১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি ইংরেজ পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন সুভাষচন্দ্র। পরদিন গোমো থেকে ফ্রন্টিয়ার মেলে চড়ে পৌঁছে গেলেন পেশোয়ার। সম্পূর্ণ একা। ওখানে দেখা হল আবিদ হাসান ও অন্যান্যদের সঙ্গে এবং অবশ্যই ভগৎরাম তলোয়ারের সঙ্গে। পরদিনই শুরু হল তীর্থযাত্রা। প্রবল ঠান্ডায় একটি মসজিদে ও পথে এক গ্রামবাসীর গৃহে দুটি রাত কাটিয়ে তাঁরা পৌঁছলেন আফগান সীমানা পেরিয়ে পিচ রাস্তায়। বহু কষ্টে চায়ের পেটি বোঝাই খোলা ট্রাকের ওপর বসে এবং শেষপর্বে টাঙায় চেপে পৌঁছে গেলেন কাবুল। তখন রেডিও মারফত ওখানেই শুনলেন যে ‘সুভাষচন্দ্র বোস তাঁর এলগিন রোডের বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছেন।’ যে কোনও মুহূর্তে ধরা পড়তে পারেন এমন অবস্থায় কিছুদিন ঘোরাঘুরির পর শেষ পর্যন্ত ইতালীয় দূতাবাসের সাহায্যে ‘অল্যান্তে মাৎসোতা’ ছদ্মনামে তৈরি হল পাসপোর্ট ও রাশিয়ার মধ্যে দিয়ে সুভাষ পৌঁছলেন জার্মানি। সেখানে তখন প্রচুর ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুদ্ধবন্দি। সেনাবাহিনীর ভারতীয় সৈনিকদের ভুলিয়ে ভালিয়ে ইংরেজ সরকার আফ্রিকান ফ্রন্টে যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। তাদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য জার্মান ও ইতালীয় বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। সুভাষচন্দ্র এই বন্দি শিবিরগুলো ঘুরতে লাগলেন ও গাছতলায় দাঁড়িয়ে খালি গলায় ভাষণ দিতে লাগলেন। প্রথমে মাত্র ১০-১২ জন স্বেচ্ছায় সুভাষবাহিনী বা ‘ইন্ডিয়ন লিজিয়ন’-এ যোগ দিলেন। খুব অল্প দিনের মধ্যে তৈরি হল একটি গোটা ব্যাটেলিয়ন। ১৯৪১ সালের ২ অক্টোবর সৈনিকরা প্রথম মার্চপাস্টে অংশ নিলেন ও সুভাষচন্দ্র তাঁদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘জন গণ মন’ গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হল। এবার সুভাষচন্দ্র দিলেন সেই মহামন্ত্র। এখন থেকে ধর্ম যার যার অন্তরে, বাইরে তাঁদের পরিচয় শুধুমাত্র ভারতীয়। পারস্পরিক নমস্কারের সময় উচ্চারিত হয় ‘জয়হিন্দ’ মহামন্ত্র। ১৯৪২ এর ২৮ ফেব্রুয়ারি সৈনিকরা মিলিতভাবে সুভাষচন্দ্রকে ‘নেতাজি’ উপাধি প্রদান করলেন। জার্মানিতে থাকাকালীনই নেতাজি উপলব্ধি করলেন যে, এত দূর থেকে ভারতে সামরিক অভিযান সম্ভব নয়। তাঁকে যেতে হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের বাজারে তিনি যাবেন কীভাবে! ইতালির রাষ্ট্রপ্রধান মুসোলিনি তাঁকে একটি বিমান দিতে চাইলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন জার্মান প্রশাসক। তাঁর কথায়— এই সময় বিমানযাত্রা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। শেষে ঠিক হল সমুদ্রের তলা দিয়ে অত্যন্ত গোপনে হবে আপাত অসম্ভব এই যাত্রা। এই যাত্রার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করতে লেগে গেল বহু সময়। ফলে কোণঠাসা ইংরেজরাও কিছুটা বাড়তি সময় পেয়ে গেল। ১৯৪৩ এর ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হল সেই চার মাসের সমুদ্রের তলা দিয়ে তাঁর এক অসম্ভব অভিযান, পৃথিবীর ইতিহাসে এর সমতুল্য কোনও নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
মালয় বন্দরে পৌঁছে দু’-একদিন বিশ্রাম নিয়ে বিমানে টোকিও পৌঁছলেন ১৩ জুন, ১৯৪৩। সেখানে তখন অধীর আগ্রহে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু।
এরপর রাসবিহারী সিঙ্গাপুরের এক বিশাল সভায় নেতাজির হাতে তুলে দিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভার। নেতাজি তখন মানুষের চোখে রূপকথার নায়ক, জীবন্ত কিংবদন্তি। জাপান ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কিন্তু চুক্তি করতে হলে তা করতে হবে দুটি সরকারের মধ্যে। সাবমেরিনে আসার সময়েই এই স্বাধীন ভারত সরকার গঠনের কথা ভেবে রেখেছিলেন নেতাজি। এবার এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের ক্যাথে সিনেমাহলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র অন্তবর্তীকালীন স্বাধীন ভারত সরকার (আজাদ হিন্দ সরকার) গঠনের কথা ঘোষণা করলেন ও প্রথম নিজে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপ্রধান রূপে শপথ নিলেন। গঠিত হল ২১ জনের পূর্ণ মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষের হাতে রইল পররাষ্ট্র ও যুদ্ধ বিষয়ক দপ্তর। সেদিনই মন্ত্রিসভার প্রথম পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে ব্রিটিশ ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হল।
১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতভূমির ১৫০ কিলোমিটার ভিতরে প্রবেশ করে মণিপুরের মৈরাঙ্গ শহরতলি দখল করে এবং মেঃ জেঃ এ সি চট্টোপাধ্যায়কে প্রশাসক নিয়োগ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষ। এরও আগে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ চলে এসেছিল এই অন্তর্বর্তীকালীন ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে। প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষ নিজে উপস্থিত হয়ে ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা প্রথম বারের জন্য উত্তোলন করলেন ৩০ ডিসেম্বর ১৯৪৪। তখন আজাদ হিন্দ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রইল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, নেতাজি এর নাম পরিবর্তন করে রাখলেন ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ’ দ্বীপ।
জাপানের সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় রইল না। ১৫ আগস্ট, ১৯৪৫ জাপান আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করল।