পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
১৯৬৪ সালে নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব গঠনের পর থেকেই সিপিএমের প্রধান প্রতিপক্ষ ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। কংগ্রেসকে সরকার গড়া থেকে দূরে রাখতে কংগ্রেস ভেঙে বাংলা কংগ্রেস হওয়া গোষ্ঠীটির সঙ্গে জোট করে ষাটের দশকে সরকার গড়েছিল সিপিএম। কংগ্রেসকে পরাস্ত করতে ১৯৭৭ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ি ও লালকৃষ্ণ আদবানিদের জনসংঘের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জনতা জোটে শামিল হয়েছিল সিপিএম। ইন্দিরা গান্ধীকে প্রত্যেকটি নির্বাচনে দেওয়াল লিখনে ডাইনি আখ্যা দিয়ে তাঁর দলের প্রতীক ‘হাত’ থেকে রক্ত ঝরছে এরকম কার্টুন আঁকা হয়েছে। রাজীব গান্ধীকে চোর অপবাদ দিয়ে ‘রাজীব বোফর্স গান্ধী’ সম্বোধন করেছে সিপিএম। গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়—এই কংগ্রেস বিরোধী স্লোগানটি সিপিএম মহাউৎসাহে ব্যবহার করেছে দিনের পর দিন। সিপিএমের ক্যাডারবাহিনীর হাতে বাংলায় অসংখ্য কংগ্রেস কর্মী সমর্থক নিহত হয়েছে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও গণহত্যায়। এই সেদিন ২০০৮ সালে ড. মনমোহন সিং-এর সরকারকে চরম বিপদে ফেলে সিপিএম আচমকা সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। অথচ এতকিছুর পরও কংগ্রেস সমস্ত যন্ত্রণা, অপমান, অসম্মান, বিশ্বাসঘাতকতা ভুলে গিয়ে সিপিএমের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কংগ্রেস কর্মী ও নেতাদের এখন সিপিএমের পক্ষে নানাবিধ প্রচার ও যুক্তিপ্রদান করতে হয়। এটা মন থেকে প্রকৃত কংগ্রেস কর্মী সমর্থক নেতা অবশ্যই মেনে নিতে পারে না। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই পথ তাদের নিতে বাধ্য করেছেন কে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ, তাঁকে হারাতে গেলে নিজেদের একক ভোটব্যাঙ্কে সম্ভব নয়। যারা বিধানবাবুকে লাগাতার উন্নয়নে বাধা দিয়ে গেল, যারা প্রফুল্ল চন্দ্র সেনকে দুর্নীতিগ্রস্ত আখ্যা দিল, যারা ইন্দিরা গান্ধীকে ডাইনি বলেছে, রাজীব গান্ধীকে চোর বলেছে এবং সোনিয়া গান্ধীকে চরম বিপদে ফেলে সরে গিয়েছে, কংগ্রেস এখন তাদের সঙ্গে জোট করেছে। একমাত্র কারণ মমতাকে পরাস্ত করা। কংগ্রেস ভবিষ্যতে সিপিএমের রাজনৈতিক বিরুদ্ধাচারণ করতে পারবে না। এতে কী ক্ষতি হল? যত কম ভোটব্যাঙ্কই থাকুক, আগামীদিনে মাথা উঁচু করে চলার পথ ধাক্কা খেল। কংগ্রেস বিহারে লালুপ্রসাদের দলের সঙ্গে জোট করে, ঝাড়খন্ডে হেমন্ত সোরেনের দলের সঙ্গী, মহারাষ্ট্রে শিবসেনাকে সমর্থন করে। তামিলনাড়ুতে ডিএমকের সঙ্গী হয়। আবার বিজন সেতু, নেতাই, নন্দীগ্রাম, ছোট আঙারিয়া, কেশপুর, গড়বেতায় সন্ত্রাসে পিএইচডি করা সিপিএমের সঙ্গেও জোট করে। অর্থাৎ যখন যেমন সুবিধা! অবশ্যই এরকম বহু কংগ্রেস কর্মী সমর্থক আছেন, যাঁরা দলকে সিপিএমের সঙ্গে জোট করতে দেখে ব্রিবত হন। মমতা ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দল ছাড়ার আগে ও পরে লাগাতার বলতেন, কংগ্রেস আসলে সিপিএমের গোপন বন্ধু। আজ কংগ্রেস কি তা প্রমাণ করে দিচ্ছে না নিজেই?
