উচ্চতর বিদ্যায় সফলতা আসবে। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে মানসিক অস্থিরতা ... বিশদ
নির্বাচনের সময় দল ভাঙাভাঙির হাটে নেতানেত্রীদের দর বাড়ে। জনগণের দুর্দশা আর সম্মান নিয়ে কাজ করতে না পারার যন্ত্রণায় মন্ত্রী-সান্ত্রীদের চোখের জল একটু যেন বেশি ঘন হয়ে পড়ে।
এক নিঃশ্বাসে বলে যান, না, কাজ করার পরিবেশ নেই। শত্রু, মিত্র সবাই সবাইকে ‘চোর চোর’ বলে গাল পাড়েন। এতদিন ধরে যে থালায় একসঙ্গে বসে ভাত খাওয়া তাকেই অস্বীকার করে বেমালুম অন্য দাঁড়ে বসে কা কা করেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষা মেটানোর তাড়নায় ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র কী বিরাট আয়োজন। একজন নেতা, যাঁকে লোকে গদ্দার বলেই চেনে প্রকাশ্যে বলছে ভোট সামনে বলেই ঠিক এই সময়টাকে দল ভেঙে বেরনোর জন্য বেছে নিয়েছি! ভাবটা এমন যেন নির্বাচন আরও এক বছর দূরে হলে আরও ১২ মাস মুখ বুঝেই এই মন্ত্রিসভার সদস্য থাকতেন। সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন। তারপর বলতেন, কাজ করার পরিবেশ নেই। কিন্তু সেই সময় আর নেই বলেই এখন আখের গোছাতে দ্রুত দল ছাড়ার লাইন। মানুষ ঠিকই বুঝছে, যে এঁদের সবটাই নাটক। এঁরা সব ছদ্ম দেশপ্রেমিক! তার বেশি কিছু নয়! সাতচল্লিশের আগে চোখের জল মুছতে মুছতে ভণ্ডামির কোনও জায়গা ছিল?
দল ছাড়ার এই উৎসবের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে মনীষীদের জন্মদিন পালনের হিড়িক। এরই মধ্যে ২৩ জানুয়ারি, সাধারণতন্ত্র দিবস কিংবা ১৫ আগস্ট পেলে তো কথাই নেই! আঁকড়ে ধরো। ভোটের মুখে পাঁচরাস্তার মোড়ে মনীষীদের প্রতিকৃতিতে পরানো গলার মালাটা অন্যবারের তুলনায় একটু মোটা হয়। ধূপের গন্ধটা একটু দূর পর্যন্ত ছড়ায়। অজানা মন্ত্রে সেই মালা থেকে ফুলও ঝরে সামান্য দেরিতে। আগে যেখানে গড়ে এক একজন শ্রদ্ধা জানাতে দশ মিনিটের ভাষণ দিতেন, এবার তা আধঘণ্টা পর্যন্ত গড়ায়। মালা দিতে যে দল কোনওদিন আসত না, মালা দিত না, স্মৃতিরোমন্থন করত না, তারাও শ্রদ্ধা দেখানোর এমন মধুর সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায় না। ফুলওয়ালি মাসির একটু বাড়তি রোজগার। যেন যত শ্রদ্ধা তত ভোট! তাই চার-দিকেই সাজো সাজো রব। আগে যেখানে শহরে হাফ ডজন মিছিল, প্রভাতফেরি বেরত, ভোট এলে
কেমন তা বেড়ে তিন ডজন হয়ে যায়। তাও দেখা গেল এবার। এই অদ্ভুত রসায়নের গূঢ় অর্থটা বোঝে কার সাধ্য! এ পর্যন্তও সব ঠিক আছে। কিন্তু একটা চরম সাম্প্রদায়িক, বিভেদ সৃষ্টিকারী দলও যখন ভোটের জন্য নেতাজির জন্মদিনে মাতে তখন ভ্রু আপনা হতেই কুঁচকে যায়। কারণ নেতাজি আদ্যন্তই ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। তাঁর দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রধান শর্তই ছিল, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের আফিমকে মেশানো যাবে না। সেই সাধনাকে সামনে রেখেই ধর্মকে অস্ত্র করে সামাজিক বিভেদ ও বিভাজনের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করে গিয়েছেন তিনি। তাঁর হাতে গড়া আইএনএ’তেও তিনি ধর্মকে অস্ত্র করতে দেননি কখনও। সেখানেও আগাগোড়া সামনে ছিল সর্ব ধর্ম সমন্বয়েরই আদর্শ। বহু মত ও পথের মানুষ মিলেছিল সেখানে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী যে কোনও বাঙালির কাছেই অত্যন্ত গৌরবের মুহূর্ত। একইসঙ্গে বাঙালি সাজার পক্ষেও এই দিনটার কোনও বিকল্প নেই। বাঙালিকে স্বাধীন চিন্তা ও চেতনায় আত্মনির্ভর করার প্রধান তিন কাণ্ডারীর নাম রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ ও নেতাজি। তাই গেরুয়া শিবির রাজনৈতিকভাবে ঠিকই করেছে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আরএসএসের শ্রেষ্ঠ ছাত্র প্রধানমন্ত্রীর কলকাতায় আগমন। শনিবারের বারবেলায় গোটা দিনটা ‘বাঙ্গালে’ কাটানো।
নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা। এমন নজির আর আছে নাকি! নেই, এবারই প্রথম। কারণটা কী? ১২৫তম জন্মদিনে শুধুই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন? নাকি সেই মহামানবের আদর্শকে আত্তীকরণের মধ্যে দিয়ে বাংলাকে আর একটু আপন করে ভোটে ফায়দা তোলা?
