কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
বলতেই হবে দিলীপ ঘোষ গেরুয়া শিবিরের একজন একনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মী। আরএসএসের আদর্শ ছাত্র। চারদিকে তৃণমূল থেকে আসা বেইমান নেতাদের লাফালাফি দেখে তাঁর অস্বস্তি হওয়ারই কথা। সাড়ে ন’বছর যাঁরা তৃণমূলের লাভের গুড় চেটে চেটে খেয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে একমঞ্চে বসতে গিয়ে তাঁর সেই লুকনো ব্যথাটা বেরিয়ে পড়াও খুব স্বাভাবিক। কারণ ব্যক্তিগত লাভের কথা ভেবে একদল ‘দাদা অনুগত’কে নিয়ে তিনি রাজনীতি করেন না। ওটা তাঁর রক্তে নেই। অসম্ভব লোভ আর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন (পড়ুন দুঃস্বপ্ন!) চরিতার্থ করতে তিনি গেরুয়া পতাকার তলায় আসেননি। আবার কিছু পাইনি বলে ভোটের আগে দলকে পিছন থেকে ছুরি মেরে অন্য ডালে গিয়ে বসার লোকও তিনি নন। কাল যদি দল তাঁকে আদিবাসী সংগঠন দেখতে বলে তিনি হাসিমুখে সব ছেড়ে সেই কাজই করবেন। প্রশ্ন তুলে বিদ্রোহ করবেন না। জয় শাহের বিরুদ্ধে তোপ দেগে শত্রু দলে যোগ দেবেন না। ঝড়-তুফান যাই আসুক বুক পেতে বঙ্গ বিজেপির ঘাঁটি আগলানো ছাড়া তাঁর আর কোনও লক্ষ্য নেই।
আর যাঁরা কলাটা মুলোটার লোভে আজ স্রোতের মতো বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, তাঁরা একটু স্বার্থে ঘা পড়লেই ঝাঁকের কইয়ের মতো যেমন এসেছেন তেমনই কেটে পড়বেন। বটগাছ ছেড়ে আমগাছ, তারপর তেঁতুলগাছে আশ্রয় নেবেন। বিধানসভা ভোটের টিকিট দেওয়ার কাজ শুরু হলেই তার চমকপ্রদ ট্রেলার দেখতে শুরু করব আমরা। বাকিটা ভোটের ফল বেরনোর পর। নিজের লোকেদের শাঁসালো আসন পাইয়ে দিতে ব্যর্থ হলেই এঁদের হঠাৎ জেগে ওঠা গেরুয়া প্রেম তখন নিমেষে উবে যাবে!
আসলে দল ভাঙার রাজনীতি করতে গিয়ে এরাজ্যে বিজেপি আজ বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে। ভাড়াটে সেনা দিয়ে রাজনীতি করার ফল ইতিমধ্যেই পেতে শুরুও করেছেন গেরুয়া কর্তারা। সম্প্রতি এক প্রাক্তন মেয়রের নেতৃত্বে বর্ণাঢ্য রোড শো কর্মসূচির আয়োজন করেছিল বিজেপি। ওয়াটগঞ্জ থেকে হেস্টিংস। কেউ বলেন গোঁসা করে আবার কেউ বলেন শরীর ঠিক না থাকায় প্রাক্তন মেয়র সেখানে হাজিরই হননি। পরিস্থিতি সামাল দিতে অগত্যা ডাকতে হল তৃণমূলেরই প্রাক্তন সেকেন্ড-ইন-কমান্ডকে। এখানে যে দু’জনের কথা বলছি তাঁরা বিস্মৃত হলেও মানুষ জানে, দু’জনেই নেতা হয়েছেন, মেয়র-মন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই আশীর্বাদে। তাঁরা যতই গেরুয়া সাজুন বাংলার মানুষ তাঁদের ‘মমতার লোক’ বলেই শেষদিন পর্যন্ত পরিচয় দেবে। ওই পরিচয় তাঁরা এক নদী জল দিয়েও মুছে ফেলতে পারবেন না।
আর বাংলা দখল হয়ে গিয়েছে বলে ক্রমাগত যাঁরা হাঁক পাড়ছেন তাঁদের অবস্থাটা দেখুন একবার। বাঙালি মুখের দরকার হলেই সেই ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ তৃণমূলের কাছেই হাত পাততে হচ্ছে। নিজেদের কিছু নেই। ভোটের মাত্র কয়েক মাস আগেও মন্ত্রিসভা গড়ার প্রস্তুতির বদলে জেলায় জেলায় কারা ভোটে প্রার্থী হবে আর কারা প্রচার করবে তারই ঠিকঠিকানা নেই এখনও। দেশের সর্ববৃহৎ দলের এ কেমন রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা! উন্নয়নের কথা কই। রাজ্যটা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, কেউ বলছেন না। মানুষ চাকরি পাবে কোথা থেকে, তার দিশা নেই। নাম মুখে আনার মুরোদ নেই, শুধু ‘ভাইপো, ভাইপো’ করলেই গরিবের পেট ভরবে তো? সঙ্ঘ পরিবারের প্রচারের এমন দৈন্যদশা নাগপুরের তাত্ত্বিকদের পক্ষে তো সহ্য করা কঠিন কাজ। তবু গিলতে হচ্ছে, কেননা ক্ষমতা দখল অতি বিষম বস্তু। এবং ক্ষমতা দখলের নেশায় মোদি-অমিত শাহরা বুঁদ হয়ে আছেন। তাই আদর্শ, শিষ্টাচার সব এখন ব্রাত্য। বাংলা দখলে একটাই ধ্রুবপদ, যাকে পারো দলে টানো আর অবাঙালি ছাপ মুছতে তৃণমূল ভাঙো।
কেন এতটা মরিয়া অমিত শাহরা। সোনার বাংলা গড়ার তাগিদ না পরের লোকসভা ভোটের অশনিসঙ্কেত। গেরুয়া পার্টির নেতাদের বিলক্ষণ জানা আছে, কংগ্রেস দুর্বল হলেও চব্বিশের লোকসভা ভোটে বহু রাজ্যেই বিজেপির আসন কমবে। কৃষক ক্ষুব্ধ। শ্রমিকের কাজ নেই। সেই কারণে নতুন নতুন রাজ্যে আসন বাড়াতে না পারলে দিল্লির তখতে মোদিজির স্বপ্নের হ্যাটট্রিক শেষপর্যন্ত অধরাই থেকে যাবে। তাই কাকেরও কোকিল সাজার শখ হল। বাঙালি গন্ধ আমদানি করতে স্নো পাউডার মেখে জেলায় জেলায় যোগদান মেলা। বইমেলা, স্বাস্থ্যমেলা সব গিয়ে এই শীতের দুপুরে মিঠে রোদ্দুর গায়ে মেখে এই বঙ্গে দ্রষ্টব্য সার্কাস বলতে ওই একটাই। অন্য দল থেকে নেতা ভাঙিয়ে আনার নির্লজ্জ খেলা। নারদের ভিডিওর নায়ক থেকে সারদার টাকা লুটের কাণ্ডারী, চার্জশিটে নাম থাকতে পারে জেনেও কুছ পরোয়া নেই। দল বদলে সবাই আজ সাধু! সেই নীতি আদর্শের কাণ্ডারীরাই ঘুরে ঘুরে বলছেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সঙ্গে তাঁর নাকি একটাই ডিল হয়েছে। প্রতি বছর চাকরি দেব। তাঁকে প্রশ্ন করি, গত ছ’বছরে এরাজ্যের কত যুবক দিল্লির চাকরি পেয়েছেন, হিসেবটা একবার দেবেন!
ব্রিটিশরাও শুধু বিভাজন ঘটিয়ে আর নানা প্রলোভনে বিশ্বাসঘাতকদের ব্যবহার করে টানা দু’শো বছর ভারত শাসন করে গিয়েছেন। সেই বেইমানির রক্ত আজও কিছু কিছু লোকের ধমনীতে প্রবাহিত। স্বাধীনতার সাত দশক পরও মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠরা বহাল তবিয়তেই আছেন। দু’শো বছর আগের সেই কলঙ্কিত ইতিহাস অনুসরণ করেই আজ মানুষে মানুষে বিভেদ ঘটিয়ে ভারত শাসনের পথ নিষ্কণ্টক করতে মরিয়া গেরুয়া শক্তি। বিশেষ করে আমাদের এই আপাত শান্ত বাংলায়। আর তা করতে গিয়েই যে দলকে তাঁরা আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত বলে তোপ দাগছেন, সেই দলের নেতাদেরই মঞ্চ সাজিয়ে ফুল মালা দিয়ে আবাহন করছেন। কিন্তু এ কোন নীতিহীন পরিবর্তনের কথা বলছেন তাঁরা। এ তো গায়ের জোরে বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে চূড়ান্ত ধোঁকাবাজি।
মমতা ২০১১ সালে সিপিএমকে হারাতে সুজন, বিমান, সূর্যকান্তকে তো ভাঙিয়ে আনেননি। যদি গেরুয়া শক্তি ক্ষমতা দখলের এতটা কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েই থাকে তাহলে ভোটের দু’মাস আগেও অন্য দল ভাঙার এমন মরিয়া প্রয়াস কেন? মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়ে এমন টানাটানি যে হাসপাতালে ভর্তি বাংলার এক নক্ষত্রের জন্যও নেতারা হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন। বারবার দিল্লি থেকে ফোন আসছে। কী লজ্জার ব্যাপার! এ কোন দিকে ছুটছি আমরা! নেতা থেকে তারকা সবই যেন বিক্রয়যোগ্য পণ্য, পুতুল কেনার মতো কিনে নিলেই হল। আর রাজ্যটা জয়নগরের মোয়া, ভূমিপুত্র মাহেন্দ্রক্ষণ দেখে মোদিজির হাতে তুলে দেবেন!