সিপিএমের স্থির বিশ্বাস কী ছিল? দেশের অর্থনীতি বিপন্ন করেছে কংগ্রেসের ভ্রান্ত নীতি। ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাস থেকে বামপন্থীদের জেলবন্দি করেছে কারা? কংগ্রেস। বাহাত্তরের সন্ত্রাসকে সিপিএম এই কিছু বছর আগে পর্যন্ত স্ট্রিট কর্নারে প্রচার করেছে কাদের বিরুদ্ধে? কংগ্রেস। ষাটের দশকে দেশহিতৈষী পত্রিকায় সিপিএম নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত একবার লেনিন থেকে এক দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘জনগণের সংগ্রামে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব আপনা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় না। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শুধু বড় বড় উন্নত রূপের মন্ত্র আওড়ালেই চলবে না। এর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে সঠিক কর্মনীতির ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে দৈনন্দিন কাজের দ্বারা, জনগণের সংগ্রাম পরিচালনা করে তাদের আস্থা অর্জন করা। ...প্রতি দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগতির পথে দক্ষিণপন্থী এবং বামপন্থী, উভয় ধরণের সুবিধাবাদই দেখা দেয়। দুই ফ্রন্টের, সংশোধনবাদ আর সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে আমাদের পার্টি নির্দেশিত পথেই আমরা এগিয়ে যাবো। কিন্তু চলার পথে কোন সময়ে আমাদের একথা ভুললে চলবে না যে, সংশোধনবাদ আমাদের প্রধান বিপদ’। এহেন এক দৃপ্ত কমিউনিস্ট উচ্চারণের উত্তরসূরিদের আজ কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাতে আর বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হয় না। কেন? কারণ, মুজফফর আহমেদদের আদর্শের পার্টি আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাস্ত করতে চায় শুধু। বাকি আর কোনও নীতি আদর্শে তাদের পিছুটান নেই। বিশুদ্ধ বামপন্থী, সিপিএমের একনিষ্ঠ সমর্থক কি এই বিচ্যুতিকে মন থেকে মেনে নিচ্ছেন? তাঁরা কি অনেক বেশি সন্তুষ্ট হতেন না যদি আদর্শ ও অবস্থান থেকে না সরে এসে, সিপিএম লাগাতার একক শক্তিতেই বিজেপি ও মমতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যেত? সেটাই কি অনেক বেশি সম্মানজনক হতো না? হয়তো দেরি হতো নিজেদের সংগ্রামকে জনগণের সংগ্রামে পরিণত করতে। কিন্তু আত্মসম্মানটা বজায় থাকত। সিপিএম কি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আর কখনও কোনও রাজনৈতিক আক্রমণ করতে পারবে? সেই পথ কি বন্ধ করে দিলেন না একা মমতাই?
বিজেপির পুরনো কর্মী সমর্থকরা একটা কথা বলে খুব আত্মসন্তুষ্ট হতেন এতকাল। সেটা হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের একটা আদর্শ আছে। সততা আর শৃঙ্খলা আছে। সেখানে শিক্ষা নিয়ে তবেই একজন প্রথম সারির নেতা হওয়ার দায়িত্ব পান। লালকৃষ্ণ আদবানি থেকে নরেন্দ্র মোদি তার প্রমাণ। সেই বিজেপিকে সম্পূর্ণ নীতিচ্যুত হতে হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে। মমতা একাই আরএসএস এবং বিজেপির চরিত্র বদল করে ফেললেন। এখন বিজেপি কী করছে? তৃণমূল থেকে নেতাদের দলে নিয়ে তাদেরই নিজেদের দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পরিণত করছে। মেদিনীপুরের এক শক্তিশালী তৃণমূল নেতা এখন মেদিনীপুরেই বিজেপির শক্তিশালী নেতা। সল্টলেকের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা এখন সল্টলেকেই বিজেপির নেতা। ভাটপাড়া-বারাকপুরের শক্তিশালী তৃণমূল নেতাই এখন বারাকপুর ভাটপাড়ায় শক্তিশালী বিজেপি নেতা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সংগঠক নেতা এখন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি। বিজেপি নিজেদের শক্তিশালী নেতা তৈরিও করতে পারেনি এবং কেউ যে তৈরি হবে এই বিশ্বাসও করছে না। সুতরাং বিজেপি এখন ‘মমতা ইনস্টিটিউট’ অথবা ‘তৃণমূল অ্যাকাডেমি’ থেকে তৈরি হওয়া একের পর এক যোগ্য ও প্রভাবশালী নেতাদের দলে রিক্রুট করছে। যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে বিজেপি সরব ছিল, তাঁদেরই বিজেপি এখন উচ্চপদে বরণ করছে। এর ফলে বিজেপির শক্তি ও প্রভাব হয়তো বাড়ছে বলে তারা মনে করছে। কিন্তু বড়সড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে ভাবমূর্তির। সবথেকে বেশি অস্বস্তি আর লজ্জায় পড়ছেন বিজেপির আদিযুগের বিশুদ্ধ নেতাকর্মীরা। যাঁরা স্বপ্ন দেখতেন বিজেপি সম্পূর্ণ নিজের শক্তিতেই একদিন তৃণমূলকে পরাস্ত করবে। যেটা অনেক বেশি দীর্ঘমেয়াদি সম্মানের। এখন এই প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে বিজেপি নেতৃত্ব বুঝে গিয়েছে, তৃণমূলকে বিজেপি হারাতে পারবে না। তৃণমূলকে হারাতে পারবে তৃণমূলই। অর্থাৎ অফিসিয়াল তৃণমূলকে বিদ্রোহী তৃণমূলদের হেল্প ছাড়া হারানো অসম্ভব। তাই বিজেপি নিজেদের সৎ, শৃঙ্খলাপরায়ণ, উচ্চ আদর্শ থেকে সম্পূর্ণ সরে এল। এখন আর বিজেপি বলতেই পারছে না যে, অন্য দল থেকে আমরা কাউকে নেব না কিংবা নিজেদের শক্তিতেই বিশ্বাসী। যাকে পারছে তারা দলে নিচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিজেপি দলবদলের ধাক্কা দিতে চেয়েছে। মমতা কিন্তু অলক্ষ্যে তাঁর প্রত্যেক প্রতিপক্ষের চরিত্রটাই বদল করে দিলেন! তারা আগে যা ছিল, সম্পূর্ণ বদলে গেল তাদের ইমেজ। যাকে ইংরাজিতে বলা হয় ইরিপেয়ারেবল! ইমেজফেরত সম্ভব নয়! ক্ষতি এটাই!