আসল বালাই কোনটা, বোঝা দায়। সল্টলেকের এক নেতা তো আবার কাছেপিঠের সব মূর্তি সাবান দিয়ে পরিষ্কার করতে মেতেছেন। ভোটের মাঠে ওটাই ‘শিওর সাকসেসে’র প্রকৃষ্ট পথ। তবু এতকিছুর পরও ‘দেশপ্রেম দিবস’ হিসেবে ২৩ জানুয়ারিকে মর্যাদা দেওয়ার দাবিটা মানা হল না কেন? ‘পরাক্রম দিবস’ ঘোষণা করেই থামতে হল কোন যুক্তিতে? পরাক্রম শব্দটা ঠিক বাঙালির বিক্রম ও দেশের মাটির জন্য ত্যাগের সঙ্গে যায় না। শব্দটার মধ্যে কেমন যেন মহারাষ্ট্র-গুজরাতের অচেনা গন্ধ মেশানো আছে। পরাক্রমতার ব্যাপ্তি অনেক ছোট। আঞ্চলিকতার ছোঁয়াও তাতে স্পষ্ট। পরাক্রমতার সঙ্গে অনন্ত দেশপ্রেম আর তার বিশ্বজোড়া ব্যাপ্তি মিশলে তবেই নেতাজির নাগাল পাওয়া যায়। এই সার সত্যটা বুঝতেই পারলেন না অমিত শাহরা। বাংলার মনন ও সংস্কৃতির আসল সুরটাকে ধরতে না পারার সমস্যাটা এখানেই। দেশপ্রেম দিবস কিংবা দেশনায়ক দিবসই নেতাজিকে সম্মান জানানোর পক্ষে যথার্থ। ছত্রপতি শিবাজির মাপকাঠিতে নেতাজির মূল্যায়ন করতে গেলে গোল বাধবেই। ওরা বাংলাকে জানে না। বাংলার কৃষ্টি জানে না। নেতাজির মতো দেশের জন্য সর্বস্ব পণ করে জীবন বাজি রাখার উদাহরণ আর কোথায় আছে ভূ-ভারতে? তবু তাঁর জন্মদিনে জাতীয় ছুটি ঘোষণার সামান্য আবেদনও স্বীকৃতি পেল না। তাঁর অন্তর্ধানের যাবতীয় গোপন ফাইল প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েও আজও তা ষোলো আনা রক্ষা করা হয়নি। উন্মোচিত হয়নি ১৯৪৫
সালের তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনার আসল রহস্য। এবং, সেই সঙ্গে বাঙালির গভীর বিশ্বাস, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মহান দেশনেতাদের শেষ বলে কিছু হয় না। তিনি আজও জীবন্ত। এই বাংলাতেই কোথাও আছেন। তাঁদের অনির্বাণ জীবনদীপ জ্বলতেই থাকে। মানুষকে যুগ যুগ ধরে পথ দেখায়। নেতা আসে নেতা যায়, সরকার গড়ে, পড়ে; কিন্তু নেতাজিরা মানুষের মনে অক্ষয় হয়েই থাকেন।
কিন্তু আদি হিন্দু মহাসভার ধারক ও বাহকরা আজ হঠাৎ নেতাজি পুজোয় মাতলেন কেন? একদা এঁরাই স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। প্রগতিশীল বামপন্থীরা আঘাত হেনে বলেছিলেন, তোজোর কুকুর। সঙ্ঘ পরিবারের মার্গদর্শক গোলওয়ালকর ও সাভারকররা কোনওদিন স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজির পাশে দাঁড়াননি।
উল্টে বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করার ফতোয়া দিয়েছিলেন। আন্দোলন দমন করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তথাকথিত ‘বীর’ সাভারকর স্বাধীনতার ৩৪ বছর আগে ব্রিটিশ শাসকদের মুচলেকা দিয়ে আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এঁরাই হিন্দুদের আহ্বান করেছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের সমর্থন করতে। আজ সাভারকর ও গোলওয়ালকরের উত্তরসূরিরা যখন নেতাজির ‘পরাক্রমতার’ সামনে মাথা নত করেন, তখন সন্দেহ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। ‘বাঙ্গাল’ দখলের জন্য এটাও নিতান্তই একটা চাল নয় তো, বড় বিস্ময় লাগে। তাই সতর্ক হওয়া ছাড়া কীই-বা করার আছে?
