কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
জোর করে ধর্ম অথবা সংস্কৃতি, কোনও বটিকাই খাওয়ার অভ্যাস নেই বাঙালির। সংস্কৃতি আর ধর্মবোধ দুটিতেই বাঙালি স্বচ্ছন্দ। প্রবলভাবে সংস্কৃতি প্রেমী। আবার ধর্মচর্চায় অগ্রগামী। শুধু গোঁড়ামি বাদে। ইদানীং বাংলার রাজনীতিতে যে উচ্চকিতভাবে ধর্মীয় পরিচয়কে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং সব ছাপিয়ে স্বধর্মই শ্রেষ্ঠ, এরকম আখ্যা দেওয়ার প্রবল প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, সেটা বাঙালির চিরন্তন মনোভাবটি না বোঝার কারণেই। বাঙালির মন জয় করতে হলে আগে এটা বুঝতে হবে যে, নিছক ধর্মের বিচারে বাঙালি কোনওদিনই নিজের আইডেন্টিটিকে প্রতিষ্ঠা করেনি। ধর্মের মাধ্যমে পরিচিতও হতে চায়নি। বাঙালির সংস্কৃতিতে মিশে গিয়েছে ধর্ম। ধর্মে মিশেছে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি ও ধর্মাচরণে বাঙালিকে নতুন করে ব্যাখ্যা শুনতে হবে কেন? সংস্কৃতি আর ধর্মচর্চায় বাঙালি নেতৃত্ব দিয়েছে। মনে রাখতে হবে হিন্দুধর্মের প্রচারে শ্রেষ্ঠতার উদাহরণ মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ—এই দুজন যুগপুরুষকে বাংলার মাটিই দান করেছে বিশ্বকে। ওই দুই আন্দোলন আজ বিশ্বের ধর্মচর্চার প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। আর সংস্কৃতি? নোবেল, অস্কার, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় গান...তালিকা দীর্ঘ!
এই প্রতিবেদনের শুরুতে যে পৃথকভাবে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হল, তার কারণ, তাঁদের মধ্যে একটি বিশেষ সাদৃশ্য আছে। রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, জীবনানন্দ দাশ এবং সত্যজিৎ রায়, এই পাঁচ মনীষী বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে রয়েছেন। সাদৃশ্যটি হল, এই পাঁচজনই ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান। কেউই হিন্দু নয়। কিন্তু সেই পরিচয়টি নিয়ে বাঙালির আদৌ কোনও মাথাব্যথা আছে? বিন্দুমাত্র নয়। এটাই বাঙালির বৈশিষ্ট্য। কারও সাহস আছে যে বলতে পারবে, এই পাঁচজন যেহেতু হিন্দু নয়, তাই তাঁদের ব্রাত্য করা হল? উগ্র ধর্মবোধ থেকে সেটা বলার তো যথেষ্ট কারণ ছিল। কারণ, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ, মূর্তিপূজার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু সেটায় বাঙালির কিছু যায় আসেনি। কারণ, এই দুই মনীষীই হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যকে উৎকর্ষের শীর্ষতম স্থানে বসিয়ে সম্মান দিয়েছেন তাঁদের রচনায়, সমাজ সংস্কারে এবং জীবনদর্শনে। হিন্দুত্বকে অস্বীকার করে ব্রাহ্ম হয়েছি। আবার হিন্দুধর্মকেই চরম সম্মান করি ঐতিহ্য ও উৎকর্ষের মাপকাঠিতে। এই বিস্ময়কর উদারতা আর কোনও জাতি দেখিয়েছে? বাঙালি নারীসমাজ যে দুই মনীষীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ, তাঁরা হলেন রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। প্রথমজন ব্রাহ্ম। দ্বিতীয়জন ধর্মাচরণর নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না। তাঁর কথা ছিল, সমাজ উদ্ধারে কাজ করা আগে দরকার।
