উচ্চতর বিদ্যায় সফলতা আসবে। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে মানসিক অস্থিরতা ... বিশদ
আহমেদনগর ফোর্টের জেলখানা। চার দেওয়ালের মধ্যে বসে তাঁর দেশকে এভাবেই কলমে ধরছেন জওহরলাল নেহরু। লিখছেন হরপ্পার কথা, উপনিষদ, মহাভারত, মন্বন্তর, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা...। ততদিনে কংগ্রেসের অধিবেশনে পাশ হয়ে গিয়েছে প্রস্তাব—পূর্ণ স্বরাজ চাই। ‘ডোমিনিয়ন স্টেটাস’ চলবে না। নামমাত্র ক্ষমতা, আর মাথার উপর ছড়ি ঘোরাবে ব্রিটিশরা? হতে পারে না। ১৯২৯ সাল। লাহোরের মাটিতে দাঁড়িয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কংগ্রেসের সেই অধিবেশনের সভাপতি তাঁকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন। আবেদন নিবেদনের থালা হাতে ইংরেজ শাসকের সামনে ভিখিরির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে চাননি সুভাষ। ১৯২৯ সাল... অধিবেশনের সভাপতি রাভী নদীর তিরে উড়িয়ে দিলেন পতাকা। পাশে দাঁড়ালেন সুভাষ। ঠিক হল, ২৬ জানুয়ারি দিনটি দেশ পালন করবে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে। লাহোর অধিবেশনের সভাপতির নাম? জওহরলাল নেহরু।
সুভাষচন্দ্র শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে স্বাধীনতা চাননি... স্বাধীন হতে চেয়েছেন ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে, অশিক্ষা থেকে, কুসংস্কার থেকে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য—এটাই ভারতের চিরন্তন পরিচিতি। বহু ধর্ম, বহু জাতি, বহু রাজনৈতিক দর্শন মিলেমিশেই যে ভারত! কিন্তু সেই নেতাজিরই ১২৫তম জন্মবার্ষিকী হয়ে গেল রাজনীতির নামে নোংরা মেরুকরণের মঞ্চ। অপমানিত হলেন বাংলার একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারি মঞ্চে ভাষণ দিতে উঠছেন মানে তিনি তখন ভারত সরকারের সম্মানীয় অতিথি। কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নন। কাজেই রাজনীতির মোড়কে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোটা আর যাই হোক, প্রধানমন্ত্রীর শোভা পায় না। শোভা পায় না তাঁকে বা তাঁর দলকে যাঁরা সমর্থন করে চেয়ার ভরিয়েছিলেন, তাঁদেরও। ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’য় হিন্দুধর্ম সম্পর্কে, হিন্দুত্ব সম্পর্কে নেহরু যা লিখেছিলেন, তা তাঁর আবিষ্কার ছিল না। ভারতের ইতিহাসের পাতায়, প্রাচীন সভ্যতার প্রত্যেকটা ইট-পাথরে তা ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু বিজেপি সরকারের অনুষ্ঠান কী দেখাল? ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখার তোড়জোড় চলছে। এখানে সর্বধর্মের কথা বললে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। হঠাৎ একদিন সকালে হয়তো দেখা যাবে, মত প্রকাশের বা ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের মৌলিক অধিকারকেই বিজেপি সরকার সংবিধান থেকে বাদ দিতে চেয়ে সংশোধনী এনেছে! তেমন দিন এলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এই সবকিছু ছাপিয়ে অবশ্য ভাবনার গোড়ায় ইন্ধন দিচ্ছে অন্য প্রশ্ন... প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান এবং তার ভিআইপি এনক্লোজারে কি হেঁজিপেজি লোকজন বসতে পারে? তার মানে কি নিরাপত্তায় ফাঁক? যে যেমন পেরেছে ঢুকে পড়েছে? তাহলে আয়োজকদের অবশ্যই শো-কজ করা উচিত! তেমন যদি না হয়? অর্থাৎ, চেঁচামেচি বা স্লোগান দেওয়া লোকজন যদি সত্যিই কেন্দ্রীয় সরকারের আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন? তাহলে কিন্তু বিজেপির এখনই সতর্ক হওয়া উচিত। আগামী দিনে বঙ্গ বিজেপিকে কোন ধরনের সদস্য সমৃদ্ধ করবে, তা ২৩ জানুয়ারি দেখিয়ে দিল। আর এই যদি ভিআইপি সমর্থকদের নমুনা হয়, তাহলে ছাঁকনির বাইরে থাকা কর্মী-সমর্থকরা বাংলার প্রতি কেমন ভাবধারা পোষণ করবেন, তা বোঝাই যাচ্ছে। তাঁরা বুঝতেই পারলেন না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অপমান নয়, এই আচরণ আসলে বেইজ্জত করল বাংলাকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু এক্ষেত্রে পরিণত রাজনীতিবিদের মতোই কাজ করলেন। খুব থেমে থেমে খান চারেক কথা বললেন... সৌজন্য পুরোদস্তুর বজায় রেখে। মঞ্চ ছেড়ে নেমে যেতে পারতেন তিনি, কিন্তু তা করেননি। জানতেন, এমনটা করলে বাংলার মাটির অসম্মান হবে।
বিজেপি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্মনিরপেক্ষ। প্রত্যেক ভারতবাসীর ভাবনা, মতামতের সম্মান করাটা সাংবিধানিক কর্তব্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জায়গায় অন্য যে কোনও রাজনীতিকই নিশ্চয় প্রতিবাদ করতেন। তৃণমূল নেত্রী তাঁর নিজের ঢঙে করেছেন, অন্যেরা তাঁদের মতো করতেন। ঠিক যেমন করেছিলেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন। প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদিরই অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। বিজয়ন উঠেছিলেন বক্তৃতা দিতে। আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল চিৎকার, জয় শ্রীরাম স্লোগান। একটি করে শব্দ তিনি উচ্চারণ করছেন, আর সঙ্গে সঙ্গে কান ভেদ করছে উপস্থিত জনতার একটা অংশের গলাবাজি। বিজয়ন বাধ্য হয়ে বললেন, ‘মনে হচ্ছে কিছু লোক এখানে শুধু চিৎকার করতে আর স্লোগান দিতেই এসেছে’। তারপরও পরিস্থিতি বদলাল না। মুখ্যমন্ত্রী তখন বললেন, ‘একটা সুন্দর অনুষ্ঠানের মঞ্চকে যেমন খুশি ব্যবহার করবেন না। এমন অনুষ্ঠানে কিছু তো শৃঙ্খলা থাকবে!’ বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে যেন সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। মোদির অনুষ্ঠান... জনতার ‘একাংশ’ এবং বিরোধী নেতা বা নেত্রীকে বাধা দেওয়া। পুরো ব্যাপারটাই পরিকল্পিত নয় তো?