যে পাঁচ রাজ্যে ভোট আসন্ন, তার কোনওটাই সেই অর্থে বিজেপির রাজ্য বলে পরিচিত নয়। তামিলনাড়ু ও কেরলে এবারও গেরুয়া পতাকার তেমন কোনও সম্ভাবনাই নেই। পুদুচেরির ফল নিয়ে কারও তেমন মাথাব্যথাও নেই। পড়ে রইল অসম ও পশ্চিমবঙ্গ। অসমে এই মুহূর্তে বিজেপির সরকার ক্ষমতায়। আর পশ্চিমবঙ্গে দল এগচ্ছে। তাই বাংলা সহ পূর্বভারতের আবেগকে ধরতেই মোদি ও অমিত শাহদের বাঙালিয়ানায় জোর। বাঙালি নেশায় বুঁদ হওয়া। বাঙালি কবিদের উদ্ধৃতি দেওয়া বেড়েছে। তা করতে গিয়েই হোঁচটও খেতে হচ্ছে। দলের সর্বভারতীয় সভাপতির মুখে কখনও বিশ্বকবির ভুল জন্মস্থানের আখ্যান। কলকাতার বুকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মূর্তি ভাঙা। ভেঙে ভেঙে ভুল উচ্চারণে বাংলা বলার প্রাণান্তকর চেষ্টা। মহামারীর মধ্যেও বাংলার দুর্গাপুজোর ভার্চুয়াল উদ্বোধন ...। এসব কীসের ইঙ্গিত—ভক্তির? ভালোবাসার? না, তাগিদটা দখলদারির। ছদ্ম বাঙালি সেজে ‘বাঙ্গাল’ দখলের এমন বর্ণাঢ্য প্রস্তুতি আগে কেউ দেখেছে ভূ-ভারতে! এই ২৩ জানুয়ারি দখলদারির নেশায় মত্ত একটা অবাঙালি প্রধান রাজনৈতিক দলের বঙ্গীয় হয়ে ওঠার অক্ষম ড্রেস রিহার্সালও দেখল। এসবই সোনার বাংলা গড়তে? নাকি জনভিত্তির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে এটাকেও আর পাঁচটা অবাঙালি প্রধান প্রদেশের মতো নিরামিষাশী বিজেপি রাজ্যে পরিণত করতে! গন্ধটা কিন্তু ভীষণ সন্দেহজনক! পরিশেষে বলি, বাঙালি জাতির দুই শ্রেষ্ঠ সন্তান, স্বামী বিবেকানন্দ ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র। প্রথম জনকে আমরা পেয়েছি মাত্র ৩৯ বছরের জন্য। আর দ্বিতীয় জন দেশের জন্য অন্তর্ধানে গিয়েছেন ৪৮ বছর বয়সে। দু’জনেই আরও ৪০ বছর বাংলার মাটিতে থাকলে বর্গীদের খেলা শেষ হয়ে যেত। বহিরাগত বুলবুলিরা ধান খেতে আসার কোনও সুযোগই পেত না। তাই বলতেই হয়, আমরা বড় দুর্ভাগা। কাঞ্চন ছেড়ে কাচ নিয়ে পড়ে আছি!