কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
বাংলা হল মহামানবের এক শ্রেষ্ঠ সাগরতীর। তবু ‘বহিরাগত’ নিয়ে বাঙালির অ্যালার্জি নতুন নয়। কারণ, বাংলা বারবার বহিঃশত্রুর হাতে আক্রান্ত হয়েছে। কখনও হয়েছে বর্গির হানা। হামলা করেছে কখনও হার্মাদরা, কখনও মগ দস্যুরা। ফরাসিরা চন্দননগর দখল করেছিল। ইউরোপের আরও নানান জাতি নানা সময়ে বিবিধ অছিলায় বাংলাকে শোষণ করার চেষ্টা করেছিল। আর ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পতনের পর সারা ভারতই তো কোম্পানির, ক্রমান্বয়ে ইংরেজ জাতির পদানত হয়েছিল। ব্রিটিশের শত্রুতার সেই শুরু। ১৯৪৭-এ তারা বিদায় হল বটে, কিন্তু বাংলাটাকে দু’টুকরো করে দিয়ে। পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গে অমানুষিক অত্যচার করেছে পাক সেনারা। বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে করেছে অপমান, অবদমন। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমেই বাঙালিরা সমুচিত জবাব দেয়। শুধু ওপারের বাঙালির কৃতিত্ব বলতে পারতাম। কিন্তু তাতে সত্যের অপলাপ হতো। এপারের বাঙালিরাও স্বাধীনতার যোদ্ধাদের পাশে সবরকমে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিটা সারা পৃথিবীর বাঙালির এক অখণ্ড কৃতিত্ব বললে অত্যুক্তি হবে না। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন, ‘বহিরাগত’ ভীতি বাঙালির কাছে নতুন নয় কেন। বহিরাগতদের রুখতে বাঙালি-মন সদা জাগ্রত থাকে। পশ্চিমবঙ্গবাসী বা বাঙালিদের এই চেতনাকে সংকীর্ণ ভাবা ঠিক হবে না। তারা ভারতকে যতখানি তার প্রিয় দেশ মনে করে, বাঙালি ভাবতেও গর্ব অনুভব করে ঠিক ততখানি। বাঙালি সত্তা অক্ষুণ্ণ রেখেই আমরা ভারতসন্তান।
প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। ওই পদে অল্পদিনই ছিলেন। তারপর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি তাঁকে একটি গুরুদায়িত্ব দেয়—ময়ূরভঞ্জ এবং কোচবিহার দেশীয় রাজ্য দু’টি কোন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে মতামত প্রদানসহ একটি রিপোর্ট তৈরি করার জন্য। ডঃ ঘোষ তাঁর রিপোর্টে বলেন, ময়ূরভঞ্জ যাবে উড়িষ্যায় (ওড়িশা) এবং কোচবিহার ঢুকবে বাংলায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলের তাতে আপত্তি ছিল। প্যাটেলের মতে, কোচবিহার আসামের (অসম) অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। পশ্চিমবঙ্গের সৌভাগ্য যে ডঃ ঘোষের যুক্তি ও মতকে ওয়ার্কিং কমিটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করেছিল। ডঃ ঘোষ না থাকলে আয়তনে এই বাংলা সেদিন আরও ছোট হয়ে যেতে পারত। নিজের মাটির প্রতি ভূমিপুত্রের দরদ যে একটু বেশিই হবে, তাতে বিস্ময়ের কী আছে।
ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের আত্মজীবনীধর্মী গ্রন্থ ‘জীবনস্মৃতির ভূমিকা’র আরও একটি অংশ বাঙালিকে ভাবায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা পায়। ১৪ আগস্ট মুর্শিদাবাদ ও মালদহ শহরে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে। অন্যদিকে, খুলনায় ভারতের জাতীয় পতাকা তোলা হয় ১৫ আগস্ট। দুই বাংলার সীমান্ত নির্ধারণের দায়িত্বে ছিলেন র্যাডক্লিফ। ১৭ আগস্ট তাঁর যে রায় বেরল তাতে দেখা গেল, খুলনা পাকিস্তানে এবং মালদহ ও মুর্শিদাবাদের একাংশ ভারতে পড়েছে। স্বভাতই দুই সম্প্রদায়ের বহু মানুষ আশাহত হলেন। দুই বাংলার পরিস্থিত হঠাৎই থমথমে হয়ে গেল। তখন ডঃ ঘোষ উদ্যোগী হয়ে স্যার নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে এক যৌথ বিবৃতি দিলেন, যার সারমর্ম হল—র্যাডক্লিফের রায়ের পরিবর্তন যা দরকার তা করতে হবে দুই বাংলার মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে। কিন্তু, সেটা না-হওয়া পর্যন্ত এই রায়ই সবাইকে মেনে চলতে হবে। এই বিবৃতি সর্দার প্যাটেলের পছন্দ হয়নি। এমন বিবৃতি কেন দেওয়া হল, তিনি জানতে চাইলেন। জবাবে ডঃ ঘোষ বললেন, ‘‘এই বিবৃতি দিয়ে বাংলাকে রক্তপাতের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। নইলে বাংলার অবস্থা পাঞ্জাবের মতো হতো।’’ তাতে বল্লভভাই বিরক্তির সুরে বললেন, ‘‘হোতা তো ক্যায়া হোতা?’’! প্যাটেলের এই বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়ার জবাবে ডঃ ঘোষ একজন খাঁটি ভূমিপুত্রের মতোই বলেছিলেন, ‘‘সে-কথা আপনি বলতে পারেন, আমি পারি না।’’ মহাত্মা তখন কলকাতায়। নোয়াখালি যাওয়ার পথে এসেছেন। শহরে অভূতপূর্ব সম্প্রীতির পরিবেশ দেখে মুগ্ধ। ঘোষ-নাজিমুদ্দিনের যে বিবৃতি প্যাটেলকে রুষ্ট করেছে, সেই বিবৃতিকে মহাত্মা বিজ্ঞজনোচিত আখ্যা দিলেন প্রকাশ্যসভায়।
১৯৪৭-এর আরেকটি ঘটনা। ডঃ ঘোষ তখন পশ্চিমবঙ্গের ছায়ামন্ত্রিসভার নেতা। এক দুপুরে গান্ধীজির একটি চিঠি পেলেন। পড়ে তো অবাক। গান্ধীজি লিখেছেন, সর্দারের ইচ্ছে পশ্চিমবাংলার মন্ত্রিসভায় একজন মাড়ওয়ারি সদস্য নেওয়া হোক—বদরীদাস গোয়েঙ্কা অথবা দেবীপ্রসাদ খৈতান! অথচ, এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগেই ডঃ ঘোষ মন্ত্রীদের নাম নেতৃত্বের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে এনেছেন। ডঃ ঘোষ লিখেছেন, ‘‘অনুমোদনকারীদের মধ্যে ছিলেন একজন সর্দারও। তখন, এমনকি তিনি একলাও এ বিষয়ে আমাকে কিছু বলেননি।’’ অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে ‘সর্দার’ বলতে বল্লভভাই প্যাটেলকেই বুঝিয়েছেন ডঃ ঘোষ। এই আজব প্রস্তাবে ডঃ ঘোষের আপত্তি ছিল। মহাত্মা কানে কম শোনেন। তাই ডঃ ঘোষ ফোনে কৃপালনীর মারফত তাঁর মত গান্ধীজিকে জানান। মহাত্মা তাতে বিন্দুমাত্র রাগ করেননি। কৃপালনীকে তিনি বলেন, ‘‘প্রস্তাবটি প্রফুল্ল যদি সংগত মনে না করে, তবে ধরে নিতে পারে যে আমি তাকে এই চিঠি লিখিইনি।’’ ডঃ ঘোষের বক্তব্য ছিল, মাড়ওয়ারি বা ভিন রাজ্যের লোক বলে কারও সম্পর্কে তাঁর বিরূপ মনোভাব নেই। এই ধরনের কোটায় তাঁর কোনও আস্থা ছিল না। জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে যোগ্য ব্যক্তির জন্য যোগ্য পদই ছিল তাঁর পছন্দ। যেমন কারও সুপারিশ ছাড়াই বিধানসভার স্পিকার পদে তিনি ঈশ্বরদাস জালানকে বেছে নিয়েছিলেন। ঈশ্বরদাস মাড়ওয়ারি সম্প্রদায়ের একজন যোগ্য পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন। ডঃ ঘোষ মনে করতেন, বাংলার কোনও বড় দায়িত্বে যাঁকে নেওয়া হবে, তিনি যেন বর্তমানে বাংলার অধিবাসী হন। অনেক আগে তাঁর জন্ম অন্য যে প্রদেশেই হোক না কেন, তা বিচার্য নয়। এই ধরনের ব্যক্তি, এখানে জন্ম নেওয়া মানুষের মতোই পশ্চিমবঙ্গের সুখ-দুঃখের সমান ভাগীদার হবেন। গত সাত দশকে বিধানসভা, রাজ্য মন্ত্রিসভা এবং কলকাতাসহ বিভিন্ন পুরসভায় এই উদার চেতনার প্রতিফলন আমরা বারবার দেখেছি। লোকসভা এবং রাজ্যসভাতেও বাংলার প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন অন্য প্রদেশের কিছু ব্যক্তিত্ব। তা নিয়ে কোনও বঙ্গসন্তান কখনও কোনও আপত্তি করেছেন বলে শুনিনি।
এই বাংলাতেই এবার স্লোগান উঠেছে—‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’। অসম্ভব আবেগমথিত এক স্লোগান। ঘরের মেয়েকে ঘরে ফেরানো নিয়ে বাঙালির বাৎসরিক আবেগের কথা নতুন কী। দুর্গাকে বছর বছর কাছে পাওয়ার জন্য বাংলার মন সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে। তাকে আবাহন করার জন্য সারা বছর ধরে প্রস্তুত হয়। একটু একটু করে পয়সা জমায়। পরিকল্পনা করে কোন নতুন জামাকাপড় পরে তার সামনে দাঁড়াবে। এবার কেমন প্রতিমা হবে। গতবারের থেকে বড় করতে হবে। প্যান্ডেল বা মণ্ডপ সজ্জা আরও আকর্ষণীয় করতে হবে। গতবার কোন কোন ঠাকুর দেখা হয়নি, এবার সেগুলোও দেখতে হবে। সমবেত প্রার্থনা চলে, যেন ঝড়বৃষ্টি না-হয়। কারও কারও কাছে অগ্রাধিকার থাকে গতবারের চেয়ে বেশি সমাজসেবা বা গরিবকল্যাণে ব্যয়-বণ্টন।
বাংলায় ভোটের স্লোগান নিয়ে যদি কখনও গবেষণা হয় তবে এই ক্যাচ লাইনটি বিশেষ স্থান করে নেবে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে—‘খেলা হবে।’ এই কথার নানান ব্যাখ্যা ভাসছে। কারও কারও ধারণা, এর মধ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ, রক্তক্ষয়ের নির্মম এক ইঙ্গিত রয়েছে। তার মধ্যে যাচ্ছি না। এই হাইভোল্টেজ ভোটে, মনে হয়, আসল খেলাটি হবে বাংলার সম্মানরক্ষার প্রশ্নে। অন্য রাজ্য থেকে উড়ে আসা নেতাদের চাপিয়ে দেওয়া মাতব্বরি বাংলা এবারও মানবে না। গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়লের মতোই প্রত্যাখ্যাত হবেন তাঁরা। এই স্পর্শকাতর সময়ে ঘরের মেয়েই যে সেরা বাজি, ভোটের দিন যত এগবে সেটা তত স্পষ্ট হবে।