এই বেপরোয়া খেলায় আজ গোটা বাঙালি জাতি টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। একভাগ দলত্যাগী বেইমান, অপর ভাগ সমদূরত্ব বজায় রাখা কালিদাস, আর একটি ভাগ হল, পুরনো অবস্থানে অনড়। উপরন্তু সংখ্যালঘু ভাইরাও আজ বিপন্ন। তাঁদের নিয়েও নোংরা খেলা শুরু হয়েছে। মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক ভাঙতে সুকৌশলে আসাউদ্দিন ওয়াইসির মিমকে এরাজ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন অমিত শাহ অ্যান্ড কোম্পানি। আসাউদ্দিন ওয়াইসির কাজটা কী? গত কয়েক বছর ধরে তাঁর রাজনীতি যাঁরা খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা বলছেন, একটা অসাধ্য সাধন করার জন্যই অমিত শাহ বিভিন্ন রাজ্যে ঠিক ভোটের আগে তাঁকে পাঠিয়ে থাকেন। ভোটে জিততে অমিত শাহ ও সঙ্ঘ পরিবার সম্প্রতি যে ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’য়ের সাহায্য নিচ্ছেন তারই প্রধান অস্ত্রই হচ্ছে ওয়াইসির এই মুসলিম ভোট ভাঙার কৌশল। বিহারে তাঁর সক্রিয়তাতেই মুসলিম ভোট ভেঙে তেজস্বী যাদবের যাত্রাভঙ্গের কাহিনি সবাই দেখেছে। উত্তরপ্রদেশেও মুসলিমদের তিনি সুকৌশলে বিভক্ত করেছেন। আর এখন বাংলার আসন্ন নির্বাচনে আসাউদ্দিন সাহেবের একটাই কাজ, যেন তেন প্রকারে মুসলিম ভোটের কিছুটা তৃণমূলের হাত থেকে বের করে আনা। তাতে কার লাভ? মুসলিমদের না ভারতের একমাত্র হিন্দু পার্টি বিজেপির? সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের আগে পর্যন্ত এরাজ্যে মুসলিম ভোট বামেদের হাতে ‘সুরক্ষিত’ ছিল। তার জোরেই দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি জ্যোতিবাবুরা দাপটে বাংলা শাসন করেছেন। তৃণমূলের এক দশকেও সংখ্যালঘু ভোট ‘সুরক্ষিত’ ছিল মমতার হাতে। সেই যুক্তি থেকেই এবার তৃণমূলকে চাপে রাখতে বিজেপির আপাত শত্রুবেশী বন্ধু ওয়াইসির আগমন। লক্ষ্য একটাই, মমতার সুরক্ষিত মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কে সিঁদ কাটা।
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল সিপিএমের সাড়ে তিন দশকের জগদ্দল পাথরকে উপড়ে ফেলা। দশ বছর পর তিনি আবার এক কঠিন লড়াইয়ের সামনে। এবার আগের চেয়েও শক্ত চ্যালেঞ্জ। গোটা রাষ্ট্রশক্তি কোমর বেঁধেছে। এবং বলাই বাহুল্য, দেশের তাবৎ বিজেপি-বিরোধী শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। কারণ কংগ্রেস ও সিপিএম যতই জোট করে সমদূরত্বের রাজনীতি করুক, আসলে দু’জনেই আবার ভাবের ঘরে চুরির খেলায় নেমেছেন। তাঁরা বিপদটাকে বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। বাংলায় বিজেপিকে রোখা না গেলে আগামী চব্বিশের সাধারণ নির্বাচনের আগেই দেশের বিরোধী শক্তির মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে, এটাই সহজ সত্য। বাংলার অগ্নিকন্যাকে চিরদিন একা লড়াইয়ের ময়দানেই দেখে এসেছে বাঙালি। সেই সংগ্রামে তিনি আপসহীন অকুতোভয়। এবারও এত বিতর্কের পর তাঁর একক লড়াইয়ের দিকেই তাকিয়ে গোটা বাংলার মানুষ। বাংলার সাধারণ ঘরের আটপৌরে নেত্রী আজও একাই ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।