্রু দেগে দেওয়া হয়েছে। দিশার আগে সিধিক কাপ্পান নামে এক সাংবাদিক সরকারের রোষে পড়েছিলেন। হাতরাসে ধর্ষণের পর নিহত মেয়েটির উপর একটি প্রতিবেদন লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তাঁকে দেগে দেওয়া হয়েছিল। যেসব ছাত্রছাত্রী এবং মহিলা নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তাঁদের ‘টুকরে টুকরে’ গ্যাং বলা হয়েছিল। এই বলে অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, তাঁরা ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং ঐক্য বিপন্ন করার চেষ্টায় আছেন। নিজেদের অধিকার রক্ষার দাবিতে লড়াই করছিলেন একদল শ্রমিক। তাঁদের সমর্থন করেছিলেন নোদীপ কাউর নামে এক মহিলা। তাঁকে জেলে ভরে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে দাঙ্গা এবং খুনের চেষ্টার চার্জ আনা হয়েছে। যে জোকটা করাই ‘হয়নি’ তার জন্য মুনাবার ফারুকি নামে এক কমেডিয়ানকে জেলে ভরে দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হানার চার্জ আনা হয়েছে। স্বাধীনতার প্রতিটি দিকের উপর আঘাত হানা সম্পূর্ণ হয়েছে এবং সেগুলি বেশ স্পষ্ট।
নির্বিকার দর্শক
আদালত—বিশেষত নিম্ন আদালত নির্বিকার দর্শক, তারা রুটিনমাফিক গ্রেপ্তারে অনুমোদন দিচ্ছে এবং বুদ্ধির প্রয়োগ ছাড়াই ধৃতদের পুলিস হেফাজত অথবা বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। দেশের অপরিবর্তনীয় আইন (সেটেলড ল’) অনুসরণ করা হয়নি। রাজস্থান রাজ্য বনাম বালচাঁদ মামলায় বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ার ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘সাধারণ নিয়ম সম্ভবত এটা হতে পারে যে জেল নয়, মার্জিতভাবে জামিন মঞ্জুর করা...’। মনুভাই রতিলাল প্যাটেল মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছে, ‘তিনি তাঁর বুদ্ধি খাটিয়ে ঠিক করবেন—পুলিস হেফাজতে পাঠানোর যৌক্তিকতা কিছু আছে কি না অথবা বিচার বিভাগীয় হেফাজতে গ্রহণের কোনও যৌক্তিকতা আছে কি না কিংবা কোনও ধরনের হেফাজতে গ্রহণের প্রয়োজন আদৌ নেই।’ এই রুলিংগুলি থাকা সত্ত্বেও আদালতগুলি মানুষকে সানন্দে জেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
হেফাজতে গৃহীত (আন্ডার-রিমান্ড) এবং বিচারাধীন (আন্ডার-ট্রায়াল) বন্দিদের কাহিনিটা হল নির্লজ্জভাবে স্বাধীনতা লঙ্ঘনের। মাসে একবার কী দু’বার বন্দিদের আদালতে হাজিরার দিন পড়ে। অন্যথা হবে না, নিম্নোক্ত ব্যাপারগুলির মধ্যে একটি ঘটবেই: তদন্তকারী অফিসার গরহাজির থাকবেন অথবা সরকারি আইনজীবী গরহাজির হবেন অথবা বাদীর (মামলাকারী) সাক্ষী আদালতে এসে পৌঁছতে পারবেন না অথবা মেডিক্যাল রিপোর্ট প্রস্তুত হয়ে উঠবে না কিংবা বিচারক সময় দিতে পারবেন না অথবা বিচারক সেইসময় ছুটিতে থাকবেন। আর একটি ‘ডেট’ নিয়ে বন্দি ফিরে যাবে জেলে এবং তার বিচারের আশা ফিকে হয়ে আসবে। উচ্চ আদালতগুলিতে এই সমস্যা যে খুব কম তেমন নয়: হাইকোর্টগুলিতে ও সুপ্রিম কোর্টে জামিনের হাজার হাজার আবেদন ঝুলে রয়েছে এবং একবারের শুনানিতে আবেদনের নিষ্পত্তি বিশেষ একটা হয়ও না। আমি দেখেছি, জামিনের প্রতিটি আবেদনের ক্ষেত্রে এসব হয়ে থাকে তদন্তকারী সংস্থাগুলির (পুলিস, সিবিআই, ইডি, এনআইএ প্রভৃতি) একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে।
আশ্বস্ত করার রায়
একজন অর্ণব গোস্বামী তাঁর শিক্ষা পেয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট (বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়) আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে ‘স্বাধীনতার বঞ্চনা একদিনের জন্যে হলেও, ওই একটি দিনই অনেকখানি।’ আমি খুশি যে আরও অনেক বিচারপতি গোঁয়ার-গোবিন্দ তদন্তকারী সংস্থাগুলির বিরোধিতাকে আর রেয়াত করছেন না এবং তাঁদের বিবেচনা থাকছে স্বাধীনতার পক্ষে। ভারভারা রাও মামলায় বম্বে হাইকোর্ট ৮২ বছর বয়সি কবিকে মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে জামিন মঞ্জুর করেছে। দিশা রবি মামলায় বিচারক রানা গণতন্ত্রের মর্মবস্তুর উপরেই গুরুত্ব আরোপ করেছেন: ‘মতের অমিল, বৈসাদৃশ্য, ভিন্নতা, ভিন্নমত পোষণ অথবা তার জন্যে অননুমোদনও, রাষ্ট্রীয় নীতিতে বস্তুনিষ্ঠতা সঞ্চার করার পক্ষে এক স্বীকৃত আইনি উপায়।’
যেহেতু আদালতগুলি স্বাধীনতা বা মুক্তি (লিবার্টি) বজায় রাখার পক্ষে, আমি অনুভব করছি যেন দ্বিতীয় স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়েছে, এবং কারান্তরালে যাঁরা মনোকষ্টে কাটাচ্ছেন, হতে পারে তাঁরা মুক্তির নিশ্বাস নিতে পারবেন।
লেখক সংসদ সদস্য এবং ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত