গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
এতদিনে আমরা জেনে গিয়েছি যে গোলাকার করোনা ভাইরাস থেকে যে পায়ার মতো স্পাইক-প্রোটিন বেরিয়ে থাকে তা আমাদের ফুসফুস এবং শ্বাসনালীর কোষের ঝিল্লিতে (মেমব্রেন) অবস্থিত এসিইউ-২ প্রোটিনের সঙ্গে খাপে খাপ লেগে যায়। এসিইউ-২’র সাহায্যে ভাইরাস তারপর কোষের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং নিজের বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। তারপর নতুন ভাইরাসরা চারপাশের কোষের এসিইউ-২ প্রোটিনের সাহায্যে তাদের মধ্যেও ঢোকে। অসুখ বেড়ে চলে। শুধু ফুসফুস, শ্বাসনালী, গলবিল এবং নাসিকা গহ্বরে নয়, হৃৎপিণ্ড, ধমনী-শিরা-রক্তজালক, কিডনি, ক্ষুদ্রান্তের বহু কোষকলায় প্রভূত পরিমাণে এসিইউ-২ প্রোটিন আছে। তাই এসব অঙ্গে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ঘটনাচক্রে করোনা এসিইউ-২-কে ব্যবহার করছে। শরীরে এসিইউ-২’র আসল কাজ তো ভাইরাসের ‘দরজা’ হওয়া নয়। তাহলে এসিইউ-২’র শারীরিক কাজ কী? এরসঙ্গেই কি হার্ট, কিডনি, ফুসফুসের অসুখ জড়িয়ে আছে?
এসিইউ-২ হল অনেকগুলি প্রোটিন নিয়ে গঠিত একটি দলের সদস্য। শারীরবিদ্যার পরিভাষায় এর নাম রেনিন-আঞ্জিওটেনসিন-আলডোস্তেরন সিস্টেম। শরীরের সর্বত্র এ কাজ করে চলে এবং বিকল হলে স্বাস্থ্য বিগড়বেই। কী করে এই সিস্টেম? রক্তের আঞ্জিওটেনসিনওজেন প্রোটিন থেকে আঞ্জিওটেনসিন-২ তৈরি করে। এই আঞ্জিওটেনসিন-২ শরীরের সব জায়গায় পৌঁছে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং ধমনী ও শিরার বাহসঙ্কোচন করে। তার ফলে শরীরে রক্তের পরিমাণ এবং জল ও সোডিয়াম-পটাশিয়ামের মাত্রা ঠিক থাকে। রক্ত সংবহন, কিডনি, ফুসফুস ও হার্টের কাজ ঠিকভাবে চলতে থাকে। কোনও জীবাণু বা বিষাক্ত কেমিক্যাল শরীরে ঢুকলে তার সঙ্গে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার যে লড়াই লাগে তাতেও আঞ্জিওটেনসিন-২ কাজ করে। এই লড়াই থেকে কোষকলায় প্রদাহ হয়, বহিরাগত শত্রুকে ধ্বংস করতে শ্বেত কণিকারা ছুটে আসে। বিভিন্ন কোষকে সিগন্যাল দেয়। আঞ্জিওটেনসিন-২ এই যুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি।
অবশ্য, সব জিনিসের একটা মাত্রা আছে। ধরুন, শত্রুকে মারতে গিয়ে আপনি অতি উৎসাহী হয়ে এমন কামান দাগলেন যে আপনার নিজের বাড়িঘরও উড়ে গেল—সে তো হিতে বিপরীত! তাই আঞ্জিওটেনসিন-২’র কাজকর্মের ওপরেও শরীরকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়। এবং আঞ্জিওটেনসিন-২কে নিয়ন্ত্রণ করা হল এসিইউ-২’র আসল কাজ। ঠিক কী করে এসিইউ-২? আঞ্জিওটেনসিন-২ থেকে একটা ছোট্ট অংশ কুচ করে কেটে দেয়। তৈরি হয় আঞ্জ-১-৭। আশ্চর্য এই যে আঞ্জিওটেনসিন-২ থেকে তৈরি হলেও আঞ্জ-১-৭’র কাজকর্ম হল আঞ্জিওটেনসিন-২র বিপরীত। আঞ্জিওটেনসিন-২ রক্তচাপ, বাহসঙ্কোচন, প্রদাহ বাড়িয়ে দেয়, উল্টোদিকে আঞ্জ-১-৭ রক্তচাপ কমিয়ে দেয়, ধমনী-শিরার বাহপ্রসারণ করে, মাত্রাতিরিক্ত প্রদাহ কন্ট্রোল করে ফুসফুস, কিডনি ও হার্টের কোষকে সুরক্ষিত রাখে। তাই, আঞ্জিওটেনসিন-২ আর আঞ্জ-১-৭ দু’জনের ব্যালান্স এই সবকিছুকে সুস্থ পরিধির মধ্যে রাখে। যদি কোনও কারণে আঞ্জ-১-৭’র কাজ ঠিকঠাক না হয়, তখন আঞ্জিওটেনসিন-২ লাগামছাড়া হয়ে উঠতে পারে এবং শরীরকে প্রেশার, সুগার, কিডনির অসু্খের দিকে ঠেলে দেয়। অতিরিক্ত প্রদাহ থেকে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও কিডনির ক্ষতি হতে শুরু করে। এ যেন একের পর এক সেমসাইড গোল!
