দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
আজকের ভারতের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন একটি সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই চিন্তায় আধুনিক ভারতের প্রথম প্রবক্তা ছিলেন সুভাষচন্দ্র। ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে হরিপুরা কংগ্রেসে তিনি জাতীয় পরিকল্পনার কথা উত্থাপন করলেন। ১৯৩৮-এর ডিসেম্বরে হল প্রথম জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি। ওই বছরেই বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, ‘আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে জাতীয় সরকার গঠিত হলে আমাদের প্রথম কাজ হবে একটি জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন স্থাপন করা।’ স্বাধীনতা-পরবর্তী প্ল্যানিং কমিশন তারই উত্তরাধিকার। পরিকল্পনার এই চিন্তা সুভাষচন্দ্রের ভাবনায় এসেছিল ছাত্রাবস্থাতেই। বিলেতে আইসিএস পরীক্ষার সময়েই, ১৯২১ সালে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে চিঠি লিখে জানালেন যে সরকারের চাকরি তিনি করতে চান না, চান কংগ্রেসে যোগ দিয়ে কাজ করতে। সেই সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্পষ্টভাবে লিখলেন, কংগ্রেসের কাজের মধ্যে তিনি কী কী পরিকল্পিত পদক্ষেপ দেখতে চান। আজকের যুবসমাজের কাজে দেশ গড়ার জন্য সুভাষচন্দ্রের এই ভাবনাগুলি আজও প্রাসঙ্গিক।
ইদানীং একটা কথা চালু হয়েছে ‘বহিরাগত’। বহিরাগত বলতে মানুষ এতদিন জানত অনেক দূরের দেশের মানুষ অথবা কখনও অনুপ্রবেশকারীদের। কিন্তু দেশের অন্য অংশের মানুষদের ‘বহিরাগত’ বলার সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা সুভাষচন্দ্রের রাজ্যে চালু করার চেষ্টা দুঃখজনক। ভারতকে যে-রাজ্যের মানুষ নতুন করে জাতীয়তাবাদের ভাবনায় উজ্জীবিত করেছে, উপহার দিয়েছে ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র, জনগণমন সঙ্গীত, সেই রাজ্যে এরকম চিন্তা বিপজ্জনকও বটে। এরাজ্যের মানুষের নয়নমণি সুভাষচন্দ্রকে দেশের সবচেয়ে বড় কণ্ঠস্বর ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তার সভাপতি নির্বাচিত করেছিল—এই হচ্ছে ভারতের জাতীয়তাবোধ। সুভাষচন্দ্র কিন্তু তার থেকেও এক ধাপ এগিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস অধ্যয়ন করে তিনি মনে করেছিলেন যে দেশের স্বাধীনতার স্বার্থে বিদেশের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
১৯৩২ সালে চিকিৎসার জন্য নেতাজিকে যেতে হল ভিয়েনায়। সেখানে তখন চিকিৎসার কারণে ছিলেন কংগ্রেসের আর একজন প্রবীণ নেতা বিটলভাই প্যাটেল। ভারতের দুই প্রান্তের দুই দেশপ্রেমিক নেতা সুদূর বিদেশেও নিজেদের মধ্যে দেশের স্বাধীনতার আলোচনায় ব্যস্ত রেখেছেন। সেখানকার আলোচনায় তাঁরা মনে করেছেন যে দেশের স্বাধীনতার জন্য বিদেশের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। তখনকার খুব কম ভারতীয় নেতার মধ্যে এরকম আন্তর্জাতিক ভাবনার প্রকাশ দেখা যায়। এই আন্তর্জাতিক ভাবনাই সুভাষচন্দ্রকে শক্তি জুগিয়েছে, পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নাটকীয়ভাবে পদার্পণ করে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে দেশকে মুক্ত করতে এগিয়ে যেতে।
