বিদ্যায় সাফল্য ও হতাশা দুই-ই বর্তমান। নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কর্মপ্রার্থীদের শুভ যোগ আছে। ... বিশদ
বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে বঙ্গ রাজনীতিতে ঘটনার ঘনঘটা ততই বাড়বে। নিত্যনতুন সমীকরণে বদলাবে রাজনীতির রং। বিহারেও শেষ মুহূর্তে খেলা বদলেছিল। রামবিলাস পাসোয়ানের ছেলে চিরাগের বিদ্রোহেই নীতীশ কুমারের গায়ে ‘রাবার স্ট্যাম্প’ মুখ্যমন্ত্রীর তকমা। যাঁকে সামনে রেখে বিহার দখল, সেই নীতীশ কুমারই এখন বিজেপির করুণার পাত্র। অমিত শাহ সেই জন্যই ‘চাণক্য’। বিহার জয়ের কৃতিত্ব তাদের বলেই জাহির করছে গেরুয়া শিবির। নির্বাচনের ফল অনুকূলে যেতেই করোনার ‘থার্ড ওয়েভ’ এর মধ্যেও দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সামনে রেখে ‘বিজয় সমাবেশ’ করে বিজেপি বুঝিয়ে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছে, বিহার জয়ের কারিগর তারাই। কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের উপর ভর করে বিহার জেতার দম থাকলে বিজেপি কিছুতেই নীতীশের সঙ্গে জোটে যেত না। একক শক্তিতে ক্ষমতা দখল সম্ভব নয় বুঝেই বিজেপি নেতৃত্ব নীতীশের তৈরি করা জমিতেই ফসল বুনেছিল। তারপর সাফল্য মিলতেই নীতীশকে পিছনের সারিতে ঠেলে দিয়ে সাফল্যের একক কৃতিত্ব জাহিরের হাঁকডাক। তবে, তাতেও ৩১ বছরের এক যুবকের চ্যালেঞ্জের সামনে তাদের নাকানি-চোবানি খাওয়া চাপা থাকেনি। তেজস্বী যাদবের দলই সর্বাধিক আসন দখল করেছে। এনডিএ ও মহাজোটের ভোটের পার্থক্য মাত্র ০.০৩ শতাংশ। অর্থাৎ খুবই নগণ্য।
লোকসভা ভোটের আগে ও পরে হওয়া অধিকাংশ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেই বিজেপি নাস্তানাবুদ হয়েছে। ঝাড়খণ্ড হাতছাড়া হওয়ার পর বিজেপি কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি। জোট করে কোনওরকমে ক্ষমতা দখল করলেও গেরুয়া শিবির সেটাকে তাদেরই বিরাট সাফল্য বলে তুলে ধরতে চাইছে। উদ্দেশ্য, ২০২১ সালে বাংলার নির্বাচনের আগে বিজেপির বঙ্গ ব্রিগেডকে চাঙ্গা করা। ‘রাজনীতির ময়দানে শিশু’ তেজস্বীকে সামলাতেই বিজেপির তাবড় তাবড় নেতা মন্ত্রীর নাভিশ্বাস উঠেছে। সেখানে পোড়খাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোকাবিলা যে খুব সহজ হবে না, তা গেরুয়া শিবির হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সেই কারণেই নির্বাচনের পাঁচ মাস আগেই বাইরে থেকে প্লেয়ার পাঠানো শুরু করেছে। অনেকে বলছেন, ম্যাচ কঠিন বুঝেই বিজেপি লোকাল প্লেয়ারদের উপর ভরসা করতে পারছে না। তাই ভারতের বাছাই করা খেলোয়াড়দের এনে ফিল্ডিং সাজাচ্ছে। কিন্তু, তাতেও কতটা ফায়দা আসবে, সেটা বলা কঠিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ট্র্যাক রেকর্ড গেরুয়া শিবিরের চিন্তার কারণ। সমীহ করার মতোই তাঁর লড়াই এবং উত্থান। ৩৪ বছরের সিপিএম সরকারকে হটানোর রেকর্ড তো আছেই। তাছাড়াও ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে জোড়া ফলা নারদ-সারদার মুখ থেকেও দলকে টেনে তুলেছিলেন তিনিই। একক ক্ষমতায়। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও ম্যাচ বের করার রেকর্ড রয়েছে তাঁরই ঝুলিতে। করোনা মোকাবিলাই এখনও তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকায়। তাই তিনি ময়দানে নামলে ২০০ আসনের টার্গেট বেঁধে দেওয়া অমিত শাহের ঘোড়া লক্ষ্যভেদ করবে, নাকি প্রতিরোধের সামনে মুখ থুবড়ে পড়বে, সেটা সময়ই বলবে।
তবে, পশ্চিমবঙ্গে নীতীশ কুমার নেই। এখানে বিজেপিকে লড়তে হবে নিজের তাকতে। নিজেদের তৈরি করা জমির উপর দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার পর থেকে বঙ্গ বিজেপির সাফল্য বলতে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন দখল। আর সেটাও বাম ভোটের সৌজন্যে। সেই ভোটও এসেছিল হাওয়ায়। জবরদস্ত ইস্যু না থাকলে ভারতের অর্থনীতির মতোই পাঁকে আটকে যায় বিজেপির রথের চাকা। পাঁকে তখন আর পদ্ম ফোটে না। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এরাজ্যে তিনটি আসনে উপনির্বাচনের ফল।