ইতালিতে যখন মহামারী ভয়াবহ আকার নিলে পো উপত্যকা ও লম্বারডি অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি রোগীর মৃত্যু হয়। এই দুই অঞ্চলে দূষণ প্রচণ্ড। তখনই সন্দেহ দানা বাঁধে যে দূষণই এজন্য দায়ী। এরপর একই ধরনের রিপোর্ট আসে চীন থেকেও। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে হিসেব করে দেখা গেছে যেখানেই বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি, সেখানেই করোনা তত ভয়ানক, তত বেশি করোনা রোগী মারা যাচ্ছেন। দূষিত বাতাসে যদি পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ (PM 2.5) অতি অল্প পরিমাণেও বেড়ে যায় তাহলে করোনায় মৃত্যুহার ৮ থেকে ১১% বেড়ে যায়! অর্থাৎ, এমনিতে করোনা বেশিরভাগ লোকেরই সেরে যায়, কিন্তু বায়ুদূষণ বেড়ে গেলে যাঁদের হার্ট, ফুসফুস, কিডনি, সুগার, প্রেশারের অসুখ আছে তাঁদের জন্যে এই মহামারীর গ্রাস অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
কেন এমন হয়? বিজ্ঞানীমহল নিঃসন্দেহ নন। তবে বড় সন্দেহ পড়েছে আঞ্জিওটেনসিন-২, আঞ্জ-১-৭ আর এসিইউ-২ প্রোটিন দলের ওপরে। দেখা গেছে যে দূষিত বাতাসে যে PM 2.5, PM 1 ও নাইট্রোজেন অক্সাইড আছে তার প্রভাবে ফুসফুস, শ্বাসনালী, নাসিকা গহ্বর ইত্যাদির কোষে এসিইউ-২’র মাত্রা বেড়ে যায়। এসিইউ-২’র পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এ অবশ্য একদম নতুন কিছু নয়—ফুসফুসে যাঁদের সিওপিডি অসুখ আছে এবং যাঁরা সিগারেট খান তাঁদেরও অনেকের কোষে বেশি এসিইউ-২ দেখা গেছে। যাঁদের হার্টের সমস্যা আছে, তাঁদের হৃৎপিণ্ডের কোষে বেশি এসিইউ-২ থাকে।
এসিইউ-২ বাড়িয়ে শরীরের কী লাভ? সম্ভবত, PM 2.5, নাইট্রোজেন অক্সাইড ইত্যাদি দূষণকারী কেমিক্যালের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে প্রদাহ (ইনফ্লেমেশন) হয় এবং তাতে আঞ্জিওটেনসিন-২’র বড় ভূমিকা আছে। এবং আঞ্জিওটেনসিন-২’র উপর নজর রাখতে দরকার হয় আঞ্জ-১-৭, আর আঞ্জ-১-৭ তৈরি করতে লাগে এসিইউ-২। তাই, দূষণের সময় (বা সিগারেট খেলে)এসিইউ-২’র মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হয়। সোজা কথায়, ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না’। অনেকটা একই জিনিস হয় যাঁদের হার্ট ও প্রেশারের সমস্যা আছে তাঁদের ক্ষেত্রে। আঞ্জিওটেনসিন-২ যাতে ক্ষতি করতে না-পারে সম্ভবত তাই এঁদের হৃৎপিণ্ডের কোষে বেশি এসিইউ-২ তৈরি হয়।
এসবই মোটামুটি ভালো চলছিল। কিন্তু এবছর যে দূষণের দোসর হয়ে এসেছে করোনা। সে যে এসিইউ-২কে দরজা হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে কি যেসব শরীরে বেশি এসিইউ-২ আছে, সেখানে করোনা ভাইরাস আরও সহজে ঢোকে? প্রথমে শ্বাসনালী-ফুসফুস, পাশেই হার্ট, তারপর কিডনি, ক্ষুদ্রান্ত্র সব জায়গায়। বিজ্ঞানীরা অকাট্য প্রমাণ পাননি। তবে কিছু গবেষণার ইঙ্গিত সে দিকেই। এমনকী, এই ভাইরাস প্রবেশের কিছুপর থেকে এসিইউ-২’র মাত্রা কমতে থাকে। জটায়ুর কথায়, এ হল ‘সুপার কেলেঙ্কারি’। এসিইউ-২ কমে যাওয়া মানেই তো আঞ্জিওটেনসিন-২ লাগামছাড়া হয়ে ওঠা—প্রেশার, হৃৎপিণ্ডের ওপর বেশি চাপ, প্রদাহ বেড়ে যাওয়া। প্রথমে এসিইউ-২ বেড়ে থাকায় বিপদ, তারপর এসিইউ-২ কমে যাওয়ায় ডবল বিপদ। যাঁরা এমনিতেই রুগ্ন ভাইরাল ইনফেকশন কাটিয়ে উঠলেও তাঁদের অনেকেরই হার্ট-ফুসফুস-কিডনি এই জোড়া ধাক্কা সামলাতে পারে না।
শীতকালে বাতাসে দূষণের মাত্রা এমনিতেই ঊর্ধ্বমুখী, রোগ বাড়ে। ওইসঙ্গে আসে দীপাবলির বাজি। দিল্লি, লখনউ, জামশেদপুর, সালকিয়া ও হিসারে গবেষণায় দেখা গেছে, দীপাবলির সন্ধ্যা থেকে যত বাজি ফাটে বাতাস তত বিষাক্ত হতে থাকে। সেই বিষ একদিনের বেশি থেকে যায়। করোনাকালে এমন দূষণ কিন্তু মারাত্মক বিপদ।