বাড়তি অর্থ পাবার যোগ আছে। পদোন্নতির পাশাপাশি কর্মস্থান পরিবর্তন হতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পক্ষে থাকবে। ... বিশদ
অনেক বছর আগে আমাদের সমাজে লাভ ম্যারেজ নিয়ে মাঝেমধ্যেই সমস্যা দেখা দিত। তখনও গোঁড়া, অশিক্ষিত সমাজ ততটা নবজাগরণের আলো দেখেনি। শুধু বিয়ে কেন, সতীদাহ, কুলীনদের একাধিক বিয়ে, ইত্যাদি নিয়ে সমাজ অনেক পিছিয়ে ছিল। কিন্তু রামমোহন, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগরের জন্মভূমি এই বাংলা সেসব থেকে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে। আজ তাকে লাভ জেহাদের ভূত দেখিয়ে ভয় দেখাতে চাইছেন কট্টর হিন্দুরা। আমাদের এই বাংলার মানুষের কিন্তু কখনও মনে হয়নি, ‘হিন্দুধর্ম খতরে মে হ্যায়।’ হ্যাঁ, এক শ্রেণীর তথাকথিত ধর্মব্যবসায়ী অবশ্য সমাজকে নানাভাবে উৎপীড়িত করত। সেই দলটিই আবার ফিরে এসেছে হিন্দুধর্মের ঠিকাদারি নিয়ে। তাঁরা কেবলই ভয় দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন, ‘হিন্দু ধর্ম খতরে মে হ্যায়।’ আরে বাবা, হিন্দু ধর্ম খতরে মে হ্যায় বলে অসত্য প্রচার করতে করতে মোদিজি নিজেই করোনাকালে ১২ কোটি হিন্দুর চাকরি খেয়ে নিয়েছেন। দেশ খতরে মে হ্যায় বারবার বলে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। আসলে এদেশে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান কেউই খতরে মে নেই। যখন নেতাদের কুর্সি খতরে মে থাকে, তখনই ধর্মীয় বিভেদকে অস্ত্র করে, সীমান্ত সমস্যা খুঁচিয়ে তার মধ্য থেকে গদি বাঁচানোর অপকৌশল চাগাড় দিয়ে ওঠে। লাভ জেহাদের আড়ালে ব্যাপক খতরে মে হ্যায় আমাদের বেরোজগারি, আমাদের দু’বেলার খাদ্য সংস্থান, আমাদের শিক্ষা, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, আমাদের সামাজিক সুস্থিতি। গভীর গাড্ডায় দেশের অর্থনীতি। এসব থেকে মানুষকে ভুলিয়ে দাও ‘ধর্ম খতরে মে হ্যায়’ প্রচার করে। এদেশের ধর্মভীরু মানুষকে আফিম খাইয়ে দাও। তার মনে অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা আর বিদ্বেষ তৈরি করে দাও। পরস্পরকে লড়িয়ে দাও। এই ঘৃণার রাজনীতিই মোদিজির মূল অস্ত্র।
উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে, কর্ণাটক, অসম, হরিয়ানা এই পাঁচ রাজ্যে আনা হচ্ছে আইন। লাভ জেহাদের শাস্তি ৫ বছরের জেল। কোথায় সেই লাভ জেহাদ ক্রিমিন্যাল অফেন্স? যখন ধর্মীয় পরিচয় গোপন করে বিয়ে করা হয় এবং জোর করে ধর্মান্তরকরণ করে বিবাহ করা হয়। এটা নিয়ে কোনও আইন আনার প্রয়োজন নেই। কেননা বিবাহ আইনেই প্রতারণার শাস্তি আছে। এবং জোর করে ধর্মান্তরকরণ করলে তারও শাস্তি আছে। সেক্ষেত্রে এই আইনের কোনও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আসলে ঠিক এই সময়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলি এই আইন আনতে চলেছে। আগে কোন রাজ্য আইন এনে মোদিজির মনোরঞ্জন করতে পারবে, তাই নিয়ে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির মধ্যে তাড়াহুড়ো পড়ে গিয়েছে।
উত্তরপ্রদেশ সরকার লাভ জেহাদ নিয়ে আইন আনছে। যোগীজি তা ঘোষণাও করেছেন। যে রাজ্যের সরকার মেয়েদের লাঞ্ছনার হাত থেকে, ধর্ষণের হাত থেকে, পণপথার বলির হাত থেকে বাঁচাতে পারে না, তারা আসলে লাভ জেহাদের কথা বলে নিজেদের আরও বেশি অসম্মানিত করছে। যে রাজ্যে কন্যাসন্তান জন্মানোর পরই বহুক্ষেত্রে জন্মমুহূর্তে মেরে ফেলা হয়, সেখানে এভাবে বেটি বাঁচানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ে না।
এই দেশে অসংখ্য ‘সদগুরু’ বড় বড় আশ্রম তৈরি করে গেরুয়া ভেক ধরে প্রতারণার মাধ্যমে মেয়েদের উপর অত্যাচার করে চলেছেন। আশ্রমের ভিতরে গুমরে গুমরে কাঁদা যৌন নির্যাতিতা সেইসব বেটিকে সাধুবেশী নরাধমদের হাত থেকে বাঁচাবেন না? এসবের বিরুদ্ধে কড়া হোন, কঠোর আইন আনুন। তবেই তো বোঝা যাবে, বেটি বাঁচানোর কথাটার মধ্যে রাজনীতি নেই, সাচ্চাই আছে। কুলদীপ সিং সেঙ্গার, আশারাম বাপু, রাম রহিম, স্বামী চিন্ময়ানন্দ, স্বামী নিত্যানন্দ, ভোজপাল সিং, জয়েশ প্যাটেল, বিজয় জলি, বেঙ্কটেশ মৌর্য, নিহাল চাঁদ, প্রমোদ গুপ্ত। গেরুয়া প্যারেডে এঁরা কারা, সবাই জানেন। এঁদের কেউ হিন্দুধর্মের স্বঘোষিত নেতা। আবার কেউ বিজেপির নেতা-মন্ত্রী। সকলেই ধর্ষণে অভিযুক্ত। তাই সম্ভবত যোগীজি এইসব ক্ষেত্রে বেটি বাঁচানোর খুব একটা পক্ষপাতী নন।
একটি মেয়ে এবং একটি ছেলে কাকে ভালোবাসবে, কাকে বিয়ে করবে, তার উপর রাষ্ট্রের কোনও খবরদারি থাকতে পারে না। দু’টি নারীপুরুষের বিয়ে মানে শুধু শরীর নয়, মনও। মনের মিলন। সেই মন কারও দাসত্ব করে না। সেই মুক্ত, স্বাধীন মনের জায়গায় অস্ত্রাঘাত করতে চাইছে লাভ জেহাদ আইন। দুই ধর্মের দু’জন ভালোবেসে বিয়ে করলে, তারা সুখে থাকুক বা আর্থিক কষ্টে থাকুক, তাতে রাষ্ট্রের মাথাব্যথার কোনও কারণ নেই। একটি হিন্দু মেয়ের একটি হিন্দু ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে সে সুখে থাকবে, এটা কিন্তু সর্বাংশে সত্যি নয়। হিন্দু পরিবারে কত ডিভোর্স হয়, সে সম্পর্কে নেতাদের কোনও ধারণা আছে? নেই। সবটাই এদের কাছে রাজনৈতিক গা জোয়ারি। এটাও তালিবানি শাসনের মুদ্রার অপর দিক। বারবার প্রমাণিত, মুসলিম মৌলবাদ যতটা ভয়ঙ্কর, হিন্দু মৌলবাদ তার থেকে কোনও অংশে কম নয়। এই দেশের মানুষের ভালোবাসার অধিকারকে কেড়ে নেওয়াটা এক সংকীর্ণ মৌলবাদ। এখানে সংবিধানের সরাসরি অবমাননা করা হচ্ছে।
গত বছরই বিজেপির বড় নেতা কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রামলালের ভাইঝি শ্রিয়া গুপ্তর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস নেতা সুহৃতা করিমের ছেলে ফয়জন করিমের। বিজেপির রাজ্যসভার এমপি সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর মেয়ে সুহাসিনী বিয়ে করেছেন প্রাক্তন বিদেশ সচিব সলমন হায়দারের ছেলে নাদিম হায়দারকে। এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। বহু হিন্দু মেয়ে এদেশে মুসলিম পুরুষকে বিয়ে করে যে সুখে আছেন, তার উদাহরণও দেওয়া যায়। এই সব উদাহরণের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই, ভণ্ডামিও নেই। ভণ্ডামিটা হল এটা নিয়ে আইন তৈরি করা।
একটা সময় আমাদের হিন্দু ধর্মের মধ্যেই উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ আমরা পালন করতাম। অসবর্ণ বিবাহ তো দূরের কথা, নিম্নবর্গের মানুষের হাতে উচ্চবর্ণের মানুষ জল পর্যন্ত খেত না। তাদের ছায়া মাড়াত না। এখনও এইসব প্রথা বিহার, উত্তরপ্রদেশের গ্রামেগঞ্জে চালু থাকলেও এই দেশ সেইসব বর্বরতা থেকে অনেকটা এগিয়ে এসেছে মুক্তমনা পৃথিবীর দিকে। সেই মুক্তমনা পৃথিবীকে সংস্কারের এবং স্বার্থের শৃঙ্খল দিয়ে বাঁধতে চাইছেন বিজেপি নেতারা। লাভ ম্যারেজকে লাভ জেহাদ ছাপ্পা মেরে ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করতে চাইছেন। কেরলের হাদিয়া কেসকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দীপক শর্মা, বিচারপতি এ এম খানউইলকর এবং বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেই দিয়েছেন, কোনও ব্যক্তির আদর্শ, ধর্মবিশ্বাস তাঁর নিজস্ব, একান্ত ব্যক্তিগত। রোমান্স, প্রেম ও বিবাহের সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র দু’জনের নিজস্ব মতামত ও সম্মতির উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। সেখানে কী সমাজ, কী রাষ্ট্র, কী আইন-আদালত, কারও প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু বিজেপি সরকার সেখানে ঢুকে পড়তে চাইছে। সারা দেশে প্রতি বছর এরকম লাভ জেহাদের বিয়ে ক’টা হয়, সে সম্পর্কে বিজেপি নেতাদের কোনও ধারণাই নেই। তাঁদের হাতে কোনও তথ্যও নেই। যেটুকু হয়, তা হিসেবের মধ্যেই আসে না। তবু তাঁরা ভয় দেখাচ্ছেন, হিন্দু ধর্ম খতরে মে হ্যায়। কেন? না, ওই যে হিন্দু মেয়েটি মুসলিম ছেলেটিকে বিয়ে করল, ওদের সন্তান তো মুসলিম হয়ে গেল! বোঝো ঠ্যালা!
আসলে লাভ জেহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে বিজেপি এই দেশকেই এক প্রেমহীন অন্ধ আবর্তে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। সেই প্রেমহীন অন্ধ কারার ভিতর শুধু ধর্মের পোকা কিলবিল করতে থাকবে। যে ধর্মীয় পোকাগুলি এক অশিক্ষিত, বর্বর, অনুদার, হৃদয়হীন জগৎ ছাড়া আর কিছুতেই বিশ্বাস করে না।