দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
নির্বাচনের আগে দলের কর্মীদের চাঙ্গা করা নেতাদের লক্ষ্য। ভোটারদের সঙ্গে জনসংযোগের কাজটা কর্মীরাই করেন। তাই ক্ষমতা দখলের ক্ষীণতম সম্ভাবনা না থাকলেও নেতারা হম্বি তম্বি চালিয়ে যান। তাঁরা জানেন, নির্বাচনী লড়াইয়ের আসল কারিগর দলের কর্মীরা। সেই কর্মীরা মনোবল হারালে জেতা তো দূরের কথা, নির্বাচন লড়াটাও কঠিন হয়ে যায়। তাই নেতারা যে কোনও মূল্যে কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে চান। তাঁরা যে ক্ষমতা দখলের দোরগোড়ায়, সেটা প্রমাণের মরিয়া চেষ্টা চালান। সেই উদ্দেশ্যেই অমিত শাহ ২০০ আসনের দাবি করে বসেছেন। এটা রাজনীতির কৌশল।
বিজেপির সেই কৌশলের আর এক অঙ্গ ছিল ৩৫৬ ধারা জারির দাবি। এরাজ্যের আইনশৃঙ্খলার কথা বলে বিজেপি নেতারা জরুরি অবস্থা জারির ধুয়ো তুলে দিল্লি ছুটেছিলেন। শুধু নেতারাই নন, আমাদের মহামহিমও নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এরাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর খারাপ। এমনকী, ৩৫৬ ধারা জারির মতো অবস্থাও তৈরি হয়েছে বলে তিনি হুমকি দিয়েছিলেন। তবে ইন্ধনটা এসেছিল অনেক আগেই, স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে তিনি দাবি করেছিলেন, ৬০ জন তৃণমূল বিধায়ক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সরকার পড়ে যাবে। কিন্তু তারপর বছর ঘুরেছে, বিজেপি ২৫ জন বিধায়ককেও ভাঙাতে পারেনি। বোঝা যাচ্ছে, সেটাও ছিল দলের কর্মীদের তাতানোর কৌশল।
আর তাতে হাওয়া দিয়ে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রাজ্যে এসে বারবার তিনি আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতাদের ৩৫৬ ধারা জারির দাবি ন্যায়সঙ্গত’। তাই বিজেপির বঙ্গ ব্রিগেডের লম্ফ ঝম্ফ বেড়ে গিয়েছিল। তৃণমূল ভেঙে বেরিয়ে আসা বিধায়কদের লম্বা তালিকাও তাঁরা তৈরি করে ফেলেছিলেন। নেতাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এই ভাঙল বলে!
আগেই লিখেছি, ‘কর্মীদের চাঙ্গা করতেই ৩৫৬ ধারার ফাঁদ’। সেখানে বলেছিলাম, ‘এরাজ্যে কিছুতেই ৩৫৬ ধারা জারি হবে না। কারণ সেই পরিস্থিতি নেই। এটা ছিল বিজেপি কর্মীদের চাঙ্গা রাখার একটা কৌশল। বিধানসভার ভোট করাতে দিল্লি থেকে পুলিস আসবে বলে দিলীপ ঘোষ কর্মীদের আশ্বস্ত করছেন। তাতে কর্মীরা চাঙ্গা হচ্ছেন। কিন্তু তা সাময়িক। শেষ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নেতৃত্বে ভোট হলে বিজেপি কর্মীরা হতাশ হবেন।’
এখন সকলেই বুঝতে পারছেন, বিজেপি নেতাদের এরাজ্যে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার অভিযোগ ছিল সবৈব মিথ্যা। তাঁরাও জানতেন, একটা মণীশ শুক্লা খুন বা একজন বিধায়কের রহস্যজনক মৃত্যুর জন্য রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি করা যায় না। আর সেটা হলে উত্তরপ্রদেশে অনেক আগেই সরকার পড়ে যেত। তবুও বিজেপি নেতারা বলেছিলেন। কারণ মমতার সরকারের বিরুদ্ধে কর্মীদের চাঙ্গা করার ইস্যু পাচ্ছিলেন না। জনমত সমীক্ষার রিপোর্ট ভোটের ফলের সঙ্গে মিলতে পারে, আবার নাও পারে। তাই সাম্প্রতিক প্রকাশিত জনমত সমীক্ষার রিপোর্ট কতটা মিলবে, সেটা সময় বলবে। তবে এই ধরনের সমীক্ষা রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ভীষণ প্রভাবিত করে। অনেকটা টনিকের কাজ করে। রিপোর্ট অনুকূলে গেলে কর্মীদের মনোবল বেড়ে যায়। আর উল্টোদিকের কর্মীরা ঝিমিয়ে পড়েন। তাই নেতারা মুখে যাই বলুন না কেন, তাঁরাও সমীক্ষার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
তবে সিপিএম যতদিন এরাজ্যের ক্ষমতায় ছিল, ততদিন জনমত সমীক্ষাকে গুরুত্ব দেয়নি। কারণ সাংগঠনিক দৃঢ়তা। সিপিএম রোড-শো, মিডিয়া হাইপের চেয়েও বুথ ভিত্তিক সংগঠনের দিকেই বেশি নজর দিত। সমীক্ষায় কোনও ফাঁকফোকর উঠে এলে সাংগঠনিক ক্ষমতার জোরে মেরামত করত। সিপিএম সেটা করতে পারলেও বিজেপির পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। কারণ এরাজ্যে বিজেপির সংগঠন বলে কিছু নেই। তাদের বাড়বাড়ন্ত সম্পূর্ণ হাওয়া নির্ভর। সাফল্য, ব্যর্থতা অনেকটাই নির্ভর করে মিডিয়ার হাইপের উপর। সেই কারণেই জনমত সমীক্ষার রিপোর্টে গেরুয়া শিবিরে নেমেছে হতাশার ছায়া। তবে নেতারা তা ঢাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে ‘টনিক’ দিচ্ছেন। কিন্তু, তাতে কতটা কাজ হবে বলা কঠিন। কারণ তাঁরাও অঙ্ক কষেন। সেই কারণে কখনও ‘দলবদলু’ আবার কখনও ‘ঘর ওয়াপসি’।
