বাড়তি অর্থ পাবার যোগ আছে। পদোন্নতির পাশাপাশি কর্মস্থান পরিবর্তন হতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পক্ষে থাকবে। ... বিশদ
আগামী বছরের ভোটে রাজনীতির বাইরে এই পৃথক সামাজিক আঙ্গিকটিও কৌতূহলের জন্ম দেবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকা অথবা না থাকা, সেক্ষেত্রে আর নিছক একটি রাজনৈতিক তথ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। বরং সমাজতত্ত্বের অন্যতম ভাবনা হিসেবেও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে যে, হঠাৎ কেন দেশজুড়ে জননেত্রীর আগমন বন্ধ হয়ে গেল। জয়ললিতা প্রয়াত হয়েছেন। মায়াবতী তাঁর সেই প্রবল জনপ্রিয়তা থেকে বিচ্যুত। তাঁর রাজনৈতিক সমীকরণ বদল ক্রমেই তাঁর ভোটব্যাঙ্ককে যেমন সরিয়ে নিয়েছে তাঁর থেকে, তেমনই জাতীয় রাজনীতিতেও তিনি গুরুত্ব হারিয়েছেন দ্রুত। বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া অত্যন্ত সুচারুভাবে রাজস্থানে বিজেপির প্রধান মুখ হিসেবে উঠে এসেছিলেন নিজের ক্যারিশমার জোরে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের জুটির শাসনকালে বিজেপির ক্ষমতার বৃত্তে তিনি নেই। তাই আগামীদিনে পুনরায় তাঁকেই যে রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে প্রজেক্ট করা হবে, সেই সম্ভাবনা নিশ্চিত নয়। সবথেকে বড় কথা হল, তিনি একটি সর্বভারতীয় দলের রাজ্য শাখার নেত্রী। কিন্তু এককভাবে কোনও দলের কর্ণধার, নীতি নির্ধারক কিংবা ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারেননি। সোনিয়া গান্ধী ক্রমেই বয়স ও অসুস্থতার কারণের দলের নিত্যদিনের নীতি নির্ধারণ অথবা নেতৃত্বপ্রদানের দায়িত্ব থেকে কিছুটা সরে গিয়েছেন।
রয়ে গেলেন একমাত্র মমতাই। সোনিয়া গান্ধী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কেরিয়ার প্রায় একসঙ্গেই শুরু হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে। সোনিয়া কংগ্রেসের দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে কংগ্রেসকে দিল্লিতে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিলেন। যদিও এককভাবে কংগ্রেসকে শক্তিশালী করতে পারেননি তিনি। ২০০৪ সালে একঝাঁক জোটসঙ্গীকে নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সোনিয়া জননেত্রী ছিলেন না। তাঁর ছিল দলের ভরসা। তাই যখন দল বিপদে পড়ল দুর্নীতি ও অন্য কিছু ইস্যুতে, তখন তিনি নিজের প্রবল জনপ্রিয়তা দিয়ে সেই প্রতিবন্ধকতাকে ঢেকে দিয়ে দলকে রক্ষা করতে পারেননি। পাশাপাশি নিজস্ব একক দল গঠনের পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেরিয়ারটি ঊর্ধ্বমুখী। তিনি ১২ বছরের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় চলে এলেন।
এবং পরবর্তী ১০ বছর সেই ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। শীলা দীক্ষিত ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনও
মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর রেকর্ড নেই, যিনি ১৫ বছর ক্ষমতাসীন থাকতে পেরেছেন। সুতরাং, সেই রেকর্ড স্পর্শ করতে হলে ২০২১ সালে তাঁকে আবার জয়ী হতে হবে। পারবেন কি তিনি?
কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের বিপুল প্রত্যাশা ছিল প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে। কিন্তু সম্ভবত তাঁকে যথাসময়ে রাজনীতিতে নিয়ে আসার দূরদৃষ্টি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন সোনিয়া গান্ধী। কারণ সোনিয়ার তথা কংগ্রেসের বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ দ্বিধা, দোলাচল এবং সিদ্ধান্তহীনতা। রাহুল না প্রিয়াঙ্কা? এই টানাপোড়েনে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে প্রিয়াঙ্কার নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ারটি। কারণ, তিনি আগ্রাসী হয়ে কোনও রাজনৈতিক ইস্যুতে ময়দানে নামতে চাইলেও, সর্বদাই ভাবতে হয়, কতটা নামবেন? রাহুলকেই এগিয়ে দেওয়া কাম্য ভেবে তাঁর আর ঝাঁপিয়ে পড়া হয় না। সুতরাং সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর রাজনীতি থমকে যাচ্ছে।
বিহার নির্বাচনে দেখা গেল নতুন এক তরুণ নেতার জন্ম হয়েছে। তেজস্বী যাদব। ঠিক এরকমভাবে কোনও মহিলা রাজনীতিক ভারতের আকাশে উঠে আসছেন না আর। বস্তুত রাজনীতি এমন একটি মেগাস্ক্রিন, যেখানে সংরক্ষণের কোটা দিয়ে কাউকে সুপারস্টার করা যাবে না। অর্থাৎ মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ অথবা ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ করা হলে, কাগজে-কলমে মহিলাদের অবশ্যই সংসদীয় গণতন্ত্রে যোগদান অনেক বেশি হবে। হচ্ছেও। কিন্তু জননেত্রী হতে গেলে সম্পূর্ণ সহজাত স্পার্ক, ক্যারিশমা আর মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। সেরকম যোগ্য মহিলা রাজনীতিকের আগমন ঘটছে না, নাকি বিভিন্ন দলই যোগ্য নেত্রীদের সামনে এগিয়ে আসার সুযোগ দিচ্ছে না? এই প্রশ্নটি তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতে মহিলা রাজনীতিক, জননেত্রী, সর্বোচচ মানের পার্লামেন্টেরিয়ানের একটি ইতিহাস রয়েছে। সরোজিনী নাইডু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, সুচেতা কৃপালনী থেকে যে ধারার সূত্রপাত, সেই প্রবণতায় যুক্ত হয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী থেকে বিজয়া রাজে সিন্ধিয়ারা। সুষমা স্বরাজ, উমা ভারতীরা নিজেদের যোগ্যতায় দলের শীর্ষস্তরে উঠে এসেছিলেন।
এমনকী রাজনীতিতে অনেক বৃহৎ একটি স্থান অর্জনের সুযোগ এলেও সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে সম্মান ও গুরুত্বের শীর্ষে উঠেছেন এরকম ব্যক্তিত্বও আছেন। যেমন কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়।
বিমান বসু, সুজন চক্রবর্তী, মহম্মদ সেলিম, অধীররঞ্জন চৌধুরী, দিলীপ ঘোষ ... বিরোধী দলেও বস্তুত রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, নীতি নির্ধারক এবং দলকে নেতৃত্ব প্রদানের ভার এই নেতাদের হাতে। বিরোধী দলগুলির মধ্যে মহিলা রাজনীতিক অনেকেই আছেন। কিন্তু তাঁরা নিছকই এমপি, বিধায়ক, মহিলা সংগঠনের সভানেত্রী ইত্যাদি হয়েই রয়েছেন। কিছু কিছু কর্মসূচিতে তাঁদের যোগদান করতে দেখা যায়। কিন্তু তিনিই প্রধান আলোচ্য অথবা গুরুত্বের ফোকাসে চলে এসেছেন, এরকম হচ্ছে না। এমনকী এই মুহূর্তে বিরোধী দলগুলির পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী মুখ হওয়ার জল্পনায় কোনও নেত্রী নেই। সকলেই নেতা। কয়েক বছর আগে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সিপিএমের একটি সমাবেশে দলীয় নেত্রী দেবলীনা হেমব্রমের একটি ভাষণ প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় তরঙ্গ উঠেছিল যে, তিনি আগামীদিনের জননেত্রী হয়ে ওঠার শক্তি রাখেন। সিপিএম নেতাকর্মীদের একাংশ তাঁকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু তারপর কেন তিনি বিস্মৃত হলেন? সেই মোমেন্টামটি ধরে রাখতে পারলেন না কেন? নাকি দলের যথার্থ সহায়তা পেলেন না?
ঠিক এই প্রেক্ষিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তো বটেই, এদেশের নারীসমাজের কাছেও পশ্চিমবঙ্গের আগামী নির্বাচনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তৃণমূল দলের পুনরায় জিতে ক্ষমতাসীন হওয়া অথবা বিজেপির কাছে পরাস্ত হওয়ার মতো রাজনৈতিক চর্চার পাশাপাশি কিন্তু থেকে যাচ্ছে অন্য একটি তত্ত্ব। সেটি হল, দেশের মধ্যে অন্তত একটি রাজ্যে কোনও মহিলা মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন কি না! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোনও নারী রাজনীতিকের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে না। তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ দোর্দণ্ডপ্রতাপ নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ। তৃতীয় শক্তি বাম-কংগ্রেস জোটেরও সেনাপতিরা সকলেই পরিচিত নেতা। এটা নিয়ে সন্দেহ নেই যে, রাজনীতির যুদ্ধ কোনও পুরুষতন্ত্র বনাম নারীশক্তির লড়াই নয়। এটা সার্বিক অর্থেই নীতির লড়াই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রশাসনিক ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ। সুতরাং ভোটাররা নিজের প্রিয় দল অথবা নেতানেত্রীকে ভোট দেন। জেন্ডার হিসেবে ভোট দেওয়া হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন দেখা যাচ্ছে, ১৩৫ কোটির দেশে, ৩৪টি রাজ্যে মাত্র একটি রাজ্যে ক্ষমতায় আসীন নারী মুখ্যমন্ত্রী, সেটা যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। সুতরাং সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও আগ্রহটি তীব্র হয় যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি এই নারী ক্ষমতায়নের একমাত্র কেল্লাটি ধরে রাখতে সমর্থ হবেন?
আগামী ১০ বছর পর ভারতীয় রাজনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রজন্ম ক্রমেই অস্তমিত হয়ে যাবে। বয়সোচিত কারণে এবং নতুন প্রজন্মকে স্থান করে দিতে, তাঁদের কিছুটা সরে যেতেই হবে অথবা প্রত্যক্ষ নেতৃত্বপ্রদানের জায়গা থেকে তাঁরা কিছুটা অন্তরালে চলে যাবেন। এই তালিকায় আছেন নরেন্দ্র মোদি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতীশ কুমার, নবীন পট্টনায়ক, রাজনাথ সিং, সোনিয়া গান্ধী, পি চিদম্বরম, সীতারাম ইয়েচুরি, বিমান বসু, মায়াবতী, মুলায়ম সিং যাদব, লালুপ্রসাদ যাদব, মানিক সরকার, পিনারাই বিজয়ন, চন্দ্রবাবু নাইডু, কে চন্দ্রশেখর রাও, ফারুখ আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতির মতো নেতানেত্রীরা। যাঁরা ভারতীয় রাজনীতির আকাশে বিগত ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত বিরাজ করছেন। তাঁদের বাদ দিয়ে ভারতীয় রাজনীতির আগামী মানচিত্রটি কেমন হবে? বদলে যাবে পার্লামেন্টের অন্দরের দৃশ্য। বদলে যাবে রাজ্যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীদের মুখ। বদলে যাবে দলগুলির নেতৃত্ব। বদলে যাবে সমীকরণ। আগমন ঘটবে একঝাঁক নতুন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের। সেই নতুন তালিকায় নারীশক্তির চিত্রটি কেমন হবে?