বাঙালিকে রাজনীতির আঙিনায় অতীত গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার যে প্রবল ঢক্কানিনাদ শুরু হয়েছে, সেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতি উভয়কেই ভুল ডোজে মিশিয়ে একটি মাল্টিভিটামিন ক্যাপসুল খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে। ওভাবে শর্ট টার্ম সার্টিফিকেট কোর্সে বাঙালির ধর্ম ও সংস্কৃতি চেতনাকে বোঝা সম্ভব নয়। অনুশীলন চাই। বোধ চাই। বাঙালি মনীষীদের উপলব্ধি করা এতটা সহজ নয়। বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন না। মাইকেল মধুসূদন দত্ত খ্রিস্টান ছিলেন না। সৈয়দ মুজতবা আলি মুসলিম ছিলেন না। বিদ্যাসাগর হিন্দু ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন আধুনিক বাঙালির বাতিস্তম্ভ ও মাইলফলক। যে মাইলফলকে ধর্মপরিচয় গৌণ।
সহজ ফর্মুলায় অনেকেই তকমা দিচ্ছেন স্বামী বিবেকানন্দ একজন হিন্দু আইকন। অবশ্যই তাই। হিন্দুধর্মকে বিশ্বদরবারে নিয়ে যেতে তিনি প্রাণপাত করেছেন। কিন্তু এত বড় একজন মানুষকে ওভাবে আংশিক দেখলে তো কিছুই বোঝা যায় না। কারণ এই মানুষটি ১৮৯৪ সালে গুরুভ্রাতাদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘‘শশী, তোকে একটা নূতন মতলব দিচ্ছি। যদি কার্যে পরিণত করতে পারিস তবে জানব তোরা মরদ, আর কাজে আসবি। হরমোহন, ভবনাথ, কালীকৃষ্ণবাবু, তারক-দা প্রভৃতি সকলে মিলে একটা যুক্তি কর। গোটাকতক ক্যামেরা, কতকগুলো ম্যাপ, গ্লোব, কিছু কেমিকেলস ইত্যাদি চাই। তারপর একটা মস্ত কুঁড়ে চাই। তারপর কতকগুলো গরিব-গুরবো জুটিয়ে আনা চাই। তারপর তাদের অ্যাস্ট্রোনমি, জিওগ্রাফি প্রভৃতির ছবি দেখাও আর রামকৃষ্ণ পরমহংস উপদেশ কর—কোন দেশে কি হয়, কি হচ্ছে, এ দুনিয়াটা কি, তাদের যাতে চোখ খুলে, তাই চেষ্টা কর...পুঁথি পাতড়ার কর্ম নয়, মুখে মুখে শিক্ষা দাও। তারপর ধীরে ধীরে সেন্টার এক্সটেন্ড করো, পারো কি? নাকি শুধুই ঘণ্টা নাড়া?’’একজন হিন্দু সন্ন্যাসী এই যে সামাজিক কাজ না করে নিছক ঘণ্টা নাড়াকে উপহাস করছেন, এরকম উদারতা আর আত্মশক্তির চেতনাকে বুঝতে হবে তো! তাঁর কাছে শুধুই পূজার্চনার অধ্যাত্ম্যের তুলনায় মানবাত্মার সেবাই অগ্রাধিকার ছিল।
ভারতের পূর্বপ্রান্তের এই রাজ্যেই রেনেসাঁ এসেছিল ঊনবিংশ শতকে। রেনেসাঁ কথাটির মানে কী? শুধুই নবজাগরণ? না। অন্নদাশংকর রায় লিখেছেন, ‘‘রেনেসাঁর প্রথম লক্ষণ অন্তহীন জিজ্ঞাসা ও কৌতুহল। যা কিছু দেখবার আছে, দেখতে হবে। যা কিছু শেখবার আছে, শিখতে হবে...শাস্ত্র কিংবা সংঘ কিংবা গুরু কিংবা সাধু, কেউ অভ্রান্ত নন। মানুষ তাঁর স্বাধীন চিন্তা ও পরীক্ষার দ্বারা সত্য নির্ণয় করবে। হয়তো ভুল করবে, তবু পরের মুখের ঝাল খাবে না। তার জ্ঞানবুদ্ধির অন্ত নির্দেশ করা চলবে না। তার উপর বাধা নিষেধ খাটবে না।’ এই রেনেসাঁ যে বাঙালি জাতির ঐতিহ্য, তাকে হঠাৎ করে ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি নিয়ে লেকচার শুনতে হবে কেন রাজনীতির ময়দানে?
বিখ্যাত বিদেশি প্রকাশনী সংস্থা পেঙ্গুইন পাঁচের দশকে ঠিক করেছিল হিন্দুধর্মের উপর একটি ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশ করবে। সেই কাজটির জন্য বহু সন্ধান ও গবেষণার পর তারা বাছাই করল এমন একজনকে, যাঁর ইংরেজি জ্ঞান সীমিত। কিন্তু তাঁকে ছাড়া আর কাউকেই বলা যাবে না। বারাণসীর টোলের এক সংস্কৃত শাস্ত্রজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার ডাকলেও যিনি প্রথমে আসতে চাননি শান্তিনিকেতনে। পরে একপ্রকার বহু অনুরোধ উপরোধ করে তাঁকে শান্তিনিকেতনে আনা হয়েছিল। তিনি হলেন ক্ষিতিমোহন সেন। তাঁর সন্ধান পেল কীভাবে পেঙ্গুইন? অক্সফোর্ডে একসময় প্রাচ্য দর্শন ও নীতিবিদ্যা পড়াতেন যে অধ্যাপক, সেই সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ পেঙ্গুইনকে বলেছিলেন যে, এই কাজ ভারতে একমাত্র একজনই করতে পারেন। ক্ষিতিমোহন সেন। ক্ষিতিমোহন লিখলেন বাংলায়। তাঁর বইয়ের ইংরেজি তর্জমার দায়িত্ব দিলেন
নাতিকে। ক্ষিতিমোহন বারাণসীর এক সংস্কৃতজ্ঞ ও হিন্দু ধর্ম তথা ভারতীয়ত্ব বিশারদ। আর ষাটের দশকে তাঁর সেই হিন্দুধর্ম সংক্রান্ত বইটির অসামান্য ইংরেজি তর্জমা করলেন তাঁর নাস্তিক নাতি। যাঁর নাম অমর্ত্য সেন। সেই অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, যিনি ঘোষিত নাস্তিক, অথচ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ কিংবা ‘আইডিয়া অফ জাস্টিসে’ ঘুরে ফিরে এসেছে বৃহদারণ্যক উপনিষদের গার্গী ও যাজ্ঞবল্ক্যের অবিস্মরণীয় সেই কথোপকথন অথবা ভগবদগীতায় কৃষ্ণার্জুনের সংলাপের মাধ্যমে নীতিশাস্ত্র, রাজনীতি আর মূল্যবোধের উদ্ভাস।
এই বহুমুখী মননই কিন্তু বাঙালি মনীষার উত্তরাধিকার! একরৈখিক না। বহিরাগতদের কাছে এটা বোঝা একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে! ধর্মকে রাজনীতির মুখ করা হলে এই সূক্ষ্ম চৈতন্যগুলি স্পর্শ করা যায় না। থেকে যায় একঝাঁক মিসিং লিঙ্ক। কারণ, বাঙালি সংস্কৃতি ও ধর্মবোধের দীর্ঘকালীন অনুশীলন না করে নিছক করেসপন্ডেন্স কোর্স করে বাঙালির মন জয়ের পরীক্ষায় বসলে, দেখা যায় অনেক প্রশ্নই এসেছে সিলেবাসের বাইরে থেকে। বাঙালি জাতির ধর্ম ও সংস্কৃতির কোনও সাজেশন পেপার হয় না! ওটা দীর্ঘ ইতিহাসের এক অন্তহীন রচনাসমগ্র! তাই রাজনীতিতে কোনও জাতির আবেগকে ব্যবহার না করাই ভালো! ওটা অপব্যবহার হয়ে যাওয়ার চান্স থেকে যায়। বাঙালির ধর্ম ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ বাঙালি জাতিই স্থির করবে। মনীষীরা আছেন পথ দেখাতে। নতুন রাজনৈতিক অভিভাবকের প্রয়োজন নেই।