কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
লোকসভা নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের সাফল্য দেখে যে তৃণমূল বিধায়ক সবচেয়ে আগে বিজেপিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তাঁর নাম মনিরুল ইসলাম। লাভপুরের বিধায়ক। গেরুয়া শিবিরের ‘সংখ্যালঘু মুখ’ হওয়ার আশায় সোজা দিল্লি। বিজেপিতে যোগ দিতেই বীরভূমে গেরুয়া শিবিরে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। তাই দল বদলে ‘লাল কার্পেটে’ অভ্যর্থনা তাঁর জোটেনি। উল্টে বিক্ষোভের আগুনে ঝলসে গিয়েছিল রাজনীতির নতুন ইনিংস শুরুর স্বপ্ন। বিক্ষোভের জেরে একপ্রকার নাকে খত দিয়ে তিনি বিজেপির সদস্যপদ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এখন তাঁর অবস্থা না ঘরকা, না ঘাটকা।
লোকসভা ভোটের পর বিজেপিতে ‘বেনোজলে’র স্রোত আছড়ে পড়তেই দলের মধ্যে শুরু হয়েছিল দ্বন্দ্ব। বিজেপির একাংশ অন্য দলের নেতাদের যোগদানের বিরোধিতা করেছিল। তারা বলেছিল, কোনও নেতা ও সংগঠন ছাড়াই লোকসভা নির্বাচনে সাফল্য এসেছে। তার মূল কারণ শাসক দলের নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। ফলে সেই সব নেতা বিজেপিতে এলে সাধারণ মানুষ রুষ্ট হবে। তাতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। ধাক্কা খাবে বিজেপির ‘স্বচ্ছতার রাজনীতি’র স্লোগান।
অপর পক্ষের পাল্টা যুক্তি ছিল, দল বড় না করলে রাজ্যের ক্ষমতা দখল অসম্ভব। তৃণমূলকে ভাঙতে হবে। তাই দরজা সকলের জন্য খুলে দিতে হবে। ক্ষমতা দখল করতে গেলে কোনও বাছবিচার করা চলবে না।
এই ইস্যুতে বিজেপির মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠায় আরএসএস হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, নেতা নয়, জনতার মন জয়ই তাদের লক্ষ্য। গেরুয়া শিবিরের সেই সিদ্ধান্তের জেরে বিজেপিতে দীর্ঘদিন অন্য দল থেকে নেতা নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর অন্য দল থেকে আসা নেতাদের শোকেস থেকে গোডাউনে পাঠিয়েছিল। সেসব দেখে অনেকে বলেছিলেন, বিজেপি রেজিমেন্টেড পার্টি। এই দলে ‘বেনোজল’ ঢোকা এত সহজ নয়। কারণ বিজেপি হচ্ছে ‘মুখ’ আর ‘ব্রেন’ আরএসএস।
সেদিন যাঁরা ‘বিজেপি রেজিমেন্টেড পার্টি’ বলে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছিলেন, এখন তাঁরা ‘শোভন-বৈশাখী’ জুটি ইস্যুতে দলের নেতাদের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণে মুখ লুকচ্ছেন। এমনিতেই নারদ কাণ্ডে অভিযুক্ত শোভন চট্টোপাধ্যায়কে দলে নেওয়ায় বিজেপিকে অনেক কটাক্ষ হজম করতে হচ্ছে। তার উপর তাঁর ‘বান্ধবী’ বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় একের পর এক শর্ত চাপাচ্ছেন। বিজেপি নেতৃত্ব তা মেনেও নিচ্ছে। কোনও রকম রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা সত্ত্বেও বৈশাখীদেবীকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দিতে বিজেপি বাধ্য হয়েছে। তারপরেও কলকাতায় র্যালিতে শোভন-বৈশাখী জুটি যোগ দেবেন বলেও যেভাবে ‘গোঁত্তা’ খেয়েছে, তা নজিরবিহীন। এসব দেখে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এরপরেও কি বিজেপিকে ‘রেজিমেন্টেড পার্টি’ বলা যায়? বিশেষ করে এরাজ্যে!
এসব করতে গিয়ে বিজেপির যে মুখ পুড়ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবুও তারা বেপরোয়া। তাই যাঁদের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণকারী, কয়লা মাফিয়া, টেট কেলেঙ্কারির নায়কের তকমা সেঁটে দিয়ে আন্দোলন করেছিল, এখন তাঁদের এনেই ঘর সাজাচ্ছে।
প্রশ্নটা হচ্ছে, আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপির হঠাৎ কেন এই পরিবর্তন? কেন ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ায় বিশ্বাসী বিজেপি অন্যের দল ভাঙাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে? কেন তৃণমূল নেতাদের দলে টানতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে সক্রিয় করতে হচ্ছে?