আশা করা যাক, এমন কিছু হয়নি। তাহলে বিজেপিরই মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য ঘটনাটিকে কেন অনুচিত বলে বিবৃতি দিলেন? বিবেকবোধ? কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠও যে আছে। তির হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে! তাই তাকে সমর্থন করেও কোনও কোনও নেতা বিবৃতি দিচ্ছেন। তা দিতেই পারেন। আপত্তি নেই। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হল, বাংলার মানুষ এসব ভালোভাবে নিচ্ছে তো? রাস্তাঘাটের চর্চা কিন্তু বিজেপির জন্য খুব ভালো বার্তা নিয়ে আসছে না! রাজনৈতিক পছন্দ যাই হোক না কেন, সাধারণ ভোটারকুল একে বাংলার অপমান হিসেবেই ধরছে। কংগ্রেস এবং সিপিএম বাংলার এই পালসটা বুঝেছে। তাই তাদের প্রতিক্রিয়াও মমতামুখী। কোনও রাজনৈতিক দলের একটা নির্দিষ্ট নীতি, আদর্শ, ভাবনা থাকতেই পারে। কিন্তু তা অন্যের উপর চাপানো যায় না। সেই অধিকার সংবিধান আমাদের দেয়নি। ম্যাঙ্গালোরে একটি ছাত্রসভায় বক্তব্য রাখছিলেন কানহাইয়া কুমার। ছাত্রছাত্রীদের নানাবিধ রাজনৈতিক প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন তিনি। তখনই এক ছাত্রী উঠে তাঁকে বললেন, ‘জয় শ্রীরাম’। প্রশ্ন করলেন, ‘রাষ্ট্র যদি এক হয়, তাহলে এক রাজনৈতিক মতাদর্শ হবে না কেন?’ কানহাইয়ার জবাব ছিল, ‘ভারত তো একই! ওয়ান নেশন। আমাদের সংবিধান দেশকে এক করেছে। কিন্তু তাতেও তিনশোর বেশি ধারা রয়েছে। ভারতের ভিত ধরে রেখেছে সংসদ। আর সংসদেও কিন্তু দু’টো কক্ষ—লোকসভা, রাজ্যসভা। লোকসভাতেও আমরা কোনও একজনকে নির্বাচিত করে পাঠাই না! সেখানে নির্বাচিত করা হয় ৫৪৫ জনকে। আমাদের ঐক্য আসে বৈচিত্র্য থেকেই। আমি মিথিলাবাসী। সেখানে প্রতি বছর অযোধ্যা থেকে বরযাত্রী আসে। কারণ, মিথিলা রামচন্দ্রের শ্বশুরবাড়ি। সেখানে আমরা জয় শ্রীরাম বলি না... বলা হয় সীতারাম। একসঙ্গে।’ এটাই যে ভারতের চরিত্র। ভাবনা আলাদা, মত আলাদা, আচার আলাদা...। এই সবের সমন্বয়েই ঐক্য। রাজনৈতিক মত পৃথক হতেই পারে। কিন্তু তা নিয়ে জবরদস্তি চালানোটা অপরাধ। জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে কারও কপিরাইট নেই। থাকবেও না। কোনও রাজনৈতিক দল যদি তেমনটা মনে করে, তাহলে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। তাহলে এই স্লোগান শুনলেই কেন বিজেপির কথা মনে পড়ে? কারণ, এই একটা বিষয়ে গেরুয়া শিবির সফল—ধর্মীয় মেরুকরণ। সেই অস্ত্রেই তারা ঘায়েল করতে চেয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পরিকল্পিতভাবে। কিন্তু বিজেপি ভুলে গিয়েছে... মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রাসন পিনারাই বিজয়ন বা কানহাইয়া কুমারের সঙ্গে তুল্যমূল্য নয়। ভরা হাটে, গোটা দেশের সামনে অসম্মান করা হয়েছে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে। এটাই কিন্তু হবে আসন্ন ভোটে তৃণমূলের ব্রহ্মাস্ত্র। পাশাখেলায় দ্রৌপদীর অসম্মান থেকে জন্ম নিয়েছিল ১৮ দিনের এক ধর্মযুদ্ধ। ১১ অক্ষৌহিনী সেনাও বাঁচাতে পারেনি কৌরবদের। এবার কুরুক্ষেত্র বাংলার মাটি। আর এখানে পাঁচ পাণ্ডবের একটাই নাম—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে জয় তাদেরই হবে, শ্রীকৃষ্ণ থাকবেন যে পক্ষে। আর ভোটে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় কে? বাংলার মানুষ...।