এতদিন যাঁরা দিলীপ ঘোষের ‘বদল হবে, বদলাও হবে’ মার্কা ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে ময়দান কাঁপাচ্ছিলেন, তাঁরাও অঙ্ক কষা শুরু করেছেন। সম্ভাবনা ও ঝুঁকির অঙ্ক। কারণ তৃণমূলের নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ভোটের পর এবার আর শুধু রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজবে না।’
লোকসভা নির্বাচনে এরাজ্যে বিজেপির সাফল্য এসেছিল হাওয়া ও তৃণমূল কংগ্রেসের ‘নেগেটিভ’ ভোটের দৌলতে। কিন্তু বিজেপি বুঝেছে, তা দিয়ে বিধানসভা নির্বাচন জেতা যাবে না। কারণ বাম ভোট ফিরছে নিজের ঘরে। তাই তৃণমূলকে ভাঙার যথাসাধ্য চেষ্টা। সে কাজে বিজেপি কিছুটা সফলও। দলবদলুদের অনুপ্রেরণায় বাড়ছিল ‘বেসুরো’র সংখ্যা। জনমত সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশের পর তাঁরাও অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত। তবে, যাঁরা ‘মউ চুক্তি’তে সই করে ফেলেছেন, তাঁদের কোনও উপায় নেই। কারণ চুক্তিমতো কাজ না হলে ‘গুনগার’ দেওয়াটাই নিয়ম। কিন্তু, যাঁরা দোদুল্যমান? পাঁচিলে বসে হাওয়া মাপছিলেন। তাঁরা ধন্দে পড়েছেন। ঝাঁপটা কোন দিকে দেবেন, সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না। জনমত সমীক্ষার রিপোর্ট ভিন্ন ভিন্ন হতেই পারে। পাল্টেও যেতে পারে। কিন্তু যেটা পাল্টাবে না, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নন্দীগ্রামে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত। নন্দীগ্রাম থেকে নির্বাচন লড়ার ঘোষণায় অনেকের অঙ্কই গুলিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে আচমকাই নন্দীগ্রাম থেকে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেদিনের ভাষণ যাঁরা শুনেছেন বা দেখেছেন, তাঁদের সেটা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তিনি প্রথমে বলেছেন, ভাবছি নন্দীগ্রামে ভালো কাউকে প্রার্থী করব। তারপর বলেছেন, আমি দাঁড়ালে কেমন হয়? তারপর বলেছেন, আমিও দাঁড়াতে পারি। তারপর, সুব্রতদা(বক্সি) নন্দীগ্রামের জন্য আমার নামটা লিখে রাখবেন।
যাঁরা ভাবছেন, এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হঠকারী সিদ্ধান্ত, তাঁদের বিনয়ের সঙ্গে বলব, আপনারা ভুল ভাবছেন। তৃণমূল নেত্রীকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা জানেন, তাঁর সব কিছুর মধ্যেই থাকে একটা পরিকল্পনা। কিন্তু সেটা তিনি কাউকে বুঝতে দেন না। কারণ তিনি চান, তাঁকে প্রতিপক্ষ ‘আন্ডার এস্টিমেট’ করুক। আর সেই সুযোগে তিনি গোল করে বেরিয়ে যাবেন। এটাই তাঁর কৌশল। সিপিএমও সেই ফাঁদে পা দিয়েছিল। ৩৪ বছরের ক্ষমতায় থাকার রেকর্ডের মালিক সিপিএম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী’ মনে করেনি। ‘আন্ডার এস্টিমেট’ করেছিল। প্রতিপক্ষকে ছোট ভাবার খেসারত সিপিএমকে দিতে হয়েছিল।
নন্দীগ্রামের ভাষণটা খুঁটিয়ে শুনলে বোঝা যাবে, তৃণমূলনেত্রী একটি করে কথা বলেছেন, আর জনতার পালস বোঝার চেষ্টা করেছেন। প্রতিটি ধাপে জনতার উচ্ছ্বাস মেপেছেন। মানুষের উন্মাদনার পারদ যখন আকাশ ছুঁয়েছে, তখন তিনি ঘোষণা করেছেন নন্দীগ্রামে দাঁড়ানোর কথা। আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে মমতা ওঠেননি, বরং তিনি একের পর এক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছেন। তাঁর রক্তে রয়েছে চ্যালেঞ্জ। তাই নিজে দল গড়ার চ্যালেঞ্জ নিতে পেরেছিলেন। তাঁর তৈরি দল তৃণমূল সরকার গড়ার হ্যাটট্রিকের মুখে দাঁড়িয়ে। এমনই এক ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে নিয়েছেন ‘ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত’। জমি আন্দোলনের পীঠস্থান নন্দীগ্রামেই লড়বেন তিনি। এও এক চ্যালেঞ্জ। আর সেটা নিয়েছেন অনেক ভেবেচিন্তে। তাই ‘সেফ সিটের সন্ধানে নন্দীগ্রামে’ বলে এখন যাঁরা তাঁকে কটাক্ষ করছেন, হয়তো একদিন তাঁরাই বলবেন, এটা ছিল ‘মমতার আর এক মাস্টার স্ট্রোক’।