নেতাজি ছিলেন যুবসমাজের কাছে এক বীর সৈনিক। আজও ভাবতে রোমাঞ্চ লাগে একজন উচ্চশিক্ষিত বিলেত ঘোরা ভদ্রলোক ব্রিটিশ পুলিসের চোখ এড়িয়ে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে পালাচ্ছেন, বিভিন্ন নামে বিভিন্ন বেশে সারা ভারত পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন আফগানিস্তানে। সেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ। এই সাহস, দেশপ্রেম ভারতের যুবকদের মনে চির উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। এখানেই শেষ নয়, এর কয়েকবছর পর তিনি যখন বুঝছেন যে জার্মানিতে বসে কাজ হবে না, যেতে হবে ভারতের কাছাকাছি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, তখন তিনি বেছে নিলেন আরও দুঃসাহসিক এক অভিযান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তখন সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায় শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই সময় ভারতের অন্যতম জাতীয় নেতা তিন মাস ধরে সাবমেরিন করে জার্মানি থেকে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। এই বিপদসংকুল যাত্রার বিবরণ পড়লে গায়ে কাঁটা দেয় এখনও। এই বীর সৈনিক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
আজও ভাবলে গর্বিত হই, ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার অনেক আগেই নেতাজি স্বাধীনতার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছেন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে। ভারতের পূর্ব সীমানায় ইম্ফলে উড়িয়েছেন স্বাধীনতার পতাকা। এই আজাদ হিন্দ ফৌজের ৭৫ বছর পূর্তিতে দিল্লির লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে সম্মান প্রদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই বীরের শৌর্যকে সম্মান জানাতে এখন থেকে সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন ২৩ জানুয়ারি ‘পরাক্রম দিবস’ নামে পালিত হবে, জানিয়েছে ভারত সরকার। আর এই বীরের নামে কুৎসা করছেন বামপন্থীরা। সুভাষচন্দ্র বসুর মতো নেতা প্রতিটি ভারতীয়ের হৃদয়ে বাস করেন। কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা নেতাজিকে সেই আমলেও সম্মান দেয়নি, আজও দেয় না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদিজি সুভাষবাবুর স্বপ্ন এবং বিচার দিয়ে গড়া এক আত্মনির্ভর ও শক্তিশালী ভারত নির্মাণের সঙ্কল্প নিয়েছেন। বাংলা ও সারা ভারতের লোক তাঁকে সমর্থন করছেন।
আজ সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫ তম জন্মবর্ষের সূচনায় বঙ্গ জননীর এই সুসন্তানকে সমগ্র ভারতের সঙ্গে আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করি। বাংলার সঙ্গে সারা ভারতের মানুষ এই বীর সৈনিককে মনে রাখবে চিরকাল। ভারতের যুবসমাজ বারবার উদ্বুদ্ধ হবে আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্বে। দেশ-বিরোধী শক্তিদের নিঃশেষ করতে আমাদের সংগ্রামের সামনে থাকবেন নেতাজি। আমার প্রণাম শেষ হোক কবিগুরুর কথা দিয়ে, ‘সুভাষচন্দ্র, ... তোমার রাষ্ট্রিক সাধনার আরম্ভ ক্ষণে তোমাকে দূর থেকে দেখেছি। ... আজ তুমি যে আলোকে প্রকাশিত, তাতে সংশয়ের আবিলতা আর নেই, মধ্যদিনে তোমার পরিচয় সুস্পষ্ট। এই শক্তির কঠিন পরীক্ষা হয়েছে কারাদুঃখে, নির্বাসনে, দুঃসাধ্য রোগের আক্রমণে, কিছুতে তোমাকে অভিভূত করে নি; তোমার চিত্তকে করেছে প্রসারিত, তোমার দৃষ্টিকে নিয়ে গেছে দেশের সীমা অতিক্রম করে ইতিহাসের দূর বিস্তৃত ক্ষেত্রে। দুঃখকে তুমি করে তুলেছ সুযোগ, বিঘ্নকে করেছ সোপান। সে সম্ভব হয়েছে, যেহেতু কোন পরাভবকে তুমি একান্ত সত্য বলে মানো নি। তোমার এই চারিত্র শক্তিকেই বাংলাদেশের অন্তরের মধ্যে সঞ্চারিত করে দেবার প্রয়োজন সকলের চেয়ে গুরুতর।’