বিজেপির এই ভোল বদলের পিছনে রয়েছে অঙ্ক। ভোটের হিসেব কষতে গিয়ে দেখেছে, নীতিকে প্রাধান্য দিলে বঙ্গ জয়ের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। কারণ লোকসভায় বিজেপি ভোটের একটা বড় অংশ এসেছিল বামেদের কাছ থেকে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিজেপি নেতৃত্ব একপ্রকার নিশ্চিত হয়েছে, বাম ভোটের একটা বড় অংশ তারা হারাতে চলেছে। সিপিএমের মিটিং মিছিলে লোকজনের ভিড় বিজেপির ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’দের কপালে ভাঁজ ফেলেছে।
তবে, গেরুয়া শিবিরের উদ্বেগ বাড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় বামেদের অতি সক্রিয়তা। এতদিন বামেরা তৃণমূলকেই টার্গেট করে নানা রকম পোস্ট করে এসেছে। তার পুরো ফায়দা পেয়েছে বিজেপি। কিন্তু এখন কৃষি আইন, পেট্রল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব সহ বিভিন্ন ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে তারা বিজেপিকে তুলোধোনা করছে। ২৬ সালে ক্ষমতায় ফেরার লক্ষ্যে এখন থেকেই শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে। তাই বামেদের দখলে থাকা ৭ শতাংশ ভোটে নতুন করে থাবা বসানোর কোনও সুযোগ নেই। উল্টে বামভোট পুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর সেটাই বিজেপির কাছে অশনি সঙ্কেত। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের ভোট ভাঙানোই বিজেপির মূল টার্গেট। তাই নীতি, স্বচ্ছতা আপাতত সিন্দুকে।
নির্বাচন এগিয়ে এলে সমস্ত রাজনৈতিক দলের মিটিং মিছিল, পদযাত্রা বেড়ে যায়। দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মনোবল বাড়ানোই উদ্দেশ্য। বিজেপির কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতৃত্ব যেখানে পদযাত্রা বা জনসভা করছে, সেখানেই তৃণমূল পাল্টা কর্মসূচি নিচ্ছে। কারণ ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বোলপুরে অমিত শাহের পদযাত্রায় ভিড় হওয়ায় গেরুয়া শিবির বেশ চাঙ্গা হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদযাত্রা। তৃণমূল নেত্রীর পদযাত্রার ভিড় দেখে বিজেপি আর তুলনায় যাওয়ার সাহস পায়নি। একই ঘটনা ঘটেছিল বাঁকুড়াতেও। তবে বিজেপির ব্যাখ্যা, ভয় দেখিয়ে, প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল লোক এনেছে।
শুধু মমতার জনসভা বা পদযাত্রায় নয়, তৃণমূলের জেলা নেতাদের সভাতেও ব্যাপক ভিড় উপচে পড়ছে। অনেকে বলছেন, ২০১৬ সালে তৃণমূলের সভাতেও এত মানুষের ভিড় হতো না। বিপুল জনসমাগমের পিছনে ঘাসফুল শিবিরের ব্যাখ্যা, বিজেপি যত নেতাদের ভাঙাচ্ছে দলের কর্মী-সমর্থকরা ততই এককাট্টা হচ্ছে। তৃণমূলের ‘অতৃপ্ত আত্মা’রা চলে যাওয়ায় দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও কমে গিয়েছে। দলের কর্মীরা যে মমতার সঙ্গে আছে, সেটা প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠছে।
ভিড়ের প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে না পেরে বিজেপির অস্ত্র ‘হুইসপারিং ক্যাম্পেন’। তার জন্য মূলত বাস স্ট্যান্ডের আশেপাশের চায়ের ও পানের দোকানগুলিকেই বিজেপি বেশি টার্গেট করছে। প্রায় সর্বত্র দলবদলুদের নিয়ে ও দুয়ারে সরকার নিয়ে জোরদার চর্চা চলছে। স্বাস্থ্যসাথীর প্রশংসা শুনলেই বিজেপির ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’রা সক্রিয় হচ্ছে। বলছে,
এসব ভোটের জন্য। এই কার্ডে চিকিৎসার সুযোগ পাবে না। তবে কেউ প্রতিবাদ করলেই আলোচনা দ্রুত এসএসসি, টেট পরীক্ষার দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। বলছে, বেকারদের জন্য এই সরকার কিচ্ছু করেনি। শুধু চাল-গম দিলেই হবে? চাকরি দিতে হবে। যুবসমাজ দয়ায় বাঁচতে চায় না, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। তাই ‘দিদি আর আসছে না।’ তবে কেউ কেন্দ্রের চাকরির প্রসঙ্গ তুললেই তারা বাস ধরার অজুহাতে সেখান থেকে হাঁটা দিচ্ছে।
হুইসপারিং ক্যাম্পেনে বিজেপির ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’রা দলবদলুদের বিষয়টি কৌশলে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। বলছে, তৃণমূল যে আসছে না, সেটা ওদের ‘পোড়খাওয়া’ নেতারাও বুঝেছে। তাই তো বিজেপিতে ভিড়ছে। তখনই উড়ে আসছে মীরজাফরের মতো বিশেষণ।
এবারের ভোটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, নেতাদের সঙ্গে জনতাও কি দল বদলায়? কারণ নিজেকে বাঁচানোর ও পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় অধিকাংশ নেতা জার্সি বদলান। কিন্তু জনতা? জনগণও কি দিন দিন সেই কালচারে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে? জীবনের অভিধান থেকে মুছে যাচ্ছে ন্যায়-নীতি, কৃতজ্ঞতাবোধ? এই মুহূর্তে বঙ্গ রাজনীতিতে সেটাই কোটি টাকার প্রশ্ন। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে মিলবে তার উত্তর। এই ভোটে ঠিক হবে, জনতা নেতার সঙ্গে, নাকি নীতির সঙ্গে!