লোকসভা ভোটের পর এরাজ্যে তিনটি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন হয়েছিল। তিনটিতেই লোকসভা নির্বাচনের বিপুল ব্যবধান মুছে দিয়ে তৃণমূল প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছিলেন। তার অন্যতম কারণ দু’টি। প্রথমত, বালাকোটের মতো জাতীয় ভাবাবেগ তৈরির ইস্যু ছিল না। দ্বিতীয়ত, এনআরসি ইস্যু বিজেপির অস্ত্র হওয়ার জায়গায় ব্যুমেরাং হয়েছিল। এরাজ্যে বিজেপি ভালো ফল করলেও সাংগঠনিক কাঠামোর বিচারে বামেরা এখনও বিজেপির চেয়ে এগিয়ে। সংগঠন থাকলেও মানুষ সরে যাচ্ছে। তবে, তার জন্য দায়ী সিপিএমের ‘দিদিভাই-মোদিভাই’ পলিসি। ৩৪ বছরের শাসন ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য সিপিএম নেতা কর্মীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সহ্য করতে পারেন না। বামেদের ধারণা, মমতা তৃণমূল না গড়লে তারা আরও অনেকদিন রাজ্যপাট চালিয়ে যেত। তাই তাদের চোখে মমতা ‘জাতশত্রু’। সেই কারণেই বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিস্ট সহ নানা চোখা চোখা বিশেষণে ভূষিত করলেও মমতা বিন্দুমাত্র সুবিধা পান, এমন কাজ তাঁরা কিছুতেই করেন না। ত্রিপুরায় লেনিনের মূর্তি ভাঙা, কমরেডদের উপর নির্মম অত্যাচারের পরেও সিপিএম নেতাদের চোখে উভয়েই সমান। অনেকেই মনে করেন, বাম নেতৃত্বের এই মধ্যপন্থার নীতিই তাদের দ্রুত শক্তিক্ষয়ের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে যুবকরা দোদুল্যমানতা পছন্দ করে না। তারা একটা স্ট্রং লাইন চায়।
বৃহস্পতিবার ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেও তিনি দেশে এবং রাজ্যে বিজেপিকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলেও তৃণমূলকে হারানোর কথাই বলেছেন। তাঁর যুক্তি, তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে রাজ্যের বিরোধী ভোট চলে যাবে বিজেপির কব্জায়। তাই উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে তৃতীয় নির্ভরযোগ্য বিকল্প তৈরি করতে হবে। কিন্তু, ইয়েচুরি সাহেব বুঝতে চাইছেন না, বঙ্গে সিপিএমের তালপুকুরে আজ আর ঘটিটিও ডোবে না। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের আরও একটি কথা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘কেউ যদি বলেন, বিজেপিকে পরাস্ত করতে তৃণমূল সহ সকলকে নিয়ে চলতে হবে, তা হবে আত্মঘাতী।’ তাঁর এই বক্তব্য সম্প্রতি সিপিআই(এমএল) এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের একটি মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
বিহার নির্বাচনের পর সিপিআই(এমএল) এর মুখপত্র ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় দীপঙ্করবাবু খুব স্পষ্ট করে তৃণমূলের বদলে বিজেপিকেই আক্রমণের মূল লক্ষ্য করতে চেয়েছেন। কারণ তিনিও বুঝেছেন, তৃণমূলকে হটানোই যদি একমাত্র লক্ষ্য হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে বিজেপি তার পুরো ফায়দা তুলবে। দীপঙ্করবাবু বলেছেন, এই মুহূর্তে আইনের শাসনের ক্ষেত্রে, গণতন্ত্রের জন্য, সংবিধানের জন্য বিজেপি একটা বিরাট বিপদ। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আছে। তাদের গণতন্ত্র বিরোধী আচরণ এবং দুর্নীতির প্রশ্নগুলি আমাদের কাছে আছে। তবুও আমি বলব, পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপিকেই এক নম্বর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বামপন্থীদের অবশ্যই নিতে হবে।
বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করে দীপঙ্করবাবু সাফ বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিজেপিকে ঠেকানোই বামেদের মূল এজেন্ডা হওয়া উচিত। সিপিআই(এমএল) এর রাজ্য স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সজল অধিকারীর মতে, ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ নীতি নিয়ে চললে ভুল হবে। যাঁরা ভাবছেন, ২০২১ সালে রাম, আর ২০২৬ সালে বাম, তাঁরা বিজেপির অজিত মালব্যদের পাতা ফাঁদেই পা দিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ দখলকে ঘিরে বিজেপির ‘গেম প্ল্যান’কেই সাহায্য করছেন। বিহার নির্বাচনে বামেদের ভোট বেড়েছে। তবে, আশাতীত ফল করেছে সিপিআই(এমএল)। ১৯টি আসনে লড়ে ১২টিতে জিতেছে। প্রায় প্রতিটি আসনেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে। তিনটি আসন হেরেছে খুব সামান্য ভোটে। সেখানে সিপিএম ও সিপিআই পেয়েছে চারটি। বিহার নির্বাচনে সাফল্যের সূত্রেই সিপিআই(এমএল) বাম রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে ছোট দল হলেও সিপিআই(এমএল) এর হাতে লেগে নেই কান্দুয়া, ছোট আঙারিয়া, নন্দীগ্রাম, নেতাই গণহত্যার রক্ত। সিপিএম জমানায় সংগঠিত একের পর এক গণহত্যা ও অত্যাচারের ঘটনায় বহু বাম মনস্ক মানুষের মাথা লজ্জায় হেঁট হয়েছে। তাঁরা সরে গিয়েছেন। এখনও এরাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষ বামপন্থায় বিশ্বাসী। নিজেদের বামপন্থী বলে ভাবতে গর্ববোধ করেন। দীপঙ্করবাবুদের দল দেশ ও রাজ্যের বাস্তব প্রেক্ষিত বিচার করে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিলে এরাজ্যে খুলে যেতে পারে বিকল্প বামপন্থার এক নতুন দিগন্ত।