কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
আজ যাঁরা সোনার বাংলা গড়ার ডাক দিয়ে হঠাৎ ঝড় তুলতে মরিয়া তাঁরা গত সাত বছরে কেমন খাঁটি সোনার ভারত উপহার দিয়েছেন তা তো সবারই জানা। দেখা যাক, কেমন স্বর্ণ যুগের মুখোমুখি আমরা। পেট্রলের দাম সেঞ্চুরি পার করেছে। দাম বাড়ার বিরাম নেই টানা দু’সপ্তাহ। পিছন পিছন ছুটছে ডিজেল। গত দু’মাসে লাফিয়ে দাম বেড়ে রান্নার গ্যাস আজ ৮০০ টাকা। আরও অদ্ভুত, দাম বাড়লেও ভর্তুকি একই থাকছে। এই একুশ সালেই গ্যাসের দাম হাজার ছাড়ালেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। সবমিলিয়ে মধ্যবিত্তের রান্নাঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার।
টানা তিনমাস অসহায় কৃষকরা দিল্লির সীমানায় বসে। তাঁদের দাবি একটাই, চাষই তাঁদের জীবিকা, সেই অধিকারটুকু যাতে রক্ষা হয় সরকার দেখুক। সেই সঙ্গে একান্ত আর্জি, দয়া করে কর্পোরেটদের দরজায় ভিক্ষের থালা নিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করবেন না। সরকার বাহাদুর তাঁদের সেই কথায় কান দেয়নি। দেওয়ার কথাও নয়। সোনার দেশে হীরকরাজ্যের মতোই সরকারের সংবেদনশীলতা স্বাভাবিকভাবেই শূন্যে গিয়ে থামে। তাই সেই দাবিও মেটেনি। উল্টে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে বিস্তর নিন্দা আর সমালোচনা শুনতে হয়েছে। নতুন শব্দের অবতারণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আসলে এরা সব ‘আন্দোলনজীবী’। হাড় কাঁপানো ঠান্ডা আর পুলিসি হেনস্তায় প্রাণ গিয়েছে দু’শোরও বেশি খাদ্য সেনানীর। এভাবে বসে থাকতে হলে আরও কৃষকের প্রাণ যাবে আসন্ন গরমেও। তবু শাসকের শক্ত বাঁধন আলগা হওয়ার নয়।
সোনার দেশে শ্রমিকদের হাতে আজ এত কাজ যে আট নয়, দৈনিক বারো ঘণ্টা খাটানোর ব্লু প্রিন্ট তৈরি করছে সরকার। সেখানেও সাধারণ শ্রমিক নয় সরকারের সমর্থন বৃহৎ শিল্পপতিদের পক্ষেই। একদিকে কাজ বাড়ন্ত, সঠিক মজুরি মিলছে না, বেকারত্বের হাতছানি। তার উপর একই মজুরিতে কাজের সময় যাচ্ছে বেড়ে। পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ না পেয়ে এখনও বিপন্ন ভবিষ্যতের খোঁজে হেঁটেই চলেছেন। তাঁদের জন্য চার্টার্ড বিমান তো আর দেওয়া যায় না, ওটা তৈরি রাখা হয়েছে বাংলার মাঝে মাঝে আচমকা দম বন্ধ হওয়া দলবদলুদের জন্য! শ্রমিকদের কষ্টের শরীর। তবু পেটে খেলে তবেই না পিঠে সয়! সাত বছর আগে দেওয়া বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি কেউ ভুলেও রক্ষা করেনি। বরং রেলের চাকরিও অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। প্রতিশ্রুতি মতো কারও অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা ঢোকেনি, উল্টে চাকরিটাকেই কেড়ে নেওয়ার দু’শো আয়োজন।
ক্ষুদ্র থেকে বড় শিল্প কেউই নোট বাতিল থেকে লকডাউনের ক্ষত মেরামত করে আজও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার মতো অবস্থায় নেই। উল্টে বিষ ফোঁড়ার মতোই দগদগে জিএসটি। সমাজের কোথাও ঘা সারানোর তৎপরতা নেই, উল্টে সরকারি মলমের অভাবে নতুন নতুন ঘায়ে জ্বালা বাড়ছে। উত্তরপ্রদেশের হাতরাসের নৃশংস নারী ধর্ষণ ও লাঞ্ছনার ঘটনার পর আর এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে যোগীর রাজ্যের উন্নাওতে। খুব সম্প্রতি সেখানে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে দু’জন দলিত রমণীকে। তাহলে কীসের সোনার ভারত? আর কীসের ভিত্তিতেই বা ক্ষমতায় এলে সোনার বাংলা গড়ার গালভরা আশ্বাস। সবই তো আসলে বোকা বানানোর কারসাজি। সজাগ জনগণকে বাংলা দখলের এই সুগভীর চক্রান্তকে যে কোনও মূল্যে পরাজিত করতেই হবে। অন্যথায় পানের পিকে পিছলে পড়ে বাঙালির মেরুদণ্ডটাই ভেঙে যাবে চিরকালের জন্য।
কেমন সোনার সংসদ দেখছি আমরা? কোনওরকম আলোচনা ছাড়াই পাশ হয়ে যাচ্ছে বিতর্কিত আইন। তাতে কার গেল আর কার এল কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই সরকারের। এই আকালের বাজারেও হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হচ্ছে আরও বড় পার্লামেন্ট ভবন। কেউ যাতে মুখ খুলতে না পারে তাই বুলডোজ করো বিরোধীদের। মোদিজি জানেন, আপসহীন প্রতিবাদী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সহজে দুর্বল করা সম্ভব নয়। বাংলার এই অসম সাহসী নেত্রী প্রাণ থাকতে লড়াই থেকে পিছু হটতে শেখেননি। তাই সব ভুলে ঝাঁপিয়ে পড় বাংলায়। অসম, ত্রিপুরাকে মিথ্যে সোনা দিয়ে মুড়ে দেওয়ার নাটকের পর আপাতত লক্ষ্য তাই একটাই। বাংলা দখল। সপ্তাহে তিনবার করে যাও আর দেদার প্রতিশ্রুতি দাও। সপ্তম বেতন কমিশন থেকে শিক্ষকদের দাবি মেটানো, মৎস্যজীবীদের সম্মান জানাতে বছরে ৬ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা, বলতে তো ট্যাক্স লাগে না। সবই আসলে ভোটমুখী বঙ্গে সস্তায় বাজিমাত করারই চটকদারি টোপ মাত্র। না আঁচালে বিশ্বাস নেই। ত্রিপুরায় ২৫ বছরের বাম শাসন উৎখাত করে বিজেপি ক্ষমতায় আসে ২০১৮ সালে। বাংলার মতো সেখানেও সোনার ত্রিপুরা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অমিত শাহরা। পরিবর্তে এখন কী দেখা যাচ্ছে? ডাহা এক উন্মাদের হাতে রাজ্যটাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ডাবল ইঞ্জিন মানে কী তাহলে এই! ক্ষমতায় এসেই মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব রাজ্যবাসীকে চমকে দিয়ে বলেছিলেন, মহাভারতের যুগ থেকেই নাকি ইন্টারনেট আর স্যাটেলাইট চালু আছে। বিপ্লববাবুর বিদ্যের বহরে সেদিন চমকে উঠেছিল দেশ। বলে কী লোকটা! তবে ওই টুকুতেই থামেননি। সিভিল সার্ভিসের জন্য শুধু সিভিল ইঞ্জিনিয়াররাই আবেদন জানান, এই বার্তাও তাঁর মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছিল! মুখ্যমন্ত্রী একটি স্কুলে পরিদর্শনে গেলে উপস্থিত ছাত্ররা একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক চেয়েছিলেন। উত্তরে নিজের বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে বিপ্লববাবু নিদান দিলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অঙ্কের শিক্ষক জরুরি হলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের দরকার নেই। ভূগোল আর ইতিহাসের যোগ ফল হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, তাই যে কেউ বিষয়টা পড়িয়ে দিতে পারবেন। ভেবে দেখুন, কাকে সোনার ত্রিপুরা বানানোর ভার দিয়েছেন মোদিজি! বিপ্লবের বক্তব্যে শুধু দেশের মধ্যেই আলোড়ন ওঠেনি, শোরগোল পড়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, অমিত শাহ ও বিজেপির গোটা ভারতই দখল হয়ে গিয়েছে, এবার তাঁরা প্রতিবেশী নেপাল ও শ্রীলঙ্কা দখলের কৌশল চূড়ান্ত করছেন। কী ভয়ঙ্কর কথা! মানসিক ভারসাম্য আছে এমন কোনও মুখ্যমন্ত্রী এরকম বেফাঁস মন্তব্য করতে পারেন? ইতিমধ্যেই প্রতিবেশী দু’টি দেশের বিদেশ মন্ত্রকও এক অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর এমন আলটপকা মন্তব্যে ঘোর অসন্তুষ্ট। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। আর এখন বাংলার মানুষ অপেক্ষা করছেন গোরুর দুধ থেকে কবে সোনা তুলে গেরুয়া দর্শনের বৃত্ত সম্পূর্ণ করেন দিলীপ ঘোষ ও তাঁর সতীর্থরা, সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য। সোনার বাংলা গড়ার এমন বিভ্রান্তিকর আশ্বাসে আজ বাঙালির প্রাণবায়ুটাই বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়।
তাই এবারের একুশে ফেব্রুয়ারির পবিত্র ভাষা দিবসে বাঙালিকে শপথ নিতে হবে, যাতে বহিরাগত সংস্কৃতির আগ্রাসনকে যে কোনও মূল্যে রুখে দেওয়া যায়। সেই দিক দিয়ে এবারের ভাষা দিবসের তাৎপর্য অন্যবারের তুলনায় বেশি। কারণ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আজ এক ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জের মুখে। বাংলার ভোটে নেতা নেত্রীদের ভাষণ ষোলোআনা বাংলাতেই হবে, নাকি হিন্দি আট আনা ভাগ বসাবে, তারও নিষ্পত্তিও হবে এই নির্বাচনে। তাই প্রত্যেক বাঙালিরই বিরাট দায়িত্ব। দয়া করে বাংলাকে সাইনবোর্ড থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা বন্ধ করুন। এবারের ভোট নিছক একটা সরকার নির্বাচনের লড়াই নয়, বাংলা ও বাঙালির নিজস্বতা ও স্বাভিমানকে রক্ষা করার অগ্নিপরীক্ষা। ভোট দেওয়ার আগে এই কথাটা ভুলে গেলে সর্বনাশ!