পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
সেইদিকে নজর রেখেই আসন্ন নির্বাচনে আরও একটা ভয়ঙ্কর খেলাতে অত্যন্ত সচেতনভাবে মনোনিবেশ করেছেন আলিমুদ্দিনের কর্তারা। হিসেব কষে মুসলিম ভোটে ভাঙন ধরাতে ধর্মনিরপেক্ষ সূর্যকান্ত-সেলিমরা হাত মেলাচ্ছেন ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে। এমনকী, ইতিমধ্যেই ভাঙড়, উলুবেড়িয়ার একটা বড় অংশ থেকে শুরু করে নন্দীগ্রাম আসন পর্যন্ত ভাইজানকে ছাড়ার ব্যাপারে কথা চূড়ান্ত হয়েছে বলেই খবর। তা যদি সত্যি হয় এবং মুসলিম ভোটে ভাঙন ধরে, তাহলে লাভবান হবে কে? মমতাকে নন্দীগ্রামে অস্বস্তিতে ফেলে কোন লক্ষ্যপূরণ করতে চাইছে বামেরা। এ তো ঘুরিয়ে বহিরাগত বিজেপিকেই সুবিধা করে দেওয়ার কৌশল! লোকসভায় বামের ভোট রামে পৌঁছে দিয়েও জ্বালা জুড়ায়নি, এবার সংখ্যালঘু ভোট ভেঙে রাজ্যের বামশক্তি নিজেকে আরও বড় কালিদাস প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টায় ব্রতী হয়েছে। ওই যে গাছের ডালটায় বসে দশকের পর দশক পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, সেই ডালটাকেই কেটে ফেললে বামেদের অস্তিত্বও অটুট থাকবে তো!
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করা নিয়ে ফ্যাসিস্ট গেরুয়া শক্তি আজ যে কষ্টকল্পিত স্বপ্নটা দেখছে তার ভিত্তিটা কী? খুব সোজা হিসেব—দীর্ঘ একযুগ ধরে কমতে থাকা বাম ভোটব্যাঙ্কে চূড়ান্ত থাবা বসানোই তাদের লক্ষ্য। বামপন্থীরা চূড়ান্ত হতাশায় না ভুগলে এরাজ্যে তাদের ভোট কোনওভাবেই ২০ শতাংশের নীচে নামতে পারে না। কিন্তু তৃণমূলকে শিক্ষা দিতে আবারও সেই আত্মঘাতী পথেই হাঁটছেন বঙ্গীয় কমরেডরা। সেই ঝোঁক থেকেই বাংলায় খাল কেটে কুমির আনার বিপজ্জনক খেলায় মেতেছে গোটা দলটা। এ খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে গত লোকসভা নির্বাচন থেকেই। বামের ভোট রামে। সঙ্গে লালপার্টির অন্দরে অদ্ভুত এক চোরা ফিসফিসানি, একুশে রাম, ছাব্বিশে ফের বাম। সেই তাগিদেই লাল পতাকা নিয়ে হাঁটা মানুষের ভোট পড়ছে গেরুয়া শিবিরে। নাহলে এরাজ্যে সিপিএমের ভোট ৬.৩ শতাংশ, আর বিজেপির ভোট ৪০ শতাংশের বেশি, এই উলটপুরাণের পরিসংখ্যান আলিমুদ্দিনের কর্তারা সহজে হজম করতে পারতেন! অথচ ২০১১ সালে মমতার হাতে ভরাডুবির নির্বাচনেও অক্লেশে ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল সিপিএম। ব্রিগেডে যখনই সভা হয়েছে, তখনই মাঠ উপচে গিয়েছে। বিমানবাবুরা আহ্লাদিত হয়েছেন। কিন্তু কৃষক, শ্রমিক, খেটেখাওয়া মানুষের ভোট আর ফেরেনি। পক্বকেশ নেতৃত্বের উপর কমরেডরা আস্থা রাখতে পারেননি। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বামেদের ভোট কমে দাঁড়ায় ২০ শতাংশ। বাম ও কংগ্রেস জোট করেও চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়। এরপর থেকেই বামে আস্থা হারিয়ে গেরুয়া শিবিরে যাওয়ার ঝোঁক বেড়েছে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফল সেই ভয়ঙ্কর পরিণতির ইঙ্গিতই বহন করছে। এবার হারানো জনসমর্থনের ক্ষতস্থানে মলম লাগাতে একদিকে কংগ্রেস আর অন্যদিকে আব্বাস সিদ্দিকিকে ফুলমালা পরিয়ে আবাহন করেছেন সেলিম, সূর্যকান্তরা। কিন্তু সেই কৌশল শেষপর্যন্ত সফল হবে, না এবারও নেপোয় দই মেরে বামেদের আরও বড় ক্ষতি করে যে চলে যাবে, তা বোঝা যাবে ভোটের ফলে, আগামী ২ মে।
বঙ্গীয় কমরেডরা বুঝতে পারছেন না, বামের ভোট রামে পাঠানোর এই সর্বনাশা খেলা দলটার আরও বারোটা বাজিয়ে দেবে। সর্বনাশ হয়ে যাবে রাজ্যটার। এই উপলব্ধি এখনও না-হলে ফ্যাসিস্ট শক্তি যে আলিমুদ্দিনের একটা ইটও আস্ত রাখবে না সে কথা বোঝাবে কে? এবং, সিপিএম যত ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করেছে তার সব রেকর্ড ছাপিয়ে যাবে। কারণ অবশিষ্ট ৬ শতাংশ ভোটও যদি আবাঙালি প্রধান দলের ঝুলিতে চলে যায় তার সম্পূর্ণ দায় বর্তাবে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রদের উপর। ছাব্বিশ কেন, ছত্রিশেও সেই ভুল সংশোধন করে লাল ঢেউ ফেরানোর সুযোগ পাবেন না বামপন্থীরা।
১৯৯৬ সালে মাত্র ৩২ জন এমপি নিয়ে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভোটাভুটিতেই ভেস্তে দিয়েছিল। ওই ইস্যুতে আজ এই দুর্দিনেও দল আড়াআড়ি বিভক্ত। এখনও তিনজন বামপন্থী একজায়গায় বসলে জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া নিয়ে ঝড় ওঠে। কিন্তু তখন দল এতটা সঙ্কটের মধ্যে ছিল না। তারপরও দীর্ঘ ১৫ বছর বামেরা পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে হেসেখেলে। ত্রিপুরায় লাল পতাকা উড়েছে। কেরলে ক্ষমতায় এসেছে গিয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ২০০৪ থেকে ২০০৮, ওই চারবছরই ছিল এদেশে বামপন্থীদের স্বর্ণযুগ। কিন্তু ওই যে বললাম, সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। আকস্মিক পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে সমর্থন প্রত্যাহার করে প্রথম দলের পায়ে কুড়ুল মারলেন প্রকাশ কারাত। তার আগেই অবশ্য ২৩৫-এর অহঙ্কারে বুদ্ধদেববাবু অন্যায়ভাবে জমি দখল করে সিঙ্গুরের কৃষকদের খেপিয়ে বসে আছেন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নন্দীগ্রাম আন্দোলন। জোড়া ধাক্কায় পার্টি ল্যাজে গোবরে। কিন্তু ২০০৮ থেকে ২০২০ দীর্ঘ এক যুগ ধরে সিপিএমের এই জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ কি শুধুই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনমুখী রাজনীতির কাছে পরাজয়, নাকি পদে পদে ভুল সিদ্ধান্ত, বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ? কে বড় শত্রু তা চিনতে ভুল করা? আজও কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে কুস্তি, আর বাংলায় দোস্তি! এ নিয়ে আত্মসমীক্ষা কি বামদলগুলি কখনও করেছে? কোথায় ভুল, দায়ী কে?
এই ভুল আর বিভ্রান্তির জন্যই গত লোকসভা ভোটে সারা দেশে ৭০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে সিপিএম মাত্র তিনটি আসন জিতেছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মতো একদা লাল পতাকার গড়েও প্রাপ্তি শূন্য! এই বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় কারণ কে বড় শত্রু তা চিহ্নিত করতেই একযুগ কেটে যাওয়া নয় কি? কার্যত বিজেপি ও কংগ্রেস থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখার রাজনীতি করতে গিয়ে গেরুয়া শক্তির বৃদ্ধিকেই ঘুরিয়ে ত্বরান্বিত করেছে বামপন্থীরা। সেই প্রক্রিয়ারই আজ নগ্নরূপ দেখছে পশ্চিমবঙ্গও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে না পেরে তলে তলে দলের নীচের তলা বিজেপিকে সাহায্য করছে। বাংলার রাজনীতির এই কঠিন সময়েও সে খেলা চলছে নিরন্তর। কিন্তু তৃণমূলকে শিক্ষা দেওয়ার নামে বিজেপিকে জমি ছেড়ে দেওয়ার অর্থ দেশের বিরোধী শক্তিকেই দুর্বল করা। কারণ তৃণমূল ও বিজেপির থেকে সমদূরত্বের রাজনীতির অর্থ আখেরে মোদি, অমিত শাহ তথা সঙ্ঘ পরিবারকেই অক্সিজেন দেওয়া। সিপিএমের মিছিলে হাঁটা কমরেডরা বাংলায় পদ্মফুল ফোটালে আখেরে লাভ কার? আরএসএসের তালে তাল মেলালে ইতিহাস কি বামেদের ক্ষমা করবে? নেতাজিকে বিশ্বাসঘাতক, তোজোর কুকুর বলে দেগে দেওয়ার কলঙ্ক আজও মোছেনি। আজ আবার এক ঐতিহাসিক ভুলের দোরগোড়ায় বামেরা। যাঁরা ভাবছেন এতে করে আখেরে লাভ হবে, তাঁদের সম্মান দিয়েই বলি, এতে জাত যাবে, পেটও ভরবে না। সঙ্ঘ পরিবার রাজ্যটাকে ঘিরে ফেলবে। সেই শৃঙ্খলে বাংলা ও বাংলার মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব অবলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই আজ ব্রিগেডে ভিড়ের হিসেব নয়, ভোটের হিসেব হোক। দু’বছর আগে—৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯-এর বিশাল সমাবেশের পরও ব্যাপক ভিড় দেখে ভোটের বাক্সে রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে বলেই আশা করেছিল বামপন্থীরা। কিন্তু, সেই আশা পূরণ হয়নি। এবার অন্তত বাংলার স্বার্থে বামপন্থীরা নিজেদের ভোটটা ঠিক জায়গায় ফেলুন। সর্বনাশের হাত থেকে রাজ্যটাকে বাঁচান। বাম ভোটে সিঁদ কাটতে না পারলে গেরুয়া বেলুন চুপসে যেতে